সত্যি বলতে, যাদবপুর চত্বরে যারা, তাদের কাছে এইট-বি এক অবশ্যম্ভাবী প্রথা। না-পালনে বিষাদ নামে। অথচ নির্দিষ্ট কেউ যে অপেক্ষায় থাকবে, তা নয়। এইট-বি ভেঙে ধোপদুরস্ত হওয়ার পর বুঝলাম, সেই পুরনো গাছটাই বুঝি আমাদের অপেক্ষা করত। কিংবা ছেড়ে যাওয়ার আগে বাসগুলো। কিংবা এইট-বি নিজেই। প্রাণের এই অফুরন্ত পানীয় সেই-বা আর পাবে কোথায়!
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
৬.
মেসতুতো ভাই-দাদা অতএব আমরা জনাকয় জুটে গেলাম জীবনের প্রচুর ভাঁড়ারে। ব্লাড ইজ থিকার বলে-টলে কারা যেন প্রবাদ বানিয়েছিল। তবে, মেসের দেওয়ালে দীর্ঘকাল না-তোলা ঝুলে থাকা মশারিরা আমাদের বলল, এইসব প্রাচীন এবং অর্বাচীন প্রবাদকে ধিক্কার জানানোই আশু কর্তব্য। তাছাড়া মেসের ভ্রাতৃত্বে কোনও শরিকিবিবাদ নেই। ক্বচিৎ সাবান কিংবা শ্যাম্পু নিয়ে বিবাদ যদি বেধেও থাকে, রবিবারে মাংসের পিসে ইস্যুভিত্তিক সমর্থন দেওয়ার পূর্ণ সুযোগ তো থাকছেই। সুতরাং ‘একক ছাদের নিচে, কাছাকাছি, সংঘমিত্র হয়ে/কিছুকাল’ থাকা শুরু হল পুরোদমে। আর তত বেড়ে যেতে থাকল দেশের বাড়ি যাওয়ার গ্যাপ।
কাছাকাছি বাড়ি যাদের তাদের প্রতি সপ্তাহেই দেশের বাড়ি যাওয়ার কথা। গোড়ার দিকে তা শাস্ত্র মেনে পালনও করা হয় বটে! তখনও গায়ে পুরনো মাটির গান লেগে আছে। মনকেমন। এদিকে শহরে নতুন গিয়ে ছেলেপুলে যে ক্রমশ লায়েক হচ্ছে, তা দেখে বাড়ির বড়রা খুশি হতেন। পাড়াপড়শিরাও, অন্তত প্রকাশ্যে। বাংলা সিরিয়ালের মতো সবাই তো আর দরজা খুলে গুপ্তকথা বলতেন না। ফলে, আড়ালের কথা আড়ালেই থাকত। এবং তাতে একরকম সুখ-ই ছিল। ঈর্ষার ছুরিটুরিগুলো তখনও অন্তত আমাদের ফালাফালা করতে পারেনি সহজে। তাই যে-পাড়ার রাস্তায় হাফ প্যাডেল, বড় উঠোনের মাঠে ক্রিকেট-ফুটবল, যে-বাড়ির দুয়ারে বসে সব একসঙ্গে সৌরভ গাঙ্গুলির কলার-তোলা বিকেল, সেখানে ফিরে ফিরে যেতে মন্দ লাগত না। মনে হত, মাটির সেই আকাশের ভিতর নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পাওয়ার একটা অবকাশ মিলেছে। অল্পবয়েসিদের একটু সমীহ করে তাকানো। বন্ধুদের মধ্যে গল্প ভাগাভাগি করে নেওয়ার মধ্যে উত্তেজনা যথেষ্ট। কে কতখানি কলকাতা চিনেছে, উপপাদ্য সেইটেই, এবং সকলেই যে শহরের এক্সট্রা সল্ভ করেছে দক্ষতার সঙ্গে, তা মোটামুটি প্রমাণ করে দেওয়া যেত।
তখনও শহরের ষড়যন্ত্র পুরোপুরি পড়তে পারা যায়নি। বোঝা যায়নি যে, গঙ্গার এপার-ওপারে আদতে কোনও সেতু নেই। যা আছে, তাতে বাস চলে। টোল ট্যাক্সও দেওয়া হয়। তবে, সবথেকে বড় টোল দিতে হয় স্মৃতির কাছে। স্মৃতির এযাবৎ ভিটে থেকে যে ক্রমশ উৎখাত হতে হচ্ছে, আর তাই তার কাছে ফিরে যাওয়ার সুখ একরকম দশমী, তা জানাতে কোনও নীলকণ্ঠ সেদিন উড়ে আসেনি। যতদিনে বোঝা গেল, ততদিনে শহর আকণ্ঠ পান করে ফেলেছে আমাদের। আর সেই শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল হয়ে আছে মেস। সে এমন কুহকিনী যে, ফি-হপ্তায় ফিরে এসে গল্প শুনতে শুনতে মনে হয়, অমরাবতীর তো কোনও প্ল্যাটফর্ম টিকিট হয় না। সেখানে থাকতে গেলে কিছু ছেড়ে দিয়ে তবেই থাকতে হয়। অতএব ক্রমশ নিজেকেই ফেলে রেখে এগোনো।
যাদের দূরে বাড়ি, তাদের এই হপ্তাশেষে দেশের বাড়ি যাওয়ার বিলাসিতা নেই। দু’মাসে তিন মাসে একবার, বড়জোর। সেইসব যাযাবরের দল অতএব এসে জুটে যায় কোনও এক মেসের তাঁবুতে। কলকাতাতেই কাছেপিঠে যাদের ভদ্রাসন, তারাও এইসব গোধূলিসন্ধির নৃত্য উপেক্ষা করতে পারে না। সন্ধেগুলো জমে ওঠে রকমারি কিস্সায়। পাড়ার আড্ডা ততদিনে গায়েব হয়েছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ভারচুয়াল আড্ডা জাঁকিয়ে বসবে মগজে। মধ্যিখানে মরুদ্যান হয়ে থাকল মেসের আড্ডা। তার অনেকটা জুড়ে থাকে পূর্বাশ্রমের গল্প। কে কেমন ছিল– কতখানি গাধা কিংবা চালাক– মেস বলল, সব কিছুতেই অনর্গল হও। নিজেকে খুলে দাও। ইস্ত্রি করা পরিপাট্যের কোনও বালাই নেই। এ জীবন তোমার এবং তোমারই। ফলে কীসেরই বা লোকদেখানো দায়! পলিটিক্যাল কারেক্টেনেস সুতরাং বাপি বাড়ি যা।
আমরা বুঝে নিলাম, সিকি-আধুলির পিছনে লাগা এই জীবনের মাধুর্য খানিক আলাদা-ই। চেনা তল্লাটে আড্ডা দেওয়ার মতো নয়। সেখানে যতই আড়াল খোঁজা হোক না কেন, পিছনে পরিবারের একটা ছায়া থেকেই যায়। অর্থনৈতিক অবস্থারও। এদিকে মেস তো সব বেডের ভাড়াকেই এক রেটে বেঁধে দিয়েছে। ফলত, এইসব আড্ডা মেজাজমর্জিতে একেবারে ডিক্লাসড। আড্ডা যত গড়ায়, তত আমরা আবিষ্কার করি অন্যদের। অন্যদের এক্স এক্সিসে রেখে ওয়াই-তে নিজেদের ফেলে নিই মনে মনে। রাখঢাক কোথাও বিশেষ নেই। এ-আমির আবরণ সরিয়ে দেওয়ার সে এক জম্পেশ অনুশীলন। কার্যত বোঝা যায়, বুকের ভিতর বইতে থাকা বয়ামের ভিতর থেকে নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে না ফেললে ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’য় পৌঁছনো যায় না। মেসের আড্ডার গুণই হল, ব্যক্তিকে অস্বীকার না করেই সে ব্যক্তিগত আলগুলো ভেঙে দিতে থাকে। অতএব অবাধ জল-চালাচালি। প্রাণের সঙ্গে প্রাণ না মিশলে জোয়ার আসে না। আরও পরে কাজের জীবনে ঢুকে জানব, এই জোয়ার কত কঠিন। যা একদিন ছিল অনায়াস, তাকে পরে বহু আয়াসে আর পাওয়া যায় না। মেসের গায়ে ছিল চাঁদের টান।
……………………………………………………
পিনকোড পেরনো বাংলায় একটা সিনেমার পোস্টারের নিচে সচরাচর একটিই হলের নাম লেখা থাকে। ধরা যাক, ‘ধুম’ লেগেছে ‘রূপকথা’য়। রিকশা-ভ্যানে হেঁকে হেঁকে একটা লোক সে-কথা বলে যেত। আর ইট-পাতা রাস্তায় তখন অকালবসন্ত; শুকনো পাতার মতো ঝরে ঝরে পড়ছে সস্তার কাগজের রঙিন লিফলেট। এক সিনেমা তিন হলে চলছে, এমনটা আর হত কই! কিন্তু কলকাতা তো কলকাতাই। প্রিয়া, বসুশ্রী, মেনকা কাদের নাম– তা আর উদ্ধার হল না।
……………………………………………………
এখন যারা দেশের বাড়িতে রাত কাটিয়ে ফিরল, তারা তো অনেকটা পিছনে। পরদিন গল্প শুনতে শুনতে মনে হয়, বাড়ির সেই একলা ঘর আর আমার দেশ নয়। বরং আমাদের মুক্তি লেখা আছে সমাবেশে। যৌথ জীবনের এই খামারে। বাড়ি ফেরার নিয়মিত অন্তর তাই বেনিয়ম হয়ে পড়ে। মেস যত জমাট বাঁধে, শহর তত গিলে ফেলে গ্রাম-মফস্সলকে। কিন্তু সেদিন কেই-বা তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ভেবেছে! শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো আমরা তো আবিষ্কার করছি, কলকাতা সেই আজব শহর যেখানে অটো চড়ে লর্ডসে যাওয়া যায়। অথচ বেহালার সৌরভ গাঙ্গুলির লর্ডসে কামব্যাক– সে কত সুদূরের গল্প। আমরা প্রশ্ন করছি, মেনকা, প্রিয়া, বসুশ্রী কাদের নাম? কাদের বাড়ির মেয়ে তাঁরা? খুব কি সিনেমাপাগল ছিলেন, যে প্রতি সিনেমার পোস্টারে তাঁদেরই নাম!
পিনকোড পেরনো বাংলায় একটা সিনেমার পোস্টারের নিচে সচরাচর একটিই হলের নাম লেখা থাকে। ধরা যাক, ‘ধুম’ লেগেছে ‘রূপকথা’য়। রিকশা-ভ্যানে হেঁকে হেঁকে একটা লোক সে-কথা বলে যেত। আর ইট-পাতা রাস্তায় তখন অকালবসন্ত; শুকনো পাতার মতো ঝরে ঝরে পড়ছে সস্তার কাগজের রঙিন লিফলেট। এক সিনেমা তিন হলে চলছে, এমনটা আর হত কই! কিন্তু কলকাতা তো কলকাতাই। প্রিয়া, বসুশ্রী, মেনকা কাদের নাম– তা আর উদ্ধার হল না। তবে আমরা তাদের খোঁজ পেয়ে গেলাম। এক-এক ছুটির সন্ধে অতএব সেখানেই।
আর কিছু না হলে আছে সাধের এইট-বি। সে এক ভাঙাচোরা মায়াবী বন্দর। জাহাজের খোঁজ নেই। তবে স্টোকারের ভিড় লেগেই আছে। দু’-চার কাপ লেবু চায়ে ম্যাড়মেড়ে আলোর দিকে তাকিয়ে কয়েক ঘণ্টা অনায়াসেই কাটিয়ে দেওয়া যেত। এদিক ওদিক খোপ খোপ কেটে আড্ডা দেওয়া ছেলেমেয়ের দল। সকলেই সকলের দিকে আড়চোখ, বেশ কয়েকবার, এবং চোখাচোখিও। আধো অন্ধকারে দৃষ্টির অক্ষর ভাগ্যিস পথ হারায় না। কাছেপিঠেই দিনের কফি হাউসের ভাঙা আড্ডার আর-এক প্রস্থ চলছে ‘স্টোরি’র পাশের গলিতে। সেখানে মূলত বড়দের ভিড়। চা আসে, ফিরে যায় ঠান্ডা কাচের গেলাস। বাজারফেরতা লোকজন, খুচখাচ কেনাকাটা রাস্তার দোকানে। তার পাশে খানিক অন্ধকারে চাতালে জমিয়ে বসা একজনকে ঘিরে জনা পাঁচেক। আলোচনা পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। সাবওয়ে বোধহয় তখন ইঞ্জিনিয়ারের খসড়াখাতাতেই। এইট-বি আর সাবওয়েকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারল কই! স্টেশন রোড থেকে যে প্রাণের স্রোত অনায়াসে রাস্তা পেরিয়ে এপারে চলে আসতে চায়, সে বড় খোলামেলা। গুপ্ত, সুড়ঙ্গের ঘেরাপথ তার তাই কোনওদিনই মনে ধরেনি।
রিকশা-অটো-খুচরো বাজারের ওপর আলগা করে লেগে আছে গরিব হলদে আলো। সে-দিকে একঝলক তাকালে মনে হবে, মস্ত একটা জীবনছবি কে যেন ফ্রেম করে ঝুলিয়ে রেখেছে। আর একটু খেয়াল করলে ভিতরে ভিতরে এই মিনিয়েচারের কাজ জ্যান্ত হবে। আমরা সানন্দে সেই সব রেখা হয়ে থেকে যেতাম এইট-বি পেন্টিং-এ। দিনের পর দিন। এস সি মল্লিক রোড এমন কিছু তো উপহার দিত না আমাদের। লঝ্ঝড়ে অটো যাত্রী খুঁজতে খুঁজতে উড়ে যেত সুলেখার দিকে। ক্লান্ত বাস, হা-ক্লান্ত মানুষ। সন্ধের সেই এইট-বি জুড়ে তবু জীবনের সতেজ স্পর্শ ছিল। আর বাড়ি থেকে দূরে নতুন জীবনের খোঁজে মেসবাসী আমরা প্রাণপণে ছুঁয়ে থাকতে চাইতাম সেই স্পর্শ। ততদিনে আমরা বুঝে গেছি, শুধু আমরা নয়, এই শহরও আমাদের চিনতে চায়। এইট-বি আমাদের শহরের সেই টোল-ট্যাক্স যেখানে আমরা বহু সন্ধে অকাতরে দিয়ে দিতে দ্বিধা করিনি।
সত্যি বলতে, যাদবপুর চত্বরে যারা, তাদের কাছে এইট-বি এক অবশ্যম্ভাবী প্রথা। না-পালনে বিষাদ নামে। অথচ নির্দিষ্ট কেউ যে অপেক্ষায় থাকবে, তা নয়। এইট-বি ভেঙে ধোপদুরস্ত হওয়ার পর বুঝলাম, সেই পুরনো গাছটাই বুঝি আমাদের অপেক্ষা করত। কিংবা ছেড়ে যাওয়ার আগে বাসগুলো। কিংবা এইট-বি নিজেই। প্রাণের এই অফুরন্ত পানীয় সেই-বা আর পাবে কোথায়!
………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………….
কলকাতা আর মেস দুই-ই যখন নেশা হয়ে গেল, দেশের বাড়ি তখন ক্রমশ সুদূর। টান কমেছে। তখন বোঝা যায়নি, আসলে নিজের মতো করে একটা দেশের বাড়ি ততদিনে আমরা স্মৃতির ভিতর বানিয়ে ফেলতে পেরেছি। আমাদেরই বলা গল্পে গল্পে সে ফ্রিজ শট। বদল আসে, আসতেই থাকে। কিন্তু মন মানতে চায় না। যত যাতায়াত কমে, তত সেই গল্পের বাড়িটাকে আমরা আঁকড়ে ধরি। মেস আশ্রয় দেয় আমাদের বর্তমানকে। যাঁরা আজীবন নিজের বাড়িতেই থাকেন, তার বদলের সঙ্গে নিজের রক্ত-অস্থি-মজ্জা বদলে নেন, তাঁদের বুকপকেটে এরকম একটা দেশের বাড়ি থাকে না। মেসের বাড়ি না থাকলে দেশের বাড়িকে ঠিক চেনাও যায় না। যেমন চেনা যেত না থেমে যাওয়া সরু ইট-পাতা একটা রাস্তাকে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। গুটিগুটি পায়ে তাঁর দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে যাবে একটা ছেলে। বাঁক ঘোরার আগে সে আর একবার ফিরে তাকাবে। যুবকবেলায় মিলিয়ে যাওয়ার আগে তাকাবে শৈশবে, কৈশোরে। দেখবে, বৃদ্ধার ডান হাতটি তোলা। বিদায় কিংবা আশীর্বাদে। আজও জানা নেই। সেই থেমে থাকা রাস্তা কখনও বলেনি, বৃদ্ধার চোখে সেদিন জল ছিল কি-না।
শুধু ওই ছেলেটি আর কখনও সেই রাস্তায় দেখতে পাবে না তার ঠাকুমাকে।
…পড়ুন মেসবালক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৫। মেসে থাকতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিছানা আর বেডের মধ্যে বিস্তর তফাত
পর্ব ৪। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কখনও মেসে থাকেননি
পর্ব ৩। মেস আসলে জীবনের ক্রিকেট-সংস্করণ
পর্ব ২। আদরের ঘরের দুলালদের সদর চেনাল মেস
পর্ব ১। মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না