ভিটের প্রতি মানুষের আসক্তি কি রক্তমাংসের প্রেমের চেয়েও বড়? ভিটে ছেড়ে যেতে চাইছেন না বিপজ্জনক বাড়ির নোটিশ পাওয়া বাসিন্দারা! কেন? ভাড়াবাড়ি ছাড়ার বহু বছর পরও কেন মুখস্থ থাকে ঘর-জানালা? কেন দেশভাগের পরও ঘর বলতে মন বোঝায়, ওপার বাংলাকে?
১.
শ্যামাকাকা যেদিন আখাউড়া পেরিয়ে আগরতলায় চলে এলেন, সেদিন সঙ্গে ছিল শুধুমাত্র একটা কচি কলাগাছ। আর দুটো ভাঙা ইটের ঢ্যালা। দ্যাশের!
সেদিন থেকে গাছ, ইট ও মানুষ তিনজনই উদ্বাস্তু। আজও।
২.
শিবচরণ স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে আচমকা চোখ গেল সেই বাড়িটার দিকে। ভাঙা প্রাচীরে লেখা আছে ‘বিপজ্জনক বাড়ি। প্রবেশ নিষেধ’।
বিরাট এক বহুতলের ঠিক গায়ে গায়ে লাগানো সেই বাড়িটা। হ্যাঁ, সেই বাড়িটাই তো। ওই তো সেই ঘর। সেই বারান্দা। সেই পরপর লাগানো বসতবাটি। সংসার। ‘ওই ঘরে সজল থাকত, সজলের বউ আর মেয়েটি থাকত’। এখন ‘একা ময়ূর ঘরছে একা দোতলায়?’
সজল কোথায় গেল? কেউ কি বলে দিতে পারবে? ওপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সেই লাল গামছা। তবে কি কেউ এখনও আছে?
কেউ আছে?
না নেই।
এখানে তো সজল থাকত? সজলের মেয়ে, বউ? কোথায় গেল?
ওরা ধানকল পার হয়ে চলে গেছে।
তুমি?
আমি সজলের ছেলে। এখনও আছি।
তুমি চলে যাওনি কেন?
আমি তো জানি না কোথায় যেতে হয়!
৩.
যারা যায়, তারা জানে না কোথায় যেতে হয়। যেমন প্যালেস্টাইন, গাজা, গোলানহাইট, লেবাননের মতো ভূখণ্ডের অধিবাসীরা। তারা হারিয়ে যায়। কোথায়? কেউ জানে না। এইসব ভূখণ্ড বিপজ্জনক, এইটুকুই তারা জানে। যারা জানে না, তারা ঝুঁকি নিয়ে পড়ে থাকে একটা কলাগাছ, একখণ্ড ইটের টুকরো বা একটি মাত্র গামছা নিয়ে। তবুও তারা থাকে, কারণ তারা জানে না কোথায় যেতে হয়।
৪.
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ইজরায়েলি আক্রমণে প্রায় এক লক্ষ লেবানিজ হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেছে নিজস্ব বসতবাটি থেকে। তারা কোথায় কেউ জানে না। শুধু গুনতিতে থেকে গেছে কয়েকজন, যারা মৃত। তাদের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। আহত হয়ে বিনা চিকিৎসার শিকার হয়ে তবুও তো বেঁচে আছে ৬,০০০ নিজভূমে পরবাসী প্যালেস্তিনিয়ান। গত ৫০ বছরে নব্বই লক্ষ সতেরো হাজার ফিলিস্তানি আজ আর নেই। নিরুদ্দেশ। কোনও দেশ তাদের স্বীকার করেনি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র জর্ডন শুধু মেনে নিয়েছে যে তারা আশ্রয় দিয়েছে পাঁচ লক্ষ চুরাশি হাজার ফিলিস্তিনিকে। বাকিরা? কোথায় যেতে হয় জানে না। তাই তো?
৫.
কুমার পঞ্চাশ বছরের রেলযাত্রী। প্রতিদিন যাওয়া আর ফিরে আসা। এই দীর্ঘ রেলযাত্রায় সে দেখেছে অনেক। শুনেছে তারও বেশি। হরেক কিসিমের হকারের ডাক সে খুব মন দিয়ে শুনত। প্রথম দিকে সে আন্দাজ করতে পারত অধিকাংশ হকারই বাঙাল। মানে ওপার বাংলার। তাদেরও ওপারে ঘর ছিল, ছিল লাউগাছ। কলাগাছ। ধানের শিষের সীমাবদ্ধ নিশানা। তারা ওই ‘বিপজ্জনক’ সীমাবদ্ধতাটুকুও রাখতে পারেনি। শ্যামাকাকার মতোই হয়তো একটা আধটা ইটের টুকরো নিয়ে চলে এসেছে আপাত নিরাপদ আশ্রয়ে। কেউ কিন্তু জানে না এই নিরাপত্তা কত দিনের। আবার কি চলে যেতে হবে না জানা ‘কোথাও’? কখনও কোনও বৃষ্টির রাতে হয়তো মনে হত কেন এলাম? থাকলেই পারতাম। মরলে মরতাম বাপ-ঠাকুদ্দার ভিটেয়? কেন এলাম– এই প্রশ্ন যেন ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’-র সেই চিরন্তন প্রশ্ন, ‘রাত কত হুইল?’ উত্তর মেলে না।
উত্তর কারও জানা নেই। তবু কেবলই পৃথিবী জুড়ে দৃশ্যের জন্ম হয়। অগুনতি রিফিউজি কলোনির আকাশে এক ফালি চাঁদ।
৬.
বিধবা পুত্রবধূ বনলতার হাত ধরে শ্বশুরমশাই বলেছিল, ‘এহানে তো কেউই রইল না। হক্কলে ওপারে গ্যাসে। তুমি কিন্তু এই ভিটা ছাইরা যাইও না। আমার এই সামান্য সম্বল সামলাইয়া রাইক্ষ্যো।’
শ্বশুরের কথা ফেলতে পারেনি বনলতা। থেকে গেছে ওপারে। দেখেছে দেশভাগ, দাঙ্গা, হত্যা, ভয়, আতঙ্ক, খান সেনাদের তাণ্ডব, মুক্তিযুদ্ধ। কারণ শ্বশুরের ভিটেই ছিল তার নিরাপদ আশ্রয়। কোথায় যেত সে? কোথায়ই বা আসত? বনলতার কথা মনে পড়লে কুমারের চোখে ভেসে ওঠে ‘কোমল গান্ধার’-র সেই দৃশ্যটা। এক ভিটে হারানো পণ্ডিত (বিজন ভট্টাচার্য) আনন্দে চেঁচিয়ে বলছেন ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা। মধ্যিখানে বইসা আসি আমরা’।
বনলতার ঠিক সেই অবস্থা হয়েছিল। এপারে দেশ ওপারে দেশ। মধ্যিখানে কোনটা স্বদেশ?
শুধুমাত্র দেশভাগের সময়েই সীমান্তের এপার-ওপার করেছে পনেরো লক্ষ গৃহহীন মানুষ। বঙ্গেই নয়, পাঞ্জাবকে ধরলে আরও বেশি হবে সংখ্যাটা।
বনলতা কিন্তু অটল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দেশ ছাড়ব না। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁকে জোর করেই এপারে আনা হয়। তারপর আর বেশিদিন বাঁচেননি। বনলতার জন্য এপার-ওপার দুটোই যে সমান, ‘বিপজ্জনক’।
এই প্রসঙ্গে একটা যেন গল্প মনে পড়ে গেল।
একটি কিশোরী কন্যা দাঁড়িয়ে আছে খরস্রোতা নদীর সামনে। কী করে পাড় হবে নদী? তাকিয়ে দেখল ওপারে একজন সাধু। কিছু না ভেবেই সে সাধুকে প্রশ্ন করল, ‘কী করে ওপারে যাব?’ সাধু এদিক-ওদিক তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘তুমি তো ওপারেই আছ?’
সত্যিই তো এপার-ওপার নিরাপদ বা বিপজ্জনক বলে কিছু আছে? থাকতে হবে এটুকু জানি। কোথায় যেতে হয়, জানি না তো!
৭.
কলকাতা পুরসভার তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে শহরে ‘বিপজ্জনক’ বাড়ির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। অধিকাংশ বাড়তেই বসতি আছে। তাদের দেওয়া তথ্য বলছে, প্রায় একশোটি বাড়ি এই মুহূর্তে ভেঙে দেওয়া উচিত। তাহলে উপায়? ভিটে ছেড়ে কোথায় যাবে এই ফিলিস্তিনিরা? কোথায় যেতে হয় তা তো এরা জানে না! তাই!
যেমন জানে না কেন ‘ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে তোমার ব্যক্তিগত বসন্ত দিনের চটি’! কেন তুমি হারিয়েছ তোমার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা বাদামপাহাড়ে?
বি. দ্র. সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ের প্রাক্কালে কলকাতা পুরসভা বিপজ্জনক বাড়িগুলির বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার বার্তা দিয়েছিল। খবরে প্রকাশ, তারা বলেছিল, ‘আমাদের ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা নিয়ে আমরা এখানেই থাকব। বসন্তদিনে আমরা হারিয়ে যাব না আর বাদামপাহাড়ে!’
ঋণ: আবার পুরী সিরিজ। উৎপলকুমার বসু