সিদ্ধান্ত ব্যাপারটাই মূলত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত। মন্তিয়েলের বিধবা তার উলটোদিকে থাকে। ফলত, একসময় বাবার সিদ্ধান্তই তাঁর সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্বামী যা বলে দিয়েছেন, তাই তিনি মেনে নিয়েছেন। খেয়াল করলে দেখব, আমরা প্রত্যেকে প্রায় ওই মন্তিয়েলের বিধবার মতোই। সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে আসে, আমরা অধিকাংশ সময়ই তা মেনে নিই। সিদ্ধান্তের হর্তাকর্তাবিধাতারা তখন বুঝে নেন, সেইটেই দস্তুর।
৩.
অন্য একটি বিষয় নিয়েই লিখব ভেবেছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ে গেল মার্কেসের ‘মন্তিয়েলের বিধবা’।
মার্কেস মানে জাদুবাস্তবতা। মোটামুটি এই সহজ সমীকরণের ভিতর দিয়েই তো সময়ের উপলখণ্ড হাতে নিয়ে কত না নিরীক্ষা! নিজস্ব সময়কে মার্কেস এমনভাবে মহাকালে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন যে, আজ দেখলে মনে হবে, এই তো কালকের কথা বলছেন। যেমন এই মন্তিয়েলের বিধবার কথাই ধরা যাক না কেন! ছাপোষা একজন নারী। যাঁকে কস্মিনকালেও কেউ কথা বলতে দেয়নি। ছোটবেলায় বাবা আটকে রেখেছিলেন। তারপর একদিন ধনী পুরুষ মন্তিয়েলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। মা-বাবার চোখে মন্তিয়েলই আদর্শ পাত্র। তিনি তো সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা একজন সফল পুরুষ। নিজের ক্ষমতায় গড়েছেন বিশাল সাম্রাজ্য। ধনসম্পত্তিতে কুবেরের কাছের লোক। এখন এই সাধারণ স্তর থেকে উঠে এসে বিত্তের শীর্ষে পৌঁছনো পুরুষদের প্রায় সব জায়গাতেই ‘শ্রেষ্ঠ’ জ্ঞান করা হয়। এক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। মন্তিয়েলের এই প্রতিপত্তি বৃদ্ধির কারণটি বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্তব্য হল না। অথবা হল কোনও গোপন খেলা। অথচ মার্কেস তো মার্কেসই। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, মন্তিয়েলের এই সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ওঠার নেপথ্যে আছে রাজনীতি। ক্ষমতা দখলের লড়াই। যে লড়াই মূলত বিপক্ষের ধনীদের মেরেধরে ভয় দেখিয়ে দেশছাড়া করে সম্পত্তি গ্রাস করার। মন্তিয়েল যে কোন দলে ছিলেন বলা যায় না, তবে তাঁর ধনবৃদ্ধি হল চড়চড়িয়ে।
মন্তিয়েল যখন মারা গেলেন তখনই গল্পের শুরু। মন্তিয়েলের বিধবা, তাঁর স্বামীর কাছেও বিশেষ কথাবার্তা বলতে পারেননি। স্বামী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ওই রান্নাঘরই তাঁর জায়গা। তা তিনি মেনেও নিয়েছিলেন। এখন স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি আশা করে আছেন, বহু মানুষ এসে তাঁর স্বামীকে শ্রদ্ধা জানাবেন ইত্যাদি। এইখানেই মার্কেসের খেলা শুরু। একজন নারীর চরিত্রে তিনি তুলে ধরছেন সময়ের চারিত্র্য। যা শুধু লাতিন আমেরিকার বাস্তবতা নয়, পৃথিবীর যে কোনও ভূখণ্ডের যে কোনও সময়ের বাস্তবতা হতে পারে। মন্তিয়েলের স্ত্রী কি তাঁর চারিদিকে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে অজানা ছিলেন? তা নয়। তবে তিনি ভাবেননি যে, তাতে তার স্বামীর কোনও ভূমিকা আছে। স্বামীর কাজকর্মের একটু আধটু দুর্বলতার কথা তিনি যা জানতেন, তা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। পাত্তা পাননি। মার্কেজ একখানা অলিখিত প্রশ্ন ঝুলিয়ে দিচ্ছেন গল্পের এইসব জায়গায়। মন্তিয়েলের বিধবা কি আর একটু কড়া অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না? স্পষ্ট করে বলতে পারতেন না স্বামীকে যে, তাঁর অনৈতিক কাজগুলো বন্ধ হওয়া উচিত? নাকি আগাগোড়া মুখ-বন্ধের অভ্যাস তাঁকে যেভাবে পেয়ে বসেছিল, তাতে সেরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি?
………………………………………………….
সাধারণ স্তর থেকে উঠে এসে বিত্তের শীর্ষে পৌঁছনো পুরুষদের প্রায় সব জায়গাতেই ‘শ্রেষ্ঠ’ জ্ঞান করা হয়। মন্তিয়েলের এই প্রতিপত্তি বৃদ্ধির কারণটি বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্তব্য হল না। অথবা হল কোনও গোপন খেলা। অথচ মার্কেস তো মার্কেসই। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, মন্তিয়েলের এই সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ওঠার নেপথ্যে আছে রাজনীতি। ক্ষমতা দখলের লড়াই। যে লড়াই মূলত বিপক্ষের ধনীদের মেরেধরে ভয় দেখিয়ে দেশছাড়া করে সম্পত্তি গ্রাস করার। মন্তিয়েল যে কোন দলে ছিলেন বলা যায় না, তবে তাঁর ধনবৃদ্ধি হল চড়চড়িয়ে।
………………………………………………….
আসলে, সিদ্ধান্ত ব্যাপারটাই মূলত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত। মন্তিয়েলের বিধবা তার উলটোদিকে থাকে। ফলত, একসময় বাবার সিদ্ধান্তই তাঁর সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্বামী যা বলে দিয়েছেন, তাই তিনি মেনে নিয়েছেন। খেয়াল করলে দেখব, আমরা প্রত্যেকে প্রায় ওই মন্তিয়েলের বিধবার মতোই। সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে আসে, আমরা অধিকাংশ সময়ই তা মেনে নিই। সিদ্ধান্তের হর্তাকর্তাবিধাতারা তখন বুঝে নেন, সেইটেই দস্তুর। বরং তাঁরা তেমন খেলুড়ে হলে এই পুরো প্রক্রিয়াটাই খানিক ঘুলিয়ে দেন। কার সিদ্ধান্ত অন্য কার উপর কী প্রভাব ফেলছে, তা হয়ে ওঠে কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছ! ফলত ভুল বোঝাবুঝির জন্ম হয়। মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ে। মন্তিয়েলের বিধবার মতো আমরা ক্রমশ নিশ্চুপ হয়ে যাই। আমাদের দেখে কারও মনে করুণা জাগে। কেউ-বা বিরক্ত হয়। এমনই দু’-পরতের পোশাক গায়ে চাপিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই, যারা কি না নিজেদের সময়ে এক-একজন মন্তিয়েলের বিধবা।
কিন্তু এর পরেও একটা কথা থেকে যায়। তা হল ওই সিদ্ধান্ত। মন্তিয়েলের বিধবা মেনে-নেওয়াতেই অভ্যস্ত। তারপরেও স্বামীর খারাপ কাজের বিরুদ্ধে কথা বলতে দ্বিধা করেননি। সাবধান করেছিলেন, পরামর্শ দিয়েছিলেন। শোনা হয়নি, তা আলাদা কথা। কিন্তু কখনও কখনও নিজের একেবারে ব্যক্তিসত্তার গহন থেকে উঠে আসে সিদ্ধান্ত। তা আর রেয়াত করে না যে, উলটোদিকের মানুষটি স্বামী না বাবা নাকি নিকট আত্মীয়। মন্তিয়েলের বিধবা তো তাঁর স্বামীকে পরামর্শ বা সাবধান করার সিদ্ধান্ত না নিলেই পারতেন, তবু নিয়ে তো ছিলেন। আসলে, যাঁদের মত মেনে নিয়ে পথ ধরেন একজন ব্যক্তি, তাঁকে যদি সেই পথেই ঠেসে ধরা হয়, তবে একদিন হাঁসফাঁস। মতের যন্ত্রের বাইরে তখন তাঁর নিজের স্বর বেরিয়ে আসে। সে স্বর কি ক্ষতিকর? মন্তিয়েলের স্ত্রী কি তাঁর ক্ষতি চেয়েছিলেন? চাননি। মন্তিয়েলের প্রবাল প্রতাপে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত জোরালো করতেও পারেননি, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যে থাকে না, তা তো নয়। আর জাদুকর মার্কেস যখন সেই এককের সিদ্ধান্তকে একটা দেশের মানসিকতার সঙ্গে জুড়ে দেন, আমরা বুঝতে পারি, এই সিদ্ধান্তের শক্তি আসলে ব্যক্তিমানুষকে সমষ্টির সঙ্গে অন্বিত করতে পারে। সেখানে আর মতের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সে-মত স্বতন্ত্র, সমুদ্রের জলস্রোতের সঙ্গে জুড়ে থেকেও ঢেউ যেমন খানিক পৃথক।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………….
একটা সিদ্ধান্ত তাই আমাদের নিজস্ব; তা থাকেই। কাছের জনের জন্যই থাকে। হয়তো সে সময়বিশেষে তা দেখতে-শুনতে চায় না। হয়তো আমরা জোর করে তা বলতেও পারি না। দেখা এবং না-দেখা। দুই-ই পাশাপাশি। আমাদের জীবনের ঘোরতর বাস্তব, ওপেন সিক্রেট-ও।
……………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে