দিনের পর দিন প্রতিবাদে শামিল হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। রাস্তাতেই রান্নাখাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়। খাওয়াদাওয়া ঘিরে রোজকার জীবনের যে অভ্যাস, আচার-আচরণ, সে সবও তখন অনেকটা বদলে যায় এক ধাক্কায়। লেবাননের ত্রিপোলি হোক বা বাগদাদের তাহরির স্কোয়্যার, আন্দোলনের সময়ে মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন মানুষ একই রকম নজির সৃষ্টি করে। পৃথিবী জুড়েই দেখা গিয়েছে, আন্দোলনকারীদের জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষ। খাবারের দোকানিরা দোকান খুলে রেখেছেন সারা রাত, বিনা পয়সায় পেট-ভরা খাবার খাইয়েছেন প্রতিবাদে শামিল সহনাগরিকদের। আজ বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে বিশেষ লেখা।
বেঙ্গালুরুর টাউন হল, গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া, পঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্ত, শাহিনবাগ বা পার্ক সার্কাস– শেষ কয়েক বছরে পথে নেমে প্রতিবাদের অগ্রভাগে ছিলেন মহিলারা। অবিচারের বিরুদ্ধে, অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবিতে ফেটে পড়েছেন ‘অ্যাংরি ইয়াং উইমেন’দের পাশাপাশি সাধারণ ঘরের ‘মা-দিদিমা’রাও। অনমনীয় জেদে তাঁরা দিনের পর দিন কাটিয়েছেন রাস্তায়, অনাচারী শাসকের চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছেন নিজেদের হকের দাবি বুঝিয়ে দিতে, সমাজ বদলের আশায়। এইসব আন্দোলনে অন্দর-বাহিরের সীমারেখা একটু একটু করে মুছে দিতে দিতে ঘরের মেয়েরা অনেকটা সময় কাটিয়েছেন রাস্তায়। তখন কে সামলেছে তাঁদের গৃহস্থালির কাজ, হেঁশেলের দায়িত্ব? পার্ক সার্কাসের এনআরসি-বিরোধী প্রতিবাদে দেখেছিলাম, ঘরের কাজ পালা করে সারতেন পরিবারের মহিলারা। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষেরাও হাত লাগাতেন রান্নাঘরের কাজে, যা মোটামুটি ভাবে ‘মেয়েদের কাজ’ বলেই স্বীকৃত ছিল এতকাল।
দিনের পর দিন প্রতিবাদে শামিল হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। রাস্তাতেই রান্নাখাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়। খাওয়াদাওয়া ঘিরে রোজকার জীবনের যে অভ্যাস, আচার-আচরণ, সে সবও তখন অনেকটা বদলে যায় এক ধাক্কায়। লেবাননের ত্রিপোলি হোক বা বাগদাদের তাহরির স্কোয়্যার, আন্দোলনের সময়ে মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন মানুষ একই রকম নজির সৃষ্টি করে। পৃথিবী জুড়েই দেখা গিয়েছে, আন্দোলনকারীদের জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষ। খাবারের দোকানিরা দোকান খুলে রেখেছেন সারা রাত, বিনা পয়সায় পেট-ভরা খাবার খাইয়েছেন প্রতিবাদে শামিল সহনাগরিকদের। সুদানের আওয়াদেয়া মাহমুদ বা হংকংয়ের মিস্টার চুং এমনই দুই খাদ্য ব্যবসায়ী। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় তাঁদের ভরিয়ে দিয়েছে সমাজমাধ্যম।
শাহিনবাগে শুরু হয়েছিল সমবায় ক্যান্টিন। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষ সেখানে দল বেঁধে হইহই করে রান্না করতেন। সকলে একসঙ্গে খাওয়া হত তারপর। সে এক ভারি জমজমাট ব্যাপার! দেখে হম্বিতম্বি করে যেত পুলিশ, বলত, প্রতিবাদ করতে এসে রাস্তায় লঙ্গরখানা খোলা চলবে না। এ নতুন কিছু নয়। সরকারের বিরুদ্ধে যখন একদল মানুষ জোট বাঁধেন, সাধারণ মানুষও যদি তখন তাঁদের লড়াইয়ের প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা দেখান, তবে ভয় পেয়ে যায় প্রশাসন। প্রতিবাদীদের হামলাকারী, গুন্ডা বা আইনভঙ্গকারী হিসাবে আলাদা করে দেখানো যায় না তখন। সেই কারণেই হংকং-এ কুয়ং উইং কেটারার্স বা লন্ডনে এক্সটিংশন রেবেল কিচেন-এর ওপরে বিষনজর পড়ে সেসব জায়গার পুলিশের। প্রতিবাদস্থলে রান্না করে বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়ানোই তাদের অপরাধ।
এক্সটিংশন রেবেলিয়ন পরিবেশ বাঁচানোর এক আন্দোলন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই আন্দোলনকারীরা সক্রিয়। প্রতিবাদস্থলে তাঁবু খাটিয়ে তাঁরা রান্না করেন ভিগান খাবার। প্রাণীহত্যা এবং মাংস খাওয়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক, এ-ই তাঁদের মত। তাই খাবারের ধরনটিও তাঁদের রাজনৈতিক চয়ন। শাহিনবাগে আবার উল্টো। দেশে ধর্মের ভিত্তিতে হিংসা যখন বেড়ে চলেছে, কে কী খাবে, তা নিয়ে চলছে গুন্ডামি আর দলাদলি, তখন যে আন্দোলন সকলের পাশাপাশি শান্তিতে থাকার পরিসর তৈরি করার কথা বলে, সেখানে কী আর সবাইকে এক রকম খাবার খাওয়ালে চলে? আমিষ-নিরামিষ, বিরিয়ানি-পোলাও-শিঙাড়া, ফলমূল-ফলের রস– সব রকম খাবার নিয়ে হাজির হতেন মানুষ। শামিয়ানা খাটিয়ে সেসব ভাগ করে দেওয়া হত প্রতিবাদীদের মধ্যে। পঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষক আন্দোলন থেকেও মানুষ এসেছিলেন শাহিনবাগে। তাঁরা অনেকে মিলে হাত-রুটি তৈরি করতেন, কড়াইয়ে জাল দিয়ে রান্না করতেন ঘন ক্ষীর। ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা আর প্যাকেট প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে আসতেন মানুষ। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সেসব পরিবেশন করতেন। গ্লাসে চা ঢেলে মাঝবয়সি পুরুষ তুলে দিচ্ছেন মহিলাদের হাতে– এ দৃশ্য তো কতই দেখা গিয়েছে। সেই মহিলা হয়তো বাড়িতে রান্নাঘর একাই সামলাতেন, মুখের সামনে চায়ের কাপ তুলে দেওয়ার কাউকে পাননি এতকাল। বাড়ি ছেড়ে বেরনোর হাজার অসুবিধা সত্ত্বেও গৃহশ্রমের ‘একের বোঝা’ সহজেই হয়ে উঠেছিল ‘দশের লাঠি’।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখি, বাড়ির মহিলারা সবার শেষে একা একা বসে বাসি-পচা-উচ্ছিষ্ট খান। উৎসবে, প্রতিবাদে সকলের সঙ্গে বসে সকলের মতোই খাওয়াদাওয়া করার সুযোগ মেলে তাঁদের। সকলে যখন বেরিয়ে আসেন আন্দোলনে, তখন খাওয়াদাওয়া ঘিরে এমন অনেক বেড়াজাল সহজেই ভেঙে যায়, ধর্মের বেড়াজাল, জাতির বেড়াজাল, লিঙ্গ পরিচিতি-নির্ধারিত শ্রমের বেড়াজাল।
বাড়িতে রান্নাঘর সামলানো শুধুই মেয়েদের কাজ, এমন কথা যাঁরা বিশ্বাস করতেন, অভিনব এই প্রতিবাদে এসে হয়তো তাঁদের বিশ্বাসও বদলে যায়। পার্ক সার্কাসে এনআরসি-বিরোধী প্রতিবাদের সময়ে শুনেছিলাম, মাইকে ঘোষণা করে এক মহিলাকে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে বলা হচ্ছে তাঁর বাচ্চা কাঁদছে তাই। আলোচনায় জানতে পারি, সারা দিন শিশুটিকে সামলেছেন তার ঠাকুর্দা। গৃহকাজ, শিশুদের দেখাশোনা, বাড়ির সকলে এসব কাজ ভাগাভাগি করে না করলে মেয়েদের পক্ষে অত দিন ধরে রাস্তায় আন্দোলন করা সম্ভব হত না।
অতিমারীর সময়ে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন হঠাৎ-ই থমকে যায়। তারপরে কিন্তু জায়গা হিসাবে শাহিনবাগের চরিত্রটাই বদলে যায়। অদ্ভুত ভাবে, সেই বদলের কেন্দ্রেও আছে খাবার। এখন প্রতিদিন বিকেলে টুনিবাল্বের আলো আর ঝোলানো ল্যাম্পশেডে সেজে ওঠে শাহিনবাগের রাস্তাঘাট। বারবিকিউ-এর ধোঁয়ায় ভরে যায় চারপাশ। নয়াদিল্লি-নয়ডা হাইওয়ের সমান্তরাল শাহিনবাগের চালিস ফুট্টা রোড। এক সময়ে গাড়ি সারাইয়ের গ্যারেজ, দুয়েকটা ছোট রেস্টুরেন্ট আর চায়ের দোকান ছিল এই রাস্তায়। আন্দোলনের সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই চায়ের দোকানে বসে কথাবার্তা বলতেন প্রতিবাদে শামিল হওয়া মানুষ। তখনই একে একে খুলতে শুরু করে ক্যাফে আর বিরিয়ানির স্টল। অনেকেই প্রথমবার শাহিনবাগে এসেছিলেন আন্দোলনের অংশ হতে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মেলামেশার একটা জায়গা হয়ে উঠেছিল এই সব দোকান। সমাজমাধ্যমে সেই ছবি দেখে আরও মানুষ ভিড় জমাতে থাকেন। আস্তে আস্তে দস্তুরমতো ফুড স্ট্রিটে পরিণত হয় শাহিনবাগের রাস্তা। মোগলাই, আফগানি, আরবি, তুর্কি এবং ইতালীয় খাবারের টানে এখনও মানুষ গিয়ে উপস্থিত হন শাহিনবাগে। বিগত তিন বছরে দিল্লির নামকরা অনেক রেস্টুরেন্টই তাদের শাখা খুলেছে সেখানে। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি আন্দোলনের জায়গাগুলোও ঘুরে দেখেন মানুষ, কথাবার্তা বলেন স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে।
প্রতিবাদের সঙ্গে রান্না-খাওয়ার সম্পর্কের এমন অদ্ভুত সব গল্প তৈরি হচ্ছে রোজ, পৃথিবী জুড়ে। একদিকে যখন বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখি রান্নাবান্না শুধুই মেয়েদের দায়িত্ব, বাড়ির বউ ঠিকমতো রান্না না করলে তাঁর গায়ে হাত তোলা যায়, এখনও এমন বিশ্বাস দেশের অনেক মানুষের, অন্যদিকে দেখি পুরনো বিশ্বাস ভেঙে নতুন বিশ্বাসও তৈরি হচ্ছে। দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এক দল মানুষ যখন জেগে ওঠেন, তখন তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা থেকেই আরও অনেক মানুষ জানাতে চান তাঁরাও পাশে আছেন। শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসার অর্ঘ্য হিসাবে তাঁদের মুখে তুলে দিতে চান ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার জল। এত রকম অস্বাচ্ছন্দ্য স্বীকার করে যাঁরা রাস্তায় পড়ে আছেন দিনের পর দিন, তাঁদের একটু ভালো খাবার খাইয়ে তৃপ্তি দিতে পারলেও খুশি হন মানুষ। সকলেই তো জানেন সেই ইংরেজি প্রবাদ, ‘‘দ্য ওয়ে টু আ ম্যান’স হার্ট ইজ থ্রু হিজ স্টমাক।’’ সময়ের দাবি মেনে প্রবাদটি অবশ্য বদলে নিয়েছেন মানুষ। শুধু পুরুষের হৃদয় নয়, মেয়েদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতেও যে তাঁদের রসনাতৃপ্তি ঘটানোর রাস্তাটি নেওয়া যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন শাহিনবাগের মতো আন্দোলনের সমর্থকরা।