মেয়েটির মেসে এসে দাঁড়ানোর সেই একটি মুহূর্তই তাই সন্দর্ভ। ফতোয়ার ধার তো সে ধারেই না। বরং এই বিশ্বায়নী মুক্ত মেলামেশার সুদিনে ঘেটোয় বন্দি ক’জনকে সে যেন উদ্ধার করতে এসেছে। নজরদারি জানলারা তাকে নিরীক্ষণ করে নিল যথেষ্ট, আর সে খবর চালাচালি হয়ে গেল মেসমালিকের কাছে। আমরা বসে ভাবি, এই চিত্রনাট্যে কমল মিত্র কিংবা ছবি বিশ্বাসের সংলাপ কী হবে!
৮.
মেস আমাদের জীবনের রতন চিনিয়েছে, তা বলে কখনও ভাবতে শেখায়নি যে, পৃথিবীতে কে কাহার!
আহার-নিদ্রা আর হইহল্লায় জনাকয় মাল্লা যৌথতায় দাঁড় বাইছিল বলে শুধু নয়, কথাখানা মরমে এসে বিঁধল, যখন মাধবীলতা এসে দাঁড়াল মেসের দরজায়। নিষেধ পেরিয়ে, যেন সন্ধের বাতাসে নেশার মতোন মিশে যাওয়া অনর্গল ছাতিমসুবাস। অতএব বার্তা গেল রটে।
আত্মীয় বলতে যা বোঝানো হয়, মেসে বস্তুত আমরা তো তা ছিলাম না। এক জীবনে জনাকয় মাথা গোঁজার দরুন মালুম হল আত্মীয়ের ধারণাটিকেই এযাবৎ বড় হাতুড়ে করে রাখা হয়েছে। আত্মা সম্বন্ধীয় হলে তার খাঁচাছাড়া হওয়াই বাঞ্ছনীয়। নেহাতই পারিবারিক করে তোলা বাড়াবাড়ি রকমের অপচয়। মাধবীলতা এসে আত্মীয়তার আকাশকে আর একটু যেন মাথার উপর টেনে দিল। বলতে গেলে, সে তো আমাদের মেসের কেউ নয়, উপরন্তু অন্যের বান্ধবী। তবু খবরের কাগজের যেমন অতিপত্র, আমাদের মেসে তেমন সে। মূল সংসারের বাইরে, একটু আলাদা, তা বলে অপর নয়। সে এল, যেন আসার কথাই ছিল। আর আমাদের তীব্র ‘পুরুষতন্ত্রে’ লাগল মাধবীলতা-ঢেউ। তাতে সবার আগে জোর হ্যাঁচকানে দুলে দুলে কেঁপে উঠল বারান্দার দড়ি। ভেজা জাঙিয়া-গেঞ্জি চেঙ্গিস খাঁ হয়ে এতদিন দিব্যি প্রকাশ্যে উড়ে বেড়াত। আকস্মিক তাদের মুখ লুকোনোর হুড়োহুড়ি, দেখার মতোই।
হয়েছে কী, অন্তর্বাসকে সদাসর্বদা অন্তর্বাসী করে রাখার বিষয়টি ছেলেদের স্মৃতি-শাস্ত্রে কস্মিনকালেও ছিল না। অঙ্গ থেকে দূরে সামান্য এক টুকরো কাপড়ের কী আর সঙ্গদোষ থাকতে পারে! রুমাল বিড়াল হতে পারে, কিন্তু জাঙিয়ার আড়াল হওয়ার দরকার ছিল না। ছেলেদের মেসে এরকমই বিধির বিধান। অথচ মেয়ে বন্ধুদের থেকে পরে শুনেছি জেনেছি যে, তাদের অন্তর্বাস বিষয়ে সচেতন থাকতে হত গোড়া থেকেই। বাড়িতে, মেসে-ও। আমরা যারা কো-এড স্কুল, এক ব্যাচে হাঁটুতে হাঁটু ঠেকা টিউশন– তারা প্রেম-প্রতিজ্ঞা-পরীক্ষার সিলেবাসে এক, তবু আলাদা এই লুকোচুরির অন্তর্বাসে। নোকিয়া এগারশো-র সাম্যের দিনে সেই বুঝি প্রথম লিঙ্গ-ধারণায় বড় চমক। পায়ে পায়ে যাদবপুর রেললাইন পেরিয়ে স্টেশন যাওয়ার মুখেই পরপর কয়েকটি অন্তর্বাসের দোকান। সামনে সামনে রাখা বিজ্ঞাপনের দলবৃত্ত। তার পাশ দিয়েই দিনে-রাতে হেঁটে গেছি আমরা বন্ধু, বান্ধবীরা। বিগ বাজারের ম্যানিকিনরাও কাচের ওপারে কী আর এমন রক্ষণশীল! তবু মেয়েদের অন্তর্বাস নিয়ে ঘরদুয়ারে খানিক আবডাল। ছেলেদের সে বালাই সেভাবে ছিল না। এই ধাক্কায় আমরা বুঝলাম, ভিক্টোরিয়া যতই প্রেমের উদ্যান হোক, ভিক্টোরিয়া সিক্রেট প্রকৃত প্রস্তাবে এক প্যাকেট নীতিপুলিশি।
যাই হোক, প্রথম যেদিন মাধবীলতা এল, আমরা আড়চোখে দেখে নিলাম। জং ধরা গ্রিলের ওপারে স্বাধিকারপ্রমত্তা দর্পিণী। যেন পঞ্চাশ-ষাটের সাদা-কালো সিনেমায় স্ক্রিনে এসেছেন সুচিত্রা সেন, এবার অবধারিত তছনছ। ঠোঁট-বাঁকানো ইষৎ শ্লেষ মেশানো হাসির সামনে বাঙালির অতিবড় মহানায়ক পর্যন্ত থতমত। সেই মেয়ের মতোই যে এসে দাঁড়িয়েছে, সে যেন নেমে এসেছে বহু কষ্টে পাওয়া স্বাধীনতাকে বালাই ষাট বলতেই। একাই এসেছে। যেমন একদিন একচালা ভেঙে একা চলতে শুরু করেছিল দুর্গা নামে মেয়েটা। তার আশপাশের মেয়েরাও আর পুরুষদের সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে থাকার প্রয়োজন বোধ করল না। একলা চলো হয়েও যে দিব্যি এক পথে হাঁটা যায়, এই স্বাধীন রীতির তো আরাধনাই করি আমরা। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের হাওয়া যেন ইতিউতি মিশে আছে আমাদের চারপাশের বহু কিছুতে। চোখ পাল্টে শুধু দেখলেই হয়। এই মেয়েও এসেছে একই পথ ধরে। মনে হতে পারে, এ তুলনা কি তুলুমূল্য! ভাবনাচিন্তার বাড়াবাড়ির একটা সীমা তো থাকা উচিত! তবু, যে সীমা ভাঙতে এসেছে, সেই জানে কী উচিত আর কী উচিত নয়। আমরা জানি, যতদূর যায় সীমা ততদূরই বিশ্বাস।
মাসিমা মালপো খামু-র বাঙালি অবশ্য বিলকুল জানে তার গোপন খামে সহজ মেলামেশার অনুমোদন নেই। ছিলও না। তাই লুকোচুরি নিয়ে যাবতীয় ফ্যান্টাসিমঙ্গল। জীবনের বাইরেটায় বেশ চকচকে পালিশ, ভিতরে অজস্র নালিশ। স্কুল-কলেজ-সিনেমা-সাহিত্যে যাপনের একরকম আভাস। অন্যদিকে গোঁড়ামির অষ্টোত্তর শতনাম। তেলে-জলে তো আর মিশ খায় না, অথচ সেই বদখচ শরবত তৈরি করতে অনবরত কে যেন চামচ নেড়ে চলেছে। ঠং ঠং শব্দে খানিক খানিক বিকৃতি খালি ছিটকে বেরিয়ে আসে। এই সমাজ মনের কথা মুখে আনে না। মন-কি-বাত কর্ম যত মহানই হোক, তা কি সহজ নাকি! অতএব মনের অন্ধকারকে আলো দিয়ে মুড়ে যে মস্ত প্যাকেজিং ফিরি হয়, তা ঝলমলে বলেই আমাদের মনে হয় এই-ই সেরা। এদিকে মেসের টুকরো-টাকরা ঘটনাতেই সেসবের চিচিং ফাঁক। যখন তাই, ‘বিগত ক’দশকে ধর্ম ছিল নাকি উবে গিয়েছিল’ ‘মুসলিমবিদ্বেষ ছিল নাকি ভালোবাসায় জড়াজড়ি ছিল দিনকাল’ জাতীয় আলোচনা হয় চারিদিকে, অলক্ষে মুখ লুকিয়ে হাসে ভাঙাচোরা ঝুল-পড়া সব মেস। প্রগতির নিকেল খয়ে গেলে গতির কলঙ্কই সার, তাদের থেকে ভালো আর কে জানে!
মেয়েটির মেসে এসে দাঁড়ানোর সেই একটি মুহূর্তই তাই সন্দর্ভ। ফতোয়ার ধার তো সে ধারেই না। বরং এই বিশ্বায়নী মুক্ত মেলামেশার সুদিনে ঘেটোয় বন্দি ক’জনকে সে যেন উদ্ধার করতে এসেছে। নজরদারি জানলারা তাকে নিরীক্ষণ করে নিল যথেষ্ট, আর সে খবর চালাচালি হয়ে গেল মেসমালিকের কাছে। আমরা বসে ভাবি, এই চিত্রনাট্যে কমল মিত্র কিংবা ছবি বিশ্বাসের সংলাপ কী হবে!
যা হবে, তা দেখা যাবে– এই হল মাধবীলতার সাফ কথা। দিন দুয়েক সে আসা-যাওয়ার পর আমরা ঠিক করলাম, আমাদের নিয়মতন্ত্রে খানিক বদল আনতে হবে। নইলে কেবলই দৃশ্যের জন্ম। একদিন সে এসেছে, ঠিক সেই সময় একজন বাথরুম থেকে খালি গায়ে বেরিয়ে হঠাৎ যেন তার হিরের আংটি ফেলে এসেছে এমন শশব্যস্ততায় ফের সেঁধিয়ে গেল। মাধবীলতাও হালকা পায়ে চলে যায় ঘনাদার রুমে। সম্ভবত তার দু’-চোখে খানিক কৌতুক। এরপর রাতে এক আপদকালীন বৈঠকে মেস-পার্টিতে কয়েকটি জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যথা, জামা-কাপড় মেলায় স্থান-কাল-পাত্রের যে গুরুত্ব আছে সে সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকব। ঘনাদা কথা বলে জানিয়ে দেবে যে, মাধবীলতা ঠিক কোন সময়ে আসতে পারে। ঘড়ির সঙ্গে আমরা আরও নিবিড় জনসংযোগে যাব, যাতে আদুল গায়ে গামছা পরে কাউকে মাধবীলতার সামনে পড়তে না হয়।
তবে দিনকয়েকের মধ্যেই আমরা বুঝলাম, সংকোচের বিহ্বলতা সবারে অপমান। মাধবীলতা ততদিনে আমাদের ভারি বন্ধু হয়ে গেছে। দেখেশুনে সবার সঙ্গে দাদা, ভাই পাতিয়ে নিয়েছে। মেসে কোনও ভালো খাবার কদাচিৎ আনা হলে, তাকে বাদ দিয়ে হিসাব করা হত না। সে-ও কিছু সঙ্গে করে আনলে শুধু তার প্রেমিকের জন্য বেঁধে রাখত না। আমাদের হয় দিয়ে যেত, নয় ঘনাদাকে দিতে বলে যেত। মোটকথা, সে আর আমাদের মেসের বাইরের কেউ নয়, যদিও বাইরেই থাকে। হোটেলেও সে আমাদের সঙ্গেই খেতে যেত। ঘুপচি হোটেলে তখন দিনদুপুরে চাঁদ। এসব অলৌকিকের খোঁজ খুব একটা কেউ রাখে না। আমরা শুধু দেখলাম, কী করে যেন পিছনের দিকের একটা বেঞ্চি, যেখানে বাতাস কিঞ্চিৎ বেশি খেলে, তা আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়ে গেল। এমনকী অন্যান্যরাও হোটেলের আশপাশে আমাদের দেখলে পারতপক্ষে আর সে-বেঞ্চে বসত না। মাধবীলতাকে পাশে নিয়ে আমরা যখন খেতে বসতাম, মিঠুনের হোটেল-ম্যানেজমেন্ট তখন হাতে-কলমে। তদারকি যেমন জোরদার তেমনই আন্তরিক। ফলে আমাদেরও আর হাতের ডাল হাতে শুকিয়ে মাছের জন্য বসে থাকতে হয় না। সত্যি বলতে, খাবার-দাবার বেশ ভালোই পাই, তরকারি হাতাতে ওঠে কিঞ্চিৎ বেশিই। দিনকয় এরকম উত্তম আহারের পর আমরা বুঝলাম, এই ঘোর কলিতে অন্নপূর্ণার দেখা পাওয়া দুর্লভ, তবে বিরল নয়। হাতায় করে তিনি আর শস্য ইত্যাদি না-ও ঢেলে দিতে পারেন, সময়ের সঙ্গে খাওয়ানোর ফর্ম খানিক বদলেছে।
কিন্তু মেসমালিক তো আর ভারতচন্দ্র নন, এই সব মঙ্গলকাব্যে তাঁর ইন্টারেস্ট নেই। তিনি অমঙ্গলের ছায়া দেখেন দিনদুপুরে। যেখানে মেয়েটির পা-রাখাই নিষিদ্ধ সেখানে গোটা মেসের সঙ্গে সে পা মেলায় কী করে! একদিন ছুটির দুপুরে অতএব শুরু হল দ্বন্দ্ব। কেন নিষেধ অমান্য হয়েছে, এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় কারও নেই। বরং কথা হল, কেন নিষেধ মান্য করা হবে! মেস কি কোনও নারীচরিত্রবর্জিত একাঙ্ক নাটক! চাপান-উতোর ভালোই চলল। এবং তার মধ্যেই মেসমালিক সবিস্ময়ে খেয়াল করলেন যে, মেয়েটির প্রেমিকের পিছনে ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাধবীলতার ভাই-দাদারাও। এমনটা যে হতে পারে, তা বোধহয় তিনি কল্পনা করেননি। মেস আমাদের ততদিনে শিখিয়ে দিয়েছে, দশে মিলে থাকি আজ, হারি জিতি নাই লাজ। অতএব সে যাত্রা মালিকের রণে ভঙ্গ। তবে সেই সঙ্গে সুর নরম করে মেস-সংবিধানের নিষেধাজ্ঞা ধারায় খানিক পরিবর্তন এনে জানিয়ে দিলেন, চোখের আলোয় যেন চোখের বাহিরে চলে যায়। আপাতত তাহলেই হবে।
নৈতিক জয়ে সম্ভবত সেদিন আমরা একটু বেশিই হাসাহাসি করেছিলাম। তবে কি-না জয়ের আনন্দ পাতার পোশাক। ক’দিন পরেই তা টের পেলাম। সেদিন ঘনাদার সঙ্গে কী নিয়ে যেন রাগারাগি মাধবীলতার। সে কিছুতেই মেস ছেড়ে যেতে চায় না। এদিকে ঘনাদা রাগে এবং অনুরাগে বেপাত্তা। প্রেমের পাখিকুল সংবিগ্ন, অতএব ফোনেও বিঘ্ন। মাধবীলতাকেও অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরাতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছি। দাদা-ভাইদের থেকে যে দিদিভাইদের জেদের জোর বেশি– এ আর নতুন করে বলার কী!
এদিকে দেখতে দেখতে সন্ধে গড়িয়ে গেল।
…পড়ুন মেসবালক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬। মেসের বাড়ি না থাকলে দেশের বাড়িকে ঠিক চেনা যায় না
পর্ব ৫। মেসে থাকতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিছানা আর বেডের মধ্যে বিস্তর তফাত
পর্ব ৪। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কখনও মেসে থাকেননি
পর্ব ৩। মেস আসলে জীবনের ক্রিকেট-সংস্করণ
পর্ব ২। আদরের ঘরের দুলালদের সদর চেনাল মেস
পর্ব ১। মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না