ওরা পাঁচজন। রকে বসে। আড্ডা মারে। জানতে চায়, বাংলা ভাষা ধ্রুপদী হল কেন? ধ্রুপদী ব্যাপারটাই বা কী! নিত্যানন্দবাবু বাংলার শিক্ষক। তিনি ধরিয়ে দিচ্ছেন বারেবারে, কী ধ্রুপদী, বাংলাভাষার ধ্রুপদীত্বটুকু কোথায়, কাদের কাজে বাংলাভাষা এত গৌরবময় হয়ে উঠল। সেই ইতিহাস, সেই শিক্ষা কি রকের এই পাঁচ প্রায়-বিনয়ী ছোকরা গ্রহণ করতে পারল? কোথায় পৌঁছনো গেল?
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
কলকাতার মধ্যে অনেক কলকাতা আছে বলেই রক এখনও ওঠেনি। রোয়াকটি বেঁচে। বেঁচে থাকলে লোক বসে, কুকুরও আসে, মাঝে মাঝে প্রোমোটার জুলজুল করে চায়– তবে কলকাতা উত্তরকে এখনও পুরোটা বাগে আনার মতো মুরোদ বাঙালি-অবাঙালি কোনও প্রমোটারেরই হয়নি। হবেও না। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী আখ্যা দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রী পুজোর আগে এক্স হ্যান্ডেল ঠেললেন, মুখ্যমন্ত্রীও পিছিয়ে রইলেন না।
রোয়াকের পাঁচমূর্তি খবরটা ফেসবুকে দেখেছিল। তার অর্থ বড় বোঝেনি। ধ্রুপদী যে ক্ল্যাসিকালের বাংলা এটুকু তারা জানে, বাকিটা ধোঁয়া-ধোঁয়া। সে ধোঁয়া খানিক পরিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল শেষ বিকেলে। পাড়ার গলির মুখে সবে তখন কড়ায় চপ পড়ছে। তেল বুড়-বুড়ি কাটছে। লাইন জমছে। এই শরতেও বৃষ্টি। আলু উঠলেই মোচা, মোচার পর পেঁয়াজি। মাঝে পেঁয়াজি আউট অফ সিন ছিল। পেঁয়াজের দাম আগুন, তার বদলে বেগুন ল্যান্ড করেছিল। তবে পেঁয়াজ ইজ পেঁয়াজ। এখন ফিরেছে। তেলেভাজা ডিঙিয়ে নিত্যানন্দবাবু আসছেন। পাঁচমূর্তি জানে ধোঁয়া এইবার কাটবে। নিত্যানন্দবাবু নাকি তাঁর ভব্যতা-সভ্যতা ‘আনলার্ন’ করতে চান তাই পাঁচমূর্তির রোয়াকবাজিতে নাম লিখিয়েছেন। আনলার্ন-টানলার্ন এসব রোয়াকের পঞ্চভূতেরা বোঝে না। শুধু বোঝে নিত্যানন্দ স্যর বুড়ো, বাংলার মাস্টার হলেও মাই ডিয়ার ম্যান।
এক নম্বর বলল, ‘নিত্যানন্দ কামিং। ধোঁয়া উইল কাট।’
দু-নম্বর: ‘অনেকদিন পেঁয়াজি খাইনি। আজ নিত্যানন্দ স্যরের মানিতে খাব।’
তিন নম্বর: ‘আমি আলুও খাব।’
দু-নম্বর: ‘তোর এমনিতেই আলুর দোষ। তার উপরে বাবার ডায়াবিটিস।’
তিন নম্বর: ‘বাবা তুলবি না। বাবা তুলবি না। আমি সহ্য করব না। আমার আলুর দোষ ঠিক আছে। তাই বলে …’
নিত্যানন্দবাবু ঢুকতেই কথা থামল। ‘কী ব্যাপার তোমরা সহসা আলু বিষয়ে কী বলছিলে?’
পাঁচ নম্বর: ‘স্যর ওদের কথা বাদ দিন। আগে বলুন আমার সিম্পিল নলেজে একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না। এই যে বাংলা ক্ল্যাসিকাল না কী একটা স্বীকৃতি পেল এর মানেটা কী? আমরা তো পড়েছিলাম সংস্কৃত ক্ল্যাসিকাল ল্যাঙ্গোয়েজ, প্রায় ডেড। বাংলা মডার্ন। তা সেই বাংলাই আজ ক্ল্যাসিকাল। মানে ডেড। তার মানে কি কাল থেকে আমাদের মডার্ন ইংলিশ বলতে হবে? স্পোকেন ইংলিশের ক্লাসে নাম লেখাতে হবে?’
চার নম্বর: ‘ধুর শ্যালক। ক্ল্যাসিকাল মানে ধ্রুপদী, ধ্রুপদী মানে পুরনো। তার মানে বাংলার সম্মান রক্ষা করার জন্য আমাদের সাধু বাংলায় কথা বলতে হবে। শালা নয় শ্যালক। বাঁ… নয়, তবে কী? কে জানে! কথাটার সাধু বাংলা জানি না।’
নিত্যানন্দবাবু বুঝলেন আনলার্ন করার আগে তাঁকে কিঞ্চিৎ জ্ঞানদান করতে হবে। বাংলা ভাষা সম্বন্ধে এই ‘সিম্পিল’ নলেজের দাপটে কখন কী ঘটে যাবে কিচ্ছু বলা যায় না। তিনি কিছু বলার আগেই অবশ্য পুনশ্চ প্রশ্ন ভেসে উঠল।
এক নম্বর: ‘কিচ্ছু জানিস না, কেশ কোথাকার।’ ‘বাল’ শব্দটির সাধু রূপ যে ‘কেশ’, তা জানা ছিল। তবে কেশের উচ্চারণ কেস হয়ে গেল খানিক। তা হোক। ‘বাংলার আগে পাশের ওড়িয়া ভাষা ধ্রুপদীর তকমা পেয়েছে। ধ্রুপদী হলেই ভাষার জন্য টাকা পাওয়া যায়। আমাদের বাংলায় টাকা আসবে। ফান্ড। তাই না স্যর?’
দু-নম্বর: ‘টাকা পেলে সব মেনে নেবো। আমি কেশ, তুই কেশ, সামনে কেশ, পেছনে কেশ।’ নিত্যানন্দবাবু দেখলেন দু’-নম্বরের উচ্চারণ মন্দ নয়। তিনি রোয়াকে গুছিয়ে বসে বিড়ি ধরিয়ে কথা শুরু করলেন। পাঁচমূর্তির কেউ-ই বিড়ি খায় না, খায় সিগারেট তবে ইদানীং নিত্যানন্দবাবুর টানে মাঝে মাঝে বিড়ি ধরে ও ধরায়। আজ আর বিড়ি চাইল না। মন তাদের পেঁয়াজিতে, কান নিত্যানন্দ স্যরের কথায়।’
নিত্যানন্দবাবু জ্ঞান দিলেন। জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টায় নানা স্তরে সরব হলেন।
‘শোনো পঞ্চভূতের দল আমাদের এই দেশে ভাষা অতি বিষম বস্তু। এতগুলো ভাষার দেশ আর কোথাও খুঁজে পাবে না। ভাষায় ভাষায় আকচা-আকচি। এ-বলে আমি পুরনো, সে বলে আমি পুরনো। এ বলে আমি ঐতিহ্যশালী সে বলে আমিও ঐতিহ্যশালী। এক ভাষা অন্য ভাষার উপরে অধিকার ফলাতে চায়, বড়ত্ব প্রমাণ করতে চায়। এদেশে সাহেবরা আসার ফলে ভারতীয় ভাষাগুলির পরস্পরের সঙ্গে কাজিয়া প্রবল হয়। তার আগে ভাষায় ভাষায় কাজিয়া যে ছিল না তা নয় তবে উপনিবেশের আমলে কাজিয়া প্রবল।’
এটুকু বলে নিত্যানন্দবাবু বুঝলেন তিনি এখনও আনলার্ন করতে পারেননি। বলছেন। পঞ্চভূত শুনছে, তবে কতটা বুঝছে কে জানে। সুতরাং আবার বলতে শুরু করলেন। ফির সে। এবার একটু নরম করে। কে জানে কমিউনিকেট করছে কি না!
‘ধ্রুপদী বা ক্ল্যাসিকাল হতে গেলে প্রমাণ করতে হবে ভাষাটা পুরনো। সাহেবি আমলে বাংলা ভাষার নানা পুরনো নমুনা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তাতে বাংলা ভাষার খুব দেমাক। বাংলা ওড়িয়া, অহমিয়া, হিন্দির থেকে নিজেদেরকে পুরনো ভাষা বলে মনে করত। তাছাড়া বাঙালিরা ইংরেজি জেনে সাহেবদের কাছাকাছি এসেছিল বলে সাহেবদের সাপোর্ট বাংলার দিকে। আসাম আর উড়িষ্যায় স্কুলে বাঙালি মাস্টাররাই তখন সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। তারা বলল অসমিয়া আর ওড়িয়া বালকেরা তাদের ভাষা ছেড়ে বাংলা পড়ুক। রাজি হল না, বাঙালিদের সঙ্গে লেগে গেল। এই ভাষার লড়াই কিন্তু এভাবে সাহেবি আমলের আগে ছিল না। দেশ যখন স্বাধীন হল তখন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে জওহরলাল নেহেরু ভারতের ভাষাগুলির মধ্যে কতগুলি ভাষাকে সংবিধানে বিশেষ স্বীকৃতি দিলেন, অন্য ভাষারা সে স্বীকৃতি পেল না। যারা পেল না তারা রেগে গেল। সংবিধানের স্বীকৃতি পেলে ভাষার উন্নতির জন্য সরকারের টাকা বেশি পাওয়া যায়। হিন্দি ভাষা প্রচারের জন্য সরকার যত টাকা ব্যয় করে রাজস্থানির জন্য তত টাকা ব্যয় করে না। আমার রাজস্থানি বন্ধু দেবলজি একবার পাটিয়ালায় এজন্য আমায় খুব বকেছিলেন। সুনীতিবাবুকে তো হাতে পাচ্ছেন না। সুনীতিবাবুও বাঙালি আমিও বাঙালি। শেষে পাটিয়ালা পেগে রাগ কমল।’
এক নম্বর: ‘আজকে স্যর আপনার লেকচারটা কাফি লম্বা।’
দু-নম্বর: ‘পুরোটা মাথায় ঢুকছে না। ধ্রুপদী ব্যাপারটা এখনও ধোঁয়া।’
নিত্যানন্দবাবু বুঝলেন হচ্ছে না, হচ্ছে না। আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কিন্তু বোঝাতে পারছেন না। সাহেবি আমলের সঙ্গে এখনকার ধ্রুপদীত্বের যোগ বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারছেন না, আবার শুরু করলেন। তিন নম্বর লেকচার।
……………………………………………
আরও পড়ুন বিশ্বজিৎ রায়-এর লেখা: একদিকে বই পোড়ানোর হুকুম, অন্যদিকে নিভৃত গ্রামে খুলে যায় বইয়ের ঘর
……………………………………………
‘বাংলা ভাষা পুরনো ভাষা। বাংলা ভাষার কবি এশিয়ার মধ্যে প্রথম নোবেল পেয়েছিলেন, সাহিত্যে। এই ভাষায় চৈতন্যদেব কথা বলতেন। তিনি সাহেবি আমলের আগে এই ভাষার মানুষদের জাগিয়ে তুলেছিলেন। এই ভাষার সাহিত্য বৈচিত্র অতুলনীয়। এ ভাষার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অপরিসীম। এ ভাষার অতীত সংস্কৃতি নিয়ে নীহাররঞ্জন রায় বই লিখেছেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কাজ করেছেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস লিখেছেন। এই ভাষায় অনেক কাজ করা যায়। তাই এই ভাষা ধ্রুপদী হওয়ার যোগ্য। ভারতের অন্যান্য ভাষার চেয়ে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার লড়াইতে তাই এই ভাষা এগিয়ে আছে, স্বীকৃতি পেয়েছে।’
পাঁচ নম্বর: ‘স্যার এবার একটু একটু বুঝেছি। অনেকে স্যর বাংলায় আগে কাজ কম্ম করেছে। চৈতন্য-রবীন্দ্রনাথ। তাই আমরা পেলাম।’
এক নম্বর: ‘অন্য ভাষা যারা পায়নি, তারা রেগে যাবে।’
দু-নম্বর: ‘জয় বাংলা বলে আমরা এগিয়ে যাব।’
এক নম্বর: ‘আমাদের ইংরেজি বলতে হবে না। সাধু বাংলা বলতে হবে না। যেমন আছি তেমন থাকব। তবে বাংলা ভাষাকে একটু ভক্তি-শ্রদ্ধা করব।’
পাঁচ নম্বর: ‘বাংলা মিডিয়াম স্কুল তুলে দিলে রাত দখল করার জন্য রাস্তায় নামব।’
নিত্যানন্দবাবু দেখলেন হবে না, এর বেশি হবে না। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যাই করুন বাংলা আর বাঙালির অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যাপারটা ঘেঁটে গেছে। আজ এই অবধি। কথা কম পেঁয়াজি বেশি। তেলেভাজার ছেলেটা চপ আর পেঁয়াজি দিয়ে গেল। সবাই ধ্রুপদী ভঙ্গিতে শরতের বর্ষায় বাঙালির প্রিয় তেলেভাজা খেতে লাগলেন।
………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………….
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।