হেমন্তকে খানিকটা শীতের কাছ থেকে শিরশিরানি ধার করতে হয়, পৌষের কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয় খানিকটা কুয়াশা। শরতের ফেলে যাওয়া শিউলিই যেন তার সোনার জল করা রুপোর গয়নাগাটি। বর্ষার জমা জলগুলোও তার নিজের নয়। এই নিজস্বতাহীন একটা ঋতু, একটা সময় আমাদের জীবনের কিছু মানুষের মতো।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
ঠিক কবে থেকে শরৎ পেরিয়ে হেমন্তের শুরু হয়? ক্যালেন্ডার যেমনই সময় মেপে দিক আসলে আমরা জানি যে, মা দুগ্গার ভাসানের সময় ওই যে ছলকে পড়া জল গায়ে এসে লাগে। আর তারপর একটা কেমন যেন শিরশিরানি হয়। ব্যস, ওখানেই, ওখানেই শরতের শেষ। হেমন্তের শুরু। তারপর থেকেই সন্ধেবেলার হলদে বাল্বের নিচে ক্ষীণ কুয়াশা, একটু রাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ঠান্ডা আমেজ, সকালের দিকে ধোঁয়াটে মাঠ। আমাদের মফস্সলে কানা গলির ভিতর রঙিন সব ইস্টিশনে হঠাৎ চলে আসা কিছু মিষ্টি দুঃখ। পুজোর শেষে বাড়তি খরচ করে ফেলা মধ্যবিত্ত জীবনের কিছু রবিবার বন্ধ খাসির মাংস। চন্দননগরের টুনি বাল্ব খুলে নেওয়ার পর নিঝুম পল্লিরাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘দ্য ট্রি অফ সরোও’।
অনেক ইতিহাসবিদই মনে করেন ‘শশাঙ্কের অগ্রহায়ণ, আকবরের বৈশাখ’ অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সময়কালে যে বঙ্গাব্দের সূচনার মধ্য দিয়ে আমরা পয়লা বৈশাখে নতুন বছরের শুরু করি, সেটা মুঘল আমলের আগে ছিল না এদেশে। শোনা যায়, সম্রাট শশাঙ্কের আমলে নাকি বছরের শুরু হতে অগ্রহায়ণ থেকে। আর সেটা ছিল ‘শতাব্দ’। এই মাসে ধান কাটা শুরু হত বলে, একে বছরের প্রথম মাস ধরা হত। তাই এই মাসের নাম রাখা হয় অগ্রহায়ণ। ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম আর ‘হায়ণ’ অর্থ বর্ষ বা ধান।
ভাবুন তো, যদি ফের একবার আকবরের ক্যালেন্ডার ছেড়ে বাঙালি শশাঙ্ককে টেনে নিত নিজের কাছে। আর হেমন্তেই শুরু হত ফের নতুন বছর। মায়ের ঘরে ফিরে যাওয়ার পর আমন ধানের সোনালি মাঠ ময়দান স্বাগত জানাত নতুন বছরকে। বাড়িতে আসত মিষ্টির প্যাকেট। হালখাতা করতে গিয়ে আমাদের গলা বসত কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে।
আচ্ছা, যদি সত্যি সত্যি বাঙালি এরকম কিছু একটা করে দেখাত, তবে কি হেমন্ত আমাদের জীবনে আর একটু বেশি প্রাসঙ্গিক হত?
আসলে এই হালকা হিমের পরশ, শিউলির চলে যাওয়া, মাঝে মধ্যেই সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত বাঙালির আবহাওয়ার হেরফেরের সঙ্গে মনকেমনের একটা মিল আছে সম্ভবত। ওই যে বললাম কিছু মিষ্টি দুঃখ! যে দুঃখ মনের গহীনে স্বল্প শিশিরের মতো স্থায়ী। দুগ্গা, লক্ষ্মী, কালী, জগদ্ধাত্রী সব পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার পর কী একটা যেন না থাকা আমাদের ঘিরে থাকে। পড়ে থাকা শিউলির খোঁজ আর কেউ নেয় না। ছাতিম ফুলের গন্ধ আর চিত্রনাট্যের উপাদান জোগায় না পরিচালকের।
আসলে হেমন্ত হল এক ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবার মতো। সে আছে বলেই মাথার ছাদটা শক্ত। অথচ সে সমস্ত আড়ম্বরের বাইরেই থাকতে পছন্দ করে। মেয়ের বিয়ের দিন সে দাড়ি কাটতে ভুলে যায়। অফিসের কাঁধব্যাগটা সে সেলাই করেই চালিয়ে নেয় বহু বছর, অথচ ছেলে মেয়ের স্কুলব্যাগ বছর বছর নতুন আসে। এ যেন এক বিনা শর্তে ক্ষমতাহীন ভালোবাসা। হেমন্ত আছে বলেই শীতের মুগ্ধতা। সরষে ফুলের আড়ম্বর। তবু কি আমাদের মধ্যে কেউ প্রিয় ঋতুর উত্তরে হেমন্তের নাম বলে?
…………………………………………..
আমাদের ছুটি কাটানো দুগ্গা পুজোর শেষে টিউশন ফেরত সন্ধ্যায় সেই মিনুদিদি আবছা আলোয় গাইত ‘কোনও রাতে মনে কী গো পড়বে, ব্যথা হয়ে আঁখিজল ঝড়বে’। কার জন্যে গাইত সে? কার জন্যে জ্বালত আকাশপ্রদীপ, আমরা তা জানতে পারিনি। আমাদের বড় হয়ে যাওয়া, হলদে আলোর লাইটপোস্টের নিচ থেকে শ্যামাপোকাদের হঠাৎ উবে যাওয়ার মত করে আকাশপ্রদীপ আজ শুধুই হেমন্তের এক পশলা স্মৃতি।
…………………………………………..
এক্ষেত্রে শরৎ, বর্ষা কিংবা শীতের কাছে হেরে যায় হেমন্ত। একটু খেয়াল করে দেখুন, শরতের কাছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আছে, প্যান্ডেলের বাঁশ, ধানের তুষ আর দুঁদে মাটির তৈরি প্রতিমা আছে, আছে ইয়াব্বড় একটা উৎসব। শিউলি তো আছেই। বসন্তের দিকে তাকান। তার নিজের কাছে কৃষ্ণচূড়া আছে, কোকিলের ডাক আছে, গন্ধরাজের সন্ধ্যা আছে। নিমগাছ তলায় বসে থাকা লোডশেডিংয়ের হঠাৎ পাওয়া আড্ডা আছে। বর্ষার কাছে একটা জলজ্যান্ত বাইশে শ্রাবণ আছে। জুঁই ফুল আছে। কলমির গন্ধ ভরা বৃষ্টি আছে। আরও কত কী আছে। এগুলো তাদের নিজস্ব। অথচ হেমন্তকে খানিকটা শীতের কাছ থেকে শিরশিরানি ধার করতে হয়, পৌষের কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয় খানিকটা কুয়াশা। শরতের ফেলে যাওয়া শিউলিই যেন তার সোনার জল করা রুপোর গয়নাগাটি। বর্ষার জমা জলগুলোও তার নিজের নয়।
এই নিজস্বতাহীন একটা ঋতু, একটা সময় আমাদের জীবনের কিছু মানুষের মতো। সংসারে বাবার মতো। অনুষ্ঠান বাড়ির সেইসব মানুষের মতো, যাদের বিয়ের চিঠি দিতে কার্পণ্য করি আমরা বাড়তি ২০ টাকা খরচের ভয়ে। খাবার রয়ে গেলে মাংসটা ধুয়ে ফ্রিজে তুলে দিয়ে ডাল, ছ্যাচড়ার তরকারিটা ফেলে না দিয়ে যাদের দিয়ে দিই। মেয়ের সালোয়ার কামিজ কয়েকমাস পড়ার পর আমাদের মায়েরা যাদের অবলীলায় বলতে পারেন, ‘একদম নতুন আছে। তোমার মেয়েকে দিও। পরবে।’ আসলে হেমন্ত সেইসব মানুষের মতোই। যারা আছেন বলেই আমাদের চলাচল। বছরের প্রথম বর্ষায় উঠে আসা দুটো কই মাছ। যাকে আমরা ওই মেঘবৃষ্টির কাছে মনে রাখিনি।
তবু হেমন্তের সেই দুঃখ-রাতের গানে, থুড়ি সন্ধ্যায় আমরা যাকে খানিকটা ভুলে গিয়েছি তা হল আকাশপ্রদীপ। যাকে নিয়ে লতা মঙ্গেশকর বাংলার প্রথম প্লেব্যাকে গেয়েছিলেন, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’!
কী এই আকাশপ্রদীপ?
গত দশকেও বিশ্বাসবাড়ির চিলেকোঠার ছাদে, কার্তিক কুন্ডুর পুঁইমাচার ধারে, সন্ধ্যা কাকিমার তুলসীতলায় গোটা কার্তিক মাস ধরে যারা জ্বলত সন্ধে হলেই। আমাদের কিংবা এই ধুলোবালি জমা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষকে মনে রেখে সেই প্রদীপ জ্বালাত সন্ধ্যা কাকিমা, নৃপেণ সরকার, মিনু দিদি। আমাদের ছুটি কাটানো দুগ্গা পুজোর শেষে টিউশন ফেরত সন্ধ্যায় সেই মিনুদিদি আবছা আলোয় গাইত ‘কোনও রাতে মনে কী গো পড়বে, ব্যথা হয়ে আঁখিজল ঝড়বে’। কার জন্যে গাইত সে? কার জন্য জ্বলত আকাশপ্রদীপ, আমরা তা জানতে পারিনি। আমাদের বড় হয়ে যাওয়া, হলদে আলোর লাইটপোস্টের নিচ থেকে শ্যামাপোকাদের হঠাৎ উবে যাওয়ার মতো করে আকাশপ্রদীপ আজ শুধুই হেমন্তের এক পশলা স্মৃতি।
……………………………………………….
আরও পড়ুন কিশোর ঘোষ-এর লেখা: যে বনগাঁ লোকাল, সেই বৃষ্টি এক্সপ্রেস
……………………………………………….
ওই যে বললাম এ ঋতুর নিজের বলে কিছু নেই। আকাশপ্রদীপের সঙ্গেও ইদানীং আর দেখা হয় না তার। নজরুল শিউলিকে বলেছিলেন বিধবার হাসি! সে হাসি গোধূলি মিছিল স্পর্শ করে বছর বছর ফিরে আসে আমাদের উপমহাদেশে। অক্টোবর কিছুটা রয়েও ছেড়ে যায় হেমন্তকে। ওই দূরের তারার পানে তাকিয়ে আকাশপ্রদীপ জ্বেলে বোধ করি হেমন্তও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আওড়ায়–
‘মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল,
বড় হও দাদাঠাকুর।
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো।
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে।
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো?!
আমার মাথা এই ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে,
তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে?’