একসঙ্গে বসে না-খেলে সম্ভবত মানুষে পাশের মানুষের মনের হদিশ পায় না। স্বাদের ভিতর সম্পর্কের একখানা সাধের দরজাও বুঝি রাখা আছে! আমরাও ওই ঘুপছি হোটেলে হোটেলে খেতে খেতে সেই দরজা খুঁজে পেলাম। বাজি রেখে বলা যায়, ডালে ফ্যান-হলুদের মিশেল কিছু কম ছিল না। আর আলুপোস্তয় চালমগজই দেওয়া থাকত। তবে তা নিয়ে মগজে গজগজানি থাকত না! এক চত্বর বলে সব হোটেলেই খাবার উনিশ-বিশ। কেউ কেউ শুধু চালে একটু ফারাক আনতেন। তুলনায় সামান্য সরু চাল আর গন্ধরাজ লেবু দিয়ে মাত করে দিতেন। তবে, মোদ্দা বিষয় হল ওটুকু দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে কেউ তেমন বিশেষ মাথা ঘামাত না। রুটির সঙ্গে পেঁয়াজ-লঙ্কা না চাইতেই পাওয়া যেত।
৭.
তেলে-জলে মিশলেও মেশে কি-না জানি না, মেসে তবু ছেলে-মেয়ে কিছুতেই মিশবে না। ঘি-আগুনের প্রাচীন প্রবাদ। মেসমালিকরা ফলে কোনও রিস্ক নেন না। তাঁদের জেদে মেসবাসী পুরুষ মূলত জীবনকয়েদে। না জামিন, না রায়, যামিনী শুধু বহিয়া যায়!
পিতৃতন্ত্রের শেকড়বাকড় নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা অনায়াসে মেসমালিকদের মন নেড়েচেড়ে দেখতে পারেন। বিংশ, একবিংশ সব সেখানে দুগ্ধপোষ্য। ঘাপটি মেরে খাপটি খুলে বসে আছে সেই প্রাচীন উনিশ শতক। সায়েবের চাকরি আনে ক্লান্তি। দোষ কার? কেন, ঘরের বউয়ের। সে-ই তো সোনাদানা চায়। তার ওপর কাচ্চাবাচ্চা। এই অসুখে মধ্যবিত্ত ক্লান্ত। অমৃত কে দেবে? কথায় উপশম দিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ। মধ্যবিত্তের ঘরে আজও তাঁর অক্ষয় ছবি। আর সেই উনিশ শতকীয় মন। যে পুরুষ কিনা সেই ক্লান্তিকর চাকরি পেতেই ব্রহ্মচর্য পালনে নেমেছে, তার নারীমুখ দর্শন মেসের শাস্ত্রে অনুমোদিত নয়।
অতএব, যে কোনও মালিকপক্ষের মতোই তাঁদেরও বুর্জোয়া ফতোয়া– পুরুষপ্রধান মেসে যেন তরুণীতন্বীকোমলছায়া না পড়ে। সরস্বতী পুজোর আগে কুল আর মহিলাস্পর্শে মোহব্বতের গুরুকুল, দুটোতেই গেল গেল ভাব। বোঝো বাওয়াল! ওদিকে রাহুল অঞ্জলিকে বুকে জড়িয়েও টিনার হাত ছাড়ছে না। ঐশ্বর্যের ভূত এলে অচিনপুরে উড়ে যাচ্ছে চিনার পাতা। আমিশা প্যাটেলের জন্য দু’বার জন্ম নিতেও রাজি হৃত্বিক রোশন। বিপাশা বসু, তনুশ্রী দত্ত নামক ঘটমান ইশারাময় বর্তমানে আমরা চঞ্চল হে! ঢাকুরিয়া লেকের ধারের অন্ধকার মৌচাক-এর বাঘ-ছাগলকে এক ঘাটেই জল খাওয়াচ্ছে। ‘তিন ইয়ারি কথা’ রিলিজ না করেও চালান হচ্ছে কম্পিউটরে কম্পিউটরে। চন্দ্রিল বানিয়ে ফেলেছেন ‘Y2k: সেক্স ক্রমে আসিতেছে’। সেখানে শ্রীলেখা মিত্র আর রজতাভ দত্ত তাঁদের দারুণ স্বাভাবিক অভিনয়ে আমাদের এত অস্থির করে তুলছেন যে, স্থির হয়ে বসে দেখাই দায়! আর কিছুদিন পরেই আসবে ‘ছত্রাক’, তার খানিক পরে ‘গান্ডু’, তবু, মেসমালিকদের মন বদলায়নি। মা-বাবাও তাঁদেরই স্থানীয় অভিভাবক সাব্যস্ত করেছেন। সাবেকিয়ানা আর ক্লাসিকায়ানার মোহে মালিককুল বোধহয় জানতেন, স্থানীয় সংবাদ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নেই; তথাপি, দু’দণ্ডের বিশ্বম্ভর রায়।
আমরা তো এদিকে হোম-ডেলিভারিকে বিদায় দিয়ে ততদিনে ভাতের হোটেলে বেঞ্চি বুক করে ফেলেছি। যে কোনও মেসতীর্থেই ধীরে জেগে ওঠে এই সব হোটেল। তাদের হোটেল বললে বড় পাঁচ-সাত তারা-রা কুপিত হতে পারে। না বললে, আমাদের সম্মানে লাগে। স্কুলের হাই বেঞ্চের মতোই খানকয় চওড়া বেঞ্চি পাতা। প্রতি বেঞ্চে জনা তিনেক করে বসতে পারে, এদিক ওদিক মিলিয়ে ছয়-নয়। দোকানের দু’-দিক মিলিয়ে গোটা চারেক এরকম বেঞ্চি-টেবিল, প্রতি খেপে কুড়ি-পঁচিশ জনের খাওয়ার চিন্তা মিটবে। মুখ ধোয়ার বেসিন থেকে নিকটবর্তী টেবিলের দূরত্ব বড়জোর হাতখানেক। তবে, আমরা জানি জীবনে ঘেন্নাপিত্তি মিথ্যে ভিত্তিহীন। বাকি থাকল হাইজিন। তাতে হাতে রইল জেলুসিল কিংবা ডাইজিন। যাদবপুর পালবাজার চত্বরেই এরকম গোটা তিন-চারেক হোটেল আছে। সবগুলোই চলে রমরমিয়ে। আমরা পরীক্ষা প্রার্থনীয় জ্ঞানে প্রতিটায় একদিন করে খেয়ে-দেয়ে অবশেষে একটিতে থিতু হয়ে গেলাম। তার এক নম্বর কারণ, মাছ দেখে খেদ করে বলতে হয় না যে, তেরা ক্যায়া হোগা রে কালিয়া!
দ্বিতীয়ত, দোকানে থাকত দুই ভাই। ছোটটি প্রায় আমাদেরই বয়সি। নাম মিঠুন। ধবলকান্তি। চিকনাই কার্তিক গোঁফ। মাঝে মাঝে হাত বুলোয়। তার সঙ্গে আমাদের বেশ দোস্তি হয়ে গেল। মিঠুনের মস্ত গুণ যে, টাকা-পয়সা নিয়ে তার কোনও দরাদরি ছিল না। খাও-দাও, কলেজ যাও। হিসেবখাতায় সব লেখা থাকছে। মাসের শেষে কিংবা পরের পয়লায় দিয়ে দিলেই হল। তার দাদাও মিঠুনের বন্ধুজ্ঞানে আমাদের নেকনজরেই দেখতেন। আমরাও বড়মুখ করে বলতাম, বড়দা। ফলে সকালের ভাত, রাতের রুটি নিয়ে আমাদের কোনও ভাবনা ছিল না। ছুটির দিনে রোববারে আয়েশিপনা এবার ধাতে ধরতে শুরু করলে। আড়াইটে না-বাজলে কেউ চানে যায় না। রাতে একে অন্যের খাবারটা তুলে আনে। আজকে এ চিলি চিকেন নিলে কালকে আর-একজন। ফলে সবারই ভাগ্যে এক পিস করে জোটে। বার্ড ফ্লু বলে ফ্লুকে সস্তার চিকেন হিট হয়ে গেল। পৌষমাস আর সর্বনাশের গপ্পোখানা সেবার তারিয়ে তারিয়েই বোঝা গেল।
এক পাতে খাওয়ার বায়না করে ছোটরা। যাকে ভালোবাসে– কাকা, পিসি, মাসি– তার থালাতেই খাবে। মেসে এসে হাতেপাতে প্রমাণ মিলল যে, প্রতিবার ভাগ করে খাওয়ার সমান ও বিপরীত ভালোবাসা আছে। নিউটন অবশ্য তা জানতেন না। বাঙালি ঘরকন্নাতেই তা স্বতঃসিদ্ধ। রান্নাপুজো এখনও চালু আছে অনেকের বাড়িতেই। পান্নার দিনে পরস্পর পরস্পরকে নেমন্তন্ন করে আসে পাড়ার মানুষ। প্রায় সব ঘরেই রান্নাপুজো হয়েছে। তবু, এক বাড়ির মানুষ অন্য বাড়িতে গিয়ে পান্না করে আসে। বিয়েবাড়িতে জমিয়ে খাওয়ার গপ্প তো মাসখানেক পাড়ায় ঘুরে বেড়াত। এছাড়া কোনও কোনও বাড়িতে খাবারের বাটি চালাচালি হত। এমন নয় যে, তাদের ঘর পাশাপাশি। অমুক তালের বড়া খেতে ভালোবাসে বলে পাঁচ বাড়ি উজিয়ে গিয়ে তমুক বাটিভর্তি বড়া দিয়ে আসত। হত এরকম। এখন দেওয়ালে দেওয়াল লেগে থাকলেও ডেলিভারি বয়রা ঠিক ঠিকানাতেই বেল বাজায়। প্রযুক্তি আমাদের নিখুঁত জীবন দিয়েছে। বাকি গল্পগুলো বেমালুম গায়েব। প্রসঙ্গান্তর, তবু না বলে থাকা যায় না। এই দিনকয় আগে সিকিমে গিয়ে দেখি, এক হোম-স্টে-র মালিক দুঃখ করছেন। ফেসবুক এসে হোম-স্টে আর হোটেল এক করে দিয়েছে। ফলে, না কেউ তাঁদের সঙ্গে গল্প করেন, না তাঁদের খাবার খান বা তাঁদের সঙ্গে বসে খান। সবাই হোটেলের সার্ভিস চান বলে তাঁর আক্ষেপ। বললাম, আমরা ওর’ম চাই না। আপনার যা খুশি হয় খাওয়ান। মহানন্দে তিনি তাঁদের স্টাইলে রান্না করা দেশি মুরগির ঝোল আর একটু আঠালো জিরা-রাইস ধরনের ভাত খাওয়ালেন। ঝোলে-তরকারিতে মশলা প্রায় নেই। একসঙ্গে বসে খেতে খেতে বিস্তর গল্প হল। কনকনে ঠান্ডা রাত নেমেছে পাহাড়ে। তবু গল্পের লোভে ফায়ারপ্লেসকে তাঁরা আর একটু জাগিয়ে তোলেন। শেষে অচেনা দুই বন্ধুকে তাঁরা তাঁদের সংগ্রহে থাকা মিষ্টি না-খাইয়ে ছাড়লেন না।
যাকগে, হচ্ছিল সেই খাওয়ার কথা। একসঙ্গে বসে না-খেলে সম্ভবত মানুষে পাশের মানুষের মনের হদিশ পায় না। স্বাদের ভিতর সম্পর্কের একখানা সাধের দরজাও বুঝি রাখা আছে! আমরাও ওই ঘুপছি হোটেলে হোটেলে খেতে খেতে সেই দরজা খুঁজে পেলাম। বাজি রেখে বলা যায়, ডালে ফ্যান-হলুদের মিশেল কিছু কম ছিল না। আর আলুপোস্তয় চালমগজই দেওয়া থাকত। তবে তা নিয়ে মগজে গজগজানি থাকত না! এক চত্বর বলে সব হোটেলেই খাবার উনিশ-বিশ। কেউ কেউ শুধু চালে একটু ফারাক আনতেন। তুলনায় সামান্য সরু চাল আর গন্ধরাজ লেবু দিয়ে মাত করে দিতেন। তবে, মোদ্দা বিষয় হল ওটুকু দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে কেউ তেমন বিশেষ মাথা ঘামাত না। রুটির সঙ্গে পেঁয়াজ-লঙ্কা না চাইতেই পাওয়া যেত।
আমাদের মেসবাসিন্দা এক দাদা, তাকে ঘনাদা বলেই ডাকব এখানে, এই খাওয়ার আনন্দকে আর একটু বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে তার ডেবিট কার্ডটা দিয়ে দিয়েছিল মিঠুনকে। পিন-সমেত।
আমরা বললাম, করো কী!
সে বলল, কী আর হবে! আই ডোন্ট কেয়ার।
কেয়া বাত বলতে পারলেই ভালো হত! তবে এ কি কেয়াপাতার নৌকা গড়ে ফুলে সাজিয়ে তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেওয়ার জিনিস! তাছাড়া টাকাপয়সার প্রতি এমন কথামৃত-উদাসীনতা তো সচরাচর দেখা যায় না। ব্যাপারটা আমাদের কাছে খোলসা হল আরও কিছুদিন পরে। ওই যে মন-খোলা অনুশীলনের কথা হচ্ছিল, তার দৌলতেই। ঘনাদা পড়াশোনার জন্য কলকাতায় চলে আসেনি। তার বাড়িতে একটা অশান্তি চলছিল দীর্ঘদিন। সে মাতৃহীন, উপরন্তু বাবার সঙ্গে বিবাদ। একটা পালানোর পথ খুঁজছিল। তার বাড়ি, তার চারপাশ থেকে। বাড়ি ছাড়তে না-পারলে সেই মুহূর্তে যে কী করে ফেলত বলা মুশকিল! আমরা অবাক হয়ে তার কথা শুনি। যারা বাধ্যত বাড়ি ছেড়েছি। ছাড়ার দুঃখও ছিল। সেখানে এ তো একেবারে উলটপুরাণ।
আরও জানা গেল, ঘনাদার প্রেমিকা এসেছে কলকাতায় পড়তে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই সুযোগে সে-ও এসেছে বাড়ি থেকে পালিয়ে। দেশে ছোটখাটো ব্যবসা আছে তার। ফোনে-ফোনে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে আপাতত। আর শেয়ার ইত্যাদিতেও তার আগ্রহ। সুতরাং একেবারে যে বেকার বসে আছে, তা নয়। আর এই কারণেই জীবন সম্পর্কে সে সামান্য উদাসীন, টাকা-পয়সা নিয়েও। নতুনদা বলল, যে-ছেলে ব্যবসা করে সে লাভ-লোকসান নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। সুতরাং আমাদের অতিরিক্ত চিন্তার কিছু নেই। তবে, সবথেকে বড় কথা মিঠুন। ঘনাদার এই গল্প সে-ও জানত। কার্ড দিতে চেয়েছিল, সম্ভবত নিয়েও রেখেছিল। টাকা তো তোলেইনি, ঘনাদার থেকে তো বটেই, আমাদের থেকেও টাকা চায়নি। আমরা নিজেরাই গিয়ে খাতা খুলে হিসাব মিলিয়ে দিয়ে এসেছি। সে হোটেলের এখন চেহারা পাল্টেছে। মিঠুনেরও। তবে, বহু বছর পর আমাদের একবার দেখা হওয়ার পর বুঝলাম, পরস্পরকে দেখে সেই অনাবিল হেসে ওঠা আমাদের বদলায়নি।
ঘনাদা আমাদের মেসটা জমিয়ে দিয়েছিল। জীবনের অশান্তি থেকে পালিয়ে শুধু ভালোবাসার টানে ডানা ভেঙে এসে কেউ কলকাতায় পড়েছে, এমনটা আমরা আগে কখনও শুনিনি। প্রেমের এমন মেধাবীভূতের সঙ্গে আগেও দেখা হয়নি, পরেও না।
একদিন তার টানে টানেই মাধবীলতার ছায়া পড়ল আমাদের মেসের দরজায়।
…পড়ুন মেসবালক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬। মেসের বাড়ি না থাকলে দেশের বাড়িকে ঠিক চেনা যায় না
পর্ব ৫। মেসে থাকতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিছানা আর বেডের মধ্যে বিস্তর তফাত
পর্ব ৪। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কখনও মেসে থাকেননি
পর্ব ৩। মেস আসলে জীবনের ক্রিকেট-সংস্করণ
পর্ব ২। আদরের ঘরের দুলালদের সদর চেনাল মেস
পর্ব ১। মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না