সংবিধান প্রণয়নের সময় জওহরলাল নেহরু ‘ভারত’ না ‘ইন্ডিয়া’– এই বিতর্কখানা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান। এবং সমঝোতায় আসেন, ‘ভারত, অর্থাৎ ইন্ডিয়া’ এই বলে। স্বাধীনতা আন্দোলনে যে ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতটি বহুলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল, তাকে ‘জাতীয় সংগীত’-এর বাছাইকরণে একেবারে শেষ ধাপে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সেই পদমর্যাদার জোরেই। ‘ভারত’ শব্দটিকে আসলে উত্তর-ঔপনিবেশিক সময় গুরুত্বহীন করে তোলা হয়েছিল।
গত সপ্তাহের ‘ভারত’ বনাম ‘ইন্ডিয়া’র বিতর্ককে একটু বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার ফলশ্রুতি হল এই যে, সাধারণ মানুষ এবার ভাবতে শুরু করেছে, তারা নিজেদের কীভাবে দেখে, এবং অন্যরাই বা তাদের কীভাবে দেখছে! আমাদের জাতীয় সংগীতে এই দেশকে ‘ভারত’ নামেই সম্বোধন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সংগীতটি বাংলা ভাষায় রচনা করেছিলেন। ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’-রও উল্লেখ রয়েছে সেখানে, এবং সেখানে ‘ভারত’ কী, তা বোঝাতে কোনও সাবটাইটেল দরকার হয়নি। কারণ আমজনতা, সে যে ভাষাভাষীরই হোন না কেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যে নোট ব্যবহার করেন, সেখানে স্পষ্টতই এই স্থাননামের পরিচয় পেয়ে থাকেন। যে দেশে আমরা থাকি, তাকে আমরা মোটামুটিভাবে ‘ভারত’ই বলতেই অভ্যস্ত।
অবশ্য সর্বক্ষেত্রে যে, তা নয়। স্ব-রাজের ৭৫ বছর এবং আধুনিকতার খাপছাড়া বোধকে ধন্যবাদ, তাদের অনুকম্পায় এই ‘ভারত’ ক্রমে ‘ইন্ডিয়া’র দরিদ্র ভাই হয়ে ওঠেছে। সংবিধান প্রণয়নের সময় জওহরলাল নেহরু ‘ভারত’ না ‘ইন্ডিয়া’– এই বিতর্কখানা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান। এবং সমঝোতায় আসেন, ‘ভারত, অর্থাৎ ইন্ডিয়া’ এই বলে। স্বাধীনতা আন্দোলনে যে ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতটি বহুলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল, তাকে ‘জাতীয় সংগীত’-এর বাছাইকরণে একেবারে শেষ ধাপে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সেই পদমর্যাদার জোরেই। ‘ভারত’ শব্দটিকে আসলে উত্তর-ঔপনিবেশিক সময় গুরুত্বহীন করে তোলা হয়েছিল। এমন নয় ‘ভারত’ শব্দটি ব্যবহার করতে কখনও ‘নিরুৎসাহিত’ বা শব্দটিকে ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়েছিল। বরং দেখা হয়েছিল অনেকটা ‘আঞ্চলিক শব্দ’-এর মতো করে। এই আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার ভারতীয় ভাষাগুলির শ্রেণিবদ্ধ অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। ‘ভারত’-এর ক্ষেত্রে সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিতভাবেই ‘উদ্ভট’ এবং ‘আদ্যিকালের’ শ্রেণিতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশে রাষ্ট্রপতি নিজেকে ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি’ হিসাবে বর্ণনা করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা প্রকাশ্যে আসতেই নানারকম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। জানা গিয়েছে, নরেন্দ্র মোদি সরকার দেশের নাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। বিক্ষুব্ধ মহলের বক্তব্য, ‘ভারত’ বা ‘ইন্ডিয়া’ ব্যবহারের অবাধ অধিকার সরকারের রয়েছে বলে যে দাবি, তা একেবারেই অযৌক্তিক। পশ্চিমি অভিজাতদের একটি অংশের গভীর বিশ্বাস থেকেই এই ক্ষোভের দাবানল। তাদের মত যে, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটিকেই বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করা উচিত। ‘ভারত’ যদি ব্যবহার করতেই হয়, তবে সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২২টি ভাষায় (ইংরেজি ব্যতীত) যোগাযোগের জন্য সংরক্ষিত থাকুক।
সংবিধান ‘ভারত’ ও ‘ইন্ডিয়া’– উভয়কেই সমান মর্যাদা দিয়েছে বলে যে ব্যাপারখানা উঠে আসছে তা সত্যি, তবে পুরোপুরি বাস্তব নয়। এমনটাই যদি হত, তাহলে জি-২০-এর সময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সচেতনভাবে ‘ভারত’ শব্দ ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি নিয়ে বিতর্কর পাহাড় গড়ে উঠত না। বেজায় প্রতিবাদ করে মোদির সমালোচকরা দেখিয়েছেন যে, তাদের চোখে ‘ইন্ডিয়া’ ভারতের চেয়ে সামাজিক অগ্রাধিকার পেয়েছে।
ধারণা, সেই সমলোচকরা সম্ভবত জওহরলাল নেহরুর কাছ থেকেই শিক্ষা নিয়েছেন– যিনি প্রায়শই অতীতকে ভারতের আধুনিকতার পথে বাধা হিসাবে দেখেছিলেন। ১৯৫৫ সালে চণ্ডীগড়ে, পাঞ্জাব হাইকোর্ট ভবনের উদ্বোধন করতে গিয়ে তাঁর সংস্কারাচ্ছন্ন মনটির টের পাওয়া যায়। নেহরু বলেছিলেন: ‘আমি খুব খুশি যে পাঞ্জাবের লোকজন কোনও পুরোনো শহরকে তাঁদের নতুন রাজধানী করার ভুল করেনি। আপনারা যদি কোনও পুরনো শহরকে রাজধানী হিসাবে বেছে নিতেন, তবে পাঞ্জাব মানসিকভাবে স্থবির, পিছিয়ে পড়া রাজ্যে পরিণত হত। হয়তো সেক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করতে পারত, প্রচুর প্রচেষ্টায়, কিন্তু তা কখনওই একটা বড় পদক্ষেপ হত না।’
স্বদেশিদের প্রতি নেহরুর এই অবজ্ঞা এবং সুইস-ফ্রেঞ্চ স্থপতি লে করবুজিয়ার নান্দনিকতার প্রতি তাঁর পছন্দ এর চেয়ে সুস্পষ্ট হতে পারে না। ঠিকঠাক সুযোগ থাকলে, তিনি সম্ভবত ভারতকে একটি জাদুঘরেও পরিণত করতে পারতেন।
অবশ্যই, এই বিতর্কের আরও সমসাময়িক মাত্রা রয়েছে। যাঁরা ভারতকে নিছক উত্তরাধিকারের চেয়ে অনেক বেশি গভীর বলে মনে করেন, তাঁদের কাছে বিষ্ণুপুরাণের শ্লোক (সংসদীয় বিতর্কে যা মোদি উদ্ধৃত করেছেন) এই জাতিসত্তা বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে: ‘উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিনম্।/ বর্ষং তৎ ভারতং নাম ভারতী যত সন্ততিঃ।’ গত শতকের দুয়ের দশকে ইতিহাসবিদ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ভারতীয় জাতিসত্তার প্রাচীনত্ব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছিলেন– যা মূলত ঔপনিবেশিক পণ্ডিতদের এবং তাদের অধীনে গবেষকদের বিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া। তা হল, ‘ভারত’ নিরক্ষীয় অঞ্চলের মতোই একটি জাতি। এই অনুমানের অনেকগুলিই পরবর্তীকালে মার্কসবাদী এবং নব্য-আধুনিকতাবাদীদের দ্বারা পুনর্নির্মিত হয়েছিল। সেই পুনর্নির্মাণ বলে, ‘ভারত’ কেবল ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজ্যগুলির ইউনিয়নই নয়, বরং একটি অন্তহীন সমঝোতাও। সনাতন ধর্মকে মারাত্মক সংক্রামক রোগের সঙ্গে তুলনা করে ‘ডিএমকে’-র কিছু নেতার সাম্প্রতিক মন্তব্যে দেখা যাচ্ছে, উপমহাদেশে সভ্যতার বন্ধন রয়েছে বলে যে বিশ্বাস করা হচ্ছে, তাও গুরুতরভাবে বিতর্কিত।
ইন্ডিয়া-ভারত বিতর্ক নামকরণ নিয়ে তুচ্ছ দ্বন্দ্বের চেয়ে ঢের বেশি কিছুই। এটা প্রমাণ করে যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জনগণের যে সংবেদনশীলতা, তা কতটা পরিবর্তন করেছেন! যে দেশ আগে অগ্রগতিকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে কতটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে তার প্রেক্ষিতে পরিমাপ করত নিজেকে, এখন সেই দেশ তার নিজস্ব ক্ষমতা এবং রুচি সম্পর্কে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। আ-বিশ্বের জন্যও, এটি একটি পুনরুজ্জীবিত, উন্নত ‘ভারত’– যা ‘ইন্ডিয়া’র চেয়ে অধিক উত্তেজনা বহন করে। এবং যা আধুনিক, ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যও।
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এখন ৯০ বছরের। আমাদের একান্ত ইচ্ছা, শতবর্ষ পালনটা ওঁর সঙ্গে আমরা একসঙ্গেই করব। এই যে নাটকের একটা আলাদা সংসার এবং সে সংসারে সদস্যদের সবার মন জুগিয়ে, ভালো-মন্দ বুঝে দীর্ঘদিন ধরে কাজটা সুন্দর করে করলেন রুদ্রদা, সেটা ওঁর আজকালকার হাসি দেখেই বুঝতে পারি।
স্রেফ ফেলুদাকে মেয়ে বানিয়ে দিলেই পলিটিকালি কারেক্ট ট্রেন্ডিং নতুন গোয়েন্দা তৈরি হয় না। তাতে ‘দৃষ্টি’-টা তেমন পাল্টায় না। ‘ছোটলোক’-এর সাবিত্রী মণ্ডল নিজে যেমন মফসসলি আটপৌরে, তেমনই সে তার পরিবারকে সমাজের তামসিকতা থেকে আগলে রাখে, এটাই ভিন্ন মাত্রাটা নিয়ে আসে। কিন্তু সাবিত্রী মণ্ডল যে আবার আসবেন, তার আশ্বাসও তো আমরা পাচ্ছি না।