২৫ অক্টোবর, জন্মদিন পাবলো পিকাসোর। সদ্য শেষ হওয়া দুর্গাপুজোয়, সনাতন দিন্দা দুর্গাপুজোর চালচিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন পিকাসোর ছবি: ‘গের্নিকা’। ১৯৩৭ সালের এই ছবি কীভাবে আজকে জরুরি হয়ে উঠল? কেন দুর্গাপুজোশিল্পে ব্যবহার করা হল, তা কি স্রেফ চমক, না কি তার ভেতরে রয়েছে শিল্পের সারকথা? জানাচ্ছেন সনাতন দিন্দা, তাঁর এই কলামে।
২৪.
আমি এবারে যে পুজোয় পাবলো পিকাসোর বিখ্যাত পেন্টিং ‘গের্নিকা’ ব্যবহার করেছি, তার থিম ছিল: যুদ্ধ। যুদ্ধ এই সময়ে শুধু সরাসরি বন্দুক হাতে নিয়ে, পরমাণু বোমা ফেলে, মানুষ খুনোখুনির যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ মানসিক। একরকমের গৃহযুদ্ধও। মানুষে-মানুষেও হতে পারে, পশু-মানুষেও হতে পারে, প্রাণীজগৎ-উদ্ভিদজগতের মধ্যেও হতে পারে। ঘুম থেকে ওঠার পরই শুরু হয়ে যায় এই যুদ্ধ, ঘুমোতে গেলেও কি থেমে যায় তা? প্রতিপক্ষ হয়তো শক্তিশালী হয়ে ওঠে আরও। বাসে-ট্রামে-রাস্তাঘাটে, নিজের একলা ঘরেও এই যুদ্ধ চলতেই থাকে। এ এক অসম লড়াই! আমার মনে হয় এই যুদ্ধের বীভৎসতাকে, পাবলো পিকাসো একমাত্র গের্নিকা ছবিতে প্রথম দেখাতে সাহায্য করেছে আমাদের। যে কারণে দুর্গার চালচিত্রে গের্নিকাকে দেখিয়েছি। নতুন করে চোখ খুলে দিয়েছে এই ছবি, নতুন বোধ জন্ম দিয়েছে।
ঘোড়া, সাপ, নরনারী– তাদের মধ্যে এক আশ্চর্য যুদ্ধ চলেছে। আমার মনে হয়েছে, দুর্গা, একজন নারী, যে যুদ্ধে পারদর্শী। আজ এই দ্রোহকালও এই যুদ্ধের কথাই বলে। ‘উওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট’ হচ্ছে এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই। এই দ্রোহকালেও যাঁরা এই যুদ্ধে পারদর্শী হয়ে উঠছে, যে রূপেই হোক না কেন, বেঁচে থাকার বা সংগ্রামের আলো দেখাচ্ছে তাঁরা। দেখবেন, পিকাসোর এই ছবিতে লম্ফ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন এক গ্রিক দেবী। কিন্তু সে আলো শুধু বাইরেই পৌঁছক, তা আমরা চাইব না নিশ্চয়ই। চাইব সেই আলো আমাদের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছক।
এই কাজ যখন করেছি, কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, তারপর আমি আর কখনও সেই প্যান্ডেলে যাইনি। কাজ হয়ে যাওয়ার পর কোনও প্যান্ডেলেই যাইনি। কিন্তু কাজ চলাকালীন প্রচুর মানুষ এসে প্রশ্ন করেছে– এইটা কী? আমি বলেছি, পাবলো পিকাসোর একটা বিখ্যাত পেন্টিং গের্নিকা – যা গৃহযুদ্ধের ওপর আঁকা। মানুষকে বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। মনে করার কারণ নেই যে, মানুষ বুঝবে না এই পিকাসোর ছবি। পুজোর শিল্প এমনই এক জায়গায় চলে গিয়েছে যেখানে দেশি-বিদেশির কোনও ভেদাভেদ নেই। শিল্পীর ভেদাভেদ কোথায় ছিল? পৃথিবীর এমন একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী, যাঁর ছবি এখন এই মুহূর্তে জরুরি হয়ে উঠছে।
‘অরাজনৈতিক’ বলে কিছু হয় না। পিকাসোর এই ছবিও রাজনৈতিক। পিকাসোকে দুর্গাপুজোর চালচিত্র হিসেবে ব্যবহার করাও রাজনৈতিক। আমার মনে হয় এই ছবি আশা জাগানো। নিরাশার ছবি নয়। পিকাসোও তাই-ই ছিলেন। এই সময়ের যে আশার ছবি, তাই ধরা পড়েছে পিকাসোর ছবিতে। আমরা তো ইতিহাস থেকে ধার নিই, রি-সার্চ করি। গের্নিকার যে বাতি জ্বালানো, তা ওই আশারই অংশ। আজকের যুদ্ধের বীভৎসতার মধ্যে একটা আশার আলো।
পিকাসো হয়তো বা ফ্যান্সিসকো গোইয়ার ‘থার্ড অফ মে, ১৮০৮’ ছবিটির থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সেই বীভৎসতা অনেক সরাসরি, পিকাসো অনেক বেশি বোধের লড়াইয়ে তুলি চালিয়েছেন।
প্রথমে আমি যখন এই কাজটা করতে চাই, ভেবেছিলাম, দুর্গার ব্যাকগ্রাউন্ডে শুধুই চোখ রাখব। বহু বহু চোখ। কিছু চোখ ছিলও– গের্নিকা, লক্ষ মানুষের চোখ, তাদের কান্না অশ্রুসিক্ত চোখ। কর্কশ যে ব্যাপার ছিল পিকাসোর ছবিতে, তা আমি নিয়ে এসেছিলাম দুর্গার মধ্যে। দুর্গার বুকে বসিয়েছিলাম ক্ষিপ্ত সিংহের তেজ। সেই গ্রিক দেবীও চলে আসছে এখানে আলো দেখানোর জন্য। যদিও এখানে শুধু মনের আলো দেখালে হত না, নিধন করতে হত। আমি তা-ই করেছি। মানবশরীরের যে অপসুর, তা নিধন করতে হবে। যে-ধর্ষকরা রয়েছে, তাদের তো ‘পাশবিক’ বললে পশুকে অপমান করা হয়। এই যে দানবিক রূপ, দানবিক ধারণের মূল বীজকে নিধন করতে হবে। তাই ত্রিশূল রয়েছে, রয়েছে খাঁড়া। দুর্গার হাতের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম চোখ। চোখ এখানে রূপক। এ-ওকে গিলে খাচ্ছে, ও-তাকে গিলে খাচ্ছে। আমরা চোখকে কীভাবে দেখছি? তা কি শুধুই পবিত্র আবরণ দিয়ে? না। লোভের চোখ দিয়েও তো দেখা হয়। সেই দুর্গার চোখদুটো থেকে যেন তেজ এসে পড়েছে– চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিতে পারে আমার দুর্গা।
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ২১: প্রায় ২০০ বছর পুরনো দেলাক্রোয়ার সেই বিখ্যাত ছবি আঁকা হয়েছিল শরৎকালেই
পর্ব ২০: মহালয়ার ভোরের আগেই মানুষ জেগেছে, এটাই সত্যিকারের বোধন
পর্ব ১৯: আমার দুর্গার মধ্যে এ বছর বিষণ্ণতার সুর থাকবে
পর্ব ১৮: এখনও ভয় হয়, আমার তৈরি দুর্গাপ্রতিমা মানুষ ভালোবাসবেন তো?
পর্ব ১৭: পুজোসংখ্যার প্রচ্ছদে দুর্গা থাকতেই হবে, এটাও একধরনের ফ্যাসিজম
পর্ব ১৬: সাধারণ মানুষের কাছেই শিল্পের পরশপাথর রয়েছে
পর্ব ১৫: রাষ্ট্র যদি রামের কথা বলে, শিল্পীর দায় সীতার কথাও বলা
পর্ব ১৪: মানচিত্র মোছার ইরেজার শিল্পীর কাছে আছে
পর্ব ১৩: তৃতীয় নয়নকে গুরুত্ব দিই, তৃতীয় লিঙ্গকেও
পর্ব ১২: লাখ লাখ টাকা কামানোর জন্য দুর্গাপুজো করিনি, করব না
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত