বাংলাদেশে থাকাকালীন আমার মাওয়াঘাটের পদ্মার ইলিশ থেকে শুরু করে চাঁদপুরের মেঘনার ইলিশ খাওয়ার সুযোগ হয়েছে, আমার ব্যক্তিগত মত, কোলাঘাটের ইলিশের মতো সুস্বাদু আর কোনও ইলিশ নয়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে শেখার, ইলিশকে কীভাবে অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে সাফল্য দেওয়া যায়। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদন কমে ১,৯৯,০৩২ টন হয়ে দাঁড়ায়। যে দেশের ৪০,০০,০০০-এর চেয়ে বেশি মানুষের পরিবার ইলিশ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল, মাছের এইরকম দিগ্পরিবর্তনে দেশের সরকার শিয়রে শমন দেখেছিল। আর কিছু নিয়ম বলবৎ করেছিল তৎক্ষণাৎ– ইলিশ শিকারের জাল, যন্ত্রপাতি, নৌকো আর এলাকা সব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল।
প্রচ্ছদের ছবি: সোমোশ্রী দাস
আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগে কৈশোরের দিনগুলোয় মানুষের সময়ের এত দাম ছিল না, আর আমাদের উত্তর কলকাতায় সময় থমকে থাকত। সেই থমকে-থাকা-সময়ের মধ্যমণি কিছু বয়স্ক মানুষ, যাঁদের কথার মধ্যে পঞ্চাশ বছরের একটা স্প্যান থাকত– তাঁদের কৈশোর থেকে বর্তমান সময় অবধি। তাঁদের কাছে শুনতাম, এঁদের বাবা-কাকারা আপিস ফেরত বাগবাজার হয়ে আসতেন। বিকেল থেকে সেখানে জেলেরা গঙ্গা থেকে ধরা ইলিশ বিক্রি করত– সেই মাছ কিনে হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতেন কর্তারা। এরপরই পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসা মানুষদের নিয়ে বিলাপ শুরু হত আর যেটা ক্রমশ গালাগালের দিকে চলে যেত– এঁরা আসার পর থেকে নাকি সেই গঙ্গার ইলিশ দুষ্প্রাপ্য আর দুর্মূল্য হয়ে গিয়েছে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে দেখেছি ইলিশ এমন একটা মাছ, যা নিয়ে দুই বাংলার মানুষের আবেগের কোনও পরিসীমা নেই। বাঙাল মানে ইলিশ আর ঘটি মানে চিংড়ি– এর চে’ বিভ্রান্তিকর আর ভুল খবর হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই আমাদের বাঙালি সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এমন ঘটি পরিবার দেখেছি বলে মনে পড়ে না, যাদের ইলিশ মাছের নাম শুনে চোখ চকচক নোলা সকসক করে না। তবে ঘটিদের কাছে ইলিশ এক সুস্বাদু মাছের চেয়ে বেশি কিছু নয়– পুকুরে ধরা রুই-কাতলার সঙ্গে ইলিশের নাম নেয় কারণ নদীর মাছের চেয়ে পুকুরের মাছ খেতেই বেশি অভ্যস্ত তারা। পক্ষান্তরে ওপার বাংলা থেকে চলে আসা মানুষজনের কাছে ইলিশ এক আবেগের নাম, যার সঙ্গে মিশে থাকে সেখানকার নদীদের স্মৃতি। সেই নদীতে নৌকো ভাসে, মাঝিরা যে নৌকোর গলুইতে বসে ভাটিয়ালি গান গায়, নৌকোতে ইলিশ রান্না করে খায়। সেই নৌকো যখন গ্রামের ঘাটে এসে বাঁধা হয়, সেখান থেকে ইলিশ পৌঁছে যায় গ্রামের ঘরে ঘরে আর তার সঙ্গে পৌঁছয় দামাল নদীর গপ্প আর মাঝিদের সাহসের লড়াইয়ের কাহিনি– কীভাবে উত্তাল নদীকে জয় করে ইলিশ ধরে তারা, গ্রামের কিশোর-যুবকরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শোনে। নিজেদের দেশের ভিটে ছেড়ে যখন পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দেয়, অচেনা দেশে নিজেদের পায়ের তলার জমি খোঁজার লড়াইয়ে বাজারে ইলিশ মাছ দেখলে মন আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে– কারণ ইলিশ ওদের গ্রামের আত্মীয়, অনেক গল্প আর স্মৃতি জড়িত এই ইলিশের সঙ্গে।
যাঁরা পূর্ব-পাকিস্তানে বড় হয়েছেন এবং যৌবন-প্রাপ্ত হয়ে দেশ ছেড়ে এসেছেন, সেই প্রজন্মের মানুষ প্রায় নেই বললেই হয়। শৈশবে যাঁরা দেশ ছেড়েছেন বা পরবর্তী প্রজন্ম তাঁদের দেশের বাড়ির গল্পের সঙ্গে ইলিশের স্বাদের গল্প শুনেছেন, কিন্তু দেশের বাড়িও যেমন দেখার সুযোগ পাননি, গল্পে শোনা ইলিশের স্বাদও তাঁরা পাননি। বাস্তবে বাংলাদেশে ইলিশের স্বাদের রকমফের আছে। ঢাকার ইলিশের নাম শুনলে অনেকে এখনও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, কিন্তু যাঁরা প্রকৃত ইলিশ-প্রেমী, তাঁরা জানেন ওপার বাংলার সেরা ইলিশ ঢাকার পদ্মায় পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় যেখানে পদ্মা মেঘনায় মিশেছে, সেই চাঁদপুরে। যার জন্যে ঢাকার বা মাওয়াঘাটের ইলিশের চেয়ে চাঁদপুরের ইলিশের চাহিদা অনেক বেশি।
বঙ্গোপসাগর থেকে ইলিশের ঝাঁক পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নদীতে চলে আসে ডিম পাড়তে– আর বাংলাদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ, তাই স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশে বেশি সংখ্যায় ইলিশ ঢোকে। কিন্তু ইলিশ কোনও দাসখত লিখে দেয়নি যে, তাদের বাংলাদেশের নদীতেই ঢুকতে হবে– বিশেষ করে যেখানে তাদের জীবন বিপন্ন– ডিম পাড়তে এসে প্রাণ খোয়াতে নাচার ইলিশের দল বিশ বছর আগে ঝাঁকে ঝাঁকে মায়ানমারের ইরাবতী নদী দিয়ে সেই দেশে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদন কমে ১,৯৯,০৩২ টন হয়ে দাঁড়ায়। যে দেশের ৪০,০০,০০০-এর চেয়ে বেশি মানুষের পরিবার ইলিশ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল, মাছের এইরকম দিগ্পরিবর্তনে দেশের সরকার শিয়রে শমন দেখেছিল। আর কিছু নিয়ম বলবত করেছিল তৎক্ষণাৎ– ইলিশ শিকারের জাল, যন্ত্রপাতি, নৌকো আর এলাকা সব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। সর্বোপরি ইলিশের চারা বা ছোট ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা কায়েম হয়েছিল, বছরের এক নির্দিষ্ট সময় কোনও রকম ইলিশই ধরা যাবে না– এই মর্মে আইন পাশ হয়েছিল আর চারটে নদীকে ইলিশের অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। এই নিয়মগুলো লঙ্ঘন করলে জেল আর জরিমানা– দুটোই হবে। প্রাথমিকভাবে জেলেরা প্রতিবাদ করলেও অচিরেই বুঝেছিল এই নিয়মগুলো মানলে আখেরে তারাই লাভবান হবে। এই নিয়মাবলির সুফল অচিরেই বাংলাদেশিরা পেয়েছে– বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর পাশ্ববর্তী অঞ্চলে ইলিশ প্রজনন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে; ২০১৭ সালে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে ৫,১৭,০০০ টনে পৌঁছে যায় আর বাংলাদেশের জিডিপি-র ১% আসে ইলিশ থেকে।
…………………………………………………………………………..
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ওপর নির্ভর না করে সেখানকার মডেল অনুসরণ করে যদি ইলিশ উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া যায়, কয়েক বছরের মধ্যেই আশা করা যায়, এখানেও পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যাবে– বাংলাদেশ যে বিশ্বের ৮০% ইলিশ জোগান দেয়, সেখানে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ ভাগ বসাতে পারবে। কিন্তু ‘লোভ বড় বিষম বস্তু’! একটা সময় ছিল যখন দুর্গা পুজোর দশমী থেকে সরস্বতী পুজো অবধি হিন্দু বাড়িতে ইলিশ খাওয়া হত না কারণ সেটা ইলিশের প্রজননের সময়- সরস্বতী পুজোয় জোড়া-ইলিশ খেয়ে ইলিশের মরশুম শুরু হত, যা চলত পরবর্তী নয় মাস। এই আচার এখন শিকেয় উঠেছে– এখানকার বাজারে সারা বছর ইলিশ পাওয়া যায়– খোকা ইলিশ অবধি হাজারে হাজারে বিক্রি হয়।
…………………………………………………………………………..
বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় এলে সাংবাদিকরা ইলিশ চাষের সাফল্য নিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালে তিনি স্মিত হেসে জবাব দেন যে, তিনি যেটা করেছেন, পশ্চিমবঙ্গও করতে পারে– কারণ এখানেও ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসে। তিনি এ-ও বলেন যে এই মডেল গোপনীয় কিছু নয়– তিনি এখানকার সরকারকে এই মডেলের পুরো রুট-ম্যাপ দিয়েছেন। এখানেই আমরা হোঁচট খেয়েছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ওপর নির্ভর না করে সেখানকার মডেল অনুসরণ করে যদি ইলিশ উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া যায়, কয়েক বছরের মধ্যেই আশা করা যায়, এখানেও পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যাবে– বাংলাদেশ যে বিশ্বের ৮০% ইলিশ জোগান দেয়, সেখানে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ ভাগ বসাতে পারবে। কিন্তু ‘লোভ বড় বিষম বস্তু’! একটা সময় ছিল যখন দুর্গা পুজোর দশমী থেকে সরস্বতী পুজো অবধি হিন্দু বাড়িতে ইলিশ খাওয়া হত না কারণ সেটা ইলিশের প্রজননের সময়- সরস্বতী পুজোয় জোড়া-ইলিশ খেয়ে ইলিশের মরশুম শুরু হত, যা চলত পরবর্তী নয় মাস। এই আচার এখন শিকেয় উঠেছে– এখানকার বাজারে সারা বছর ইলিশ পাওয়া যায়– খোকা ইলিশ অবধি হাজারে হাজারে বিক্রি হয়। বাংলাদেশের ইলিশ কি গঙ্গার ইলিশের চেয়ে বেশি সুস্বাদু? বাংলাদেশে থাকাকালীন আমার মাওয়াঘাটের পদ্মার ইলিশ থেকে শুরু করে চাঁদপুরের মেঘনার ইলিশ খাওয়ার সুযোগ হয়েছে, আমার ব্যক্তিগত মত, কোলাঘাটের ইলিশের মতো সুস্বাদু আর কোনও ইলিশ নয়। সদিচ্ছে থাকলে উপায় হয়, স্বাবলম্বীও হওয়া যায়, তবে তার জন্য লোভ সংবরণ করা দরকার আর ইলিশ নিয়ে কিছু আইন বলবৎ হওয়া দরকার, যে আইন না মানলে শাস্তির ভয় থাকবে। সেটা না হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ইলিশ আমাদের রাজ্যে শুধু দুর্মূল্যই হবে না, দুষ্প্রাপ্যও হয়ে যাবে।
…………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………………
কিন্তু কেন আমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলাম? কেন তাকে পিটিয়ে মারার আগে খেতে দিলাম? কী জানি, একেক সময় মনে হয়, পথের ধারে যে মাংসর দোকানের সামনে দিয়ে আমরা যাতায়াত করি আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, সেখানেও কাটার আগে পাঁঠাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দেওয়া হয়।