জামিনের আশায় থেকে থেকে জেলেই মৃত্যু হয়েছে স্ট্যান স্বামীর। জেল থেকে বেরনোর কিছুদিনের মধ্যেই প্রয়াত অধ্যাপক জিএন সাইবাবা। দোষী সাব্যস্ত না হয়েই গারদের অন্তরালে ২৩ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন গার্ডেনরিচের ধর্ম মাহাতো। চার বছর ধরে বিচারের অপেক্ষায় উমর খালিদ। আড়াই বছর জেলে কাটিয়ে জামিন পেয়েছেন সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান। এমন উদাহরণ অজস্র। পরিস্থিতি এমনই যে, সুপ্রিম কোর্ট বারবার বলতে বাধ্য হচ্ছে, জামিন পাওয়া মৌলিক অধিকার। কাউকে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায় না। অথচ, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) রেকর্ডে, ২০২২ সালে ভারতের সমস্ত জেল মিলিয়ে কয়েদির সংখ্যা ৫,৭৩,২২০ জন। তার মধ্যে বিচারাধীন ৪,৩৪,৩০২ জন, প্রায় ৭৬%!
‘আইন! সে তো তামাশা মাত্র। বড়লোকেরাই কেবল পয়সা খরচ করিয়া সেই তামাশা দেখিতে পারে…’ প্রায় দেড়শো বছর আগে ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ লিখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু এখনও তা কতটা বাস্তব! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে…’। তারপর কত বছর কেটে গেল… সেই ছবি আর বদল হল না। ঔপনিবেশিক আইন বাতিল করে সদ্য ঢাকঢোল পিটিয়ে তৈরি হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা। কিন্তু তাতেও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি মিলবে কি? অনেক প্রশ্নেরই সদুত্তর মেলেনি।
মনে পড়ছে সৈয়দ মুজতবা আলির ‘দেশে বিদেশে’র একটি অংশ। সেই যে আফগান ভূখণ্ডে নিমলার বাগানে পালিয়ে যাওয়া কয়েদির বদলে নিরীহ লোককে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাহারাদার। পরিচয় হয়েছিল, ‘মা খু চিহ্ল্ ও পঞ্জম্ হস্তম্’ অর্থাৎ ‘আমি পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।’ ষোলো বছর পর আমীর হবিবউল্লার সামনেও তার ছিল সেই একই বুলি। বা উত্তম-সুচিত্রা জুটির জনপ্রিয় ছবি ‘সবার উপরে’। কৃষ্ণনগরের এক মহিলা খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছিলেন প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় (ছবি বিশ্বাস)। বারো বছর পর বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে আসেন একমাত্র ছেলে শঙ্কর (উত্তম কুমার) এবং সফলও হন। ইতিমধ্যে প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন প্রশান্ত। ছবিতে কোর্টরুম ড্রামার শেষ পর্বে তাঁর সংলাপ– ‘ফিরিয়ে দাও আমার জীবনের সেই বারোটি বছর’ তো চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছে বহু মানুষের স্মৃতিতে। আর বাস্তবে? এমন ঘটনা রয়েছে অজস্র।
…………………………………………………………
উত্তরপ্রদেশের ললিতপুর জেলার সিলাওয়ান গ্রামের বাসিন্দা বিষ্ণু তিওয়ারি। ২০০১-এ জমি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল প্রতিবেশীর সঙ্গে। প্রতিবেশীর পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী যৌন হেনস্তা, ধর্ষণ, মারধরের অভিযোগ দায়ের করেন। মিথ্যা সাক্ষ্যে ২০০৩-এ যাবজ্জীবন সাজা হয়। ১৬ বছর পর বিষ্ণু দ্বারস্থ হন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। তাদের চেষ্টায় ফের শুনানি করে এলাহাবাদ হাই কোর্ট বিষ্ণুকে ‘নির্দোষ’ বলে ঘোষণা করে। ততদিনে পার হয়েছে ২০ বছর! তার মধ্যে বাবা-মা ও দুই ভাইকে হারিয়েছেন তিনি। থাকতে পারেননি তাঁদের শেষকৃত্যেও। তাঁর পরিবারকে যেতে হয়েছে অসম্ভব যন্ত্রণা ও সামাজিক উপেক্ষার মধ্য দিয়েও।
…………………………………………………………
উত্তরপ্রদেশের ললিতপুর জেলার সিলাওয়ান গ্রামের বাসিন্দা বিষ্ণু তিওয়ারি। ২০০১-এ জমি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল প্রতিবেশীর সঙ্গে। প্রতিবেশীর পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী যৌন হেনস্তা, ধর্ষণ, মারধরের অভিযোগ দায়ের করেন। মিথ্যা সাক্ষ্যে ২০০৩-এ যাবজ্জীবন সাজা হয়। ১৬ বছর পর বিষ্ণু দ্বারস্থ হন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। তাদের চেষ্টায় ফের শুনানি করে এলাহাবাদ হাই কোর্ট বিষ্ণুকে ‘নির্দোষ’ বলে ঘোষণা করে। ততদিনে পার হয়েছে ২০ বছর! তার মধ্যে বাবা-মা ও দুই ভাইকে হারিয়েছেন তিনি। থাকতে পারেননি তাঁদের শেষকৃত্যেও। তাঁর পরিবারকে যেতে হয়েছে অসম্ভব যন্ত্রণা ও সামাজিক উপেক্ষার মধ্য দিয়েও। একই ভাবে ২৮ বছর, ছ’মাস এবং ২৩ দিন নাগপুরে জেল খেটে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মুক্তি পেয়েছিলেন খুনের আসামি রাজস্থানের নিরানরাম চেতনরাম চৌধুরী। নেপালের বাসিন্দা দীপক যোশী ১৯৮১ সালে দার্জিলিংয়ে এসেছিলেন। সেখানে খুনের দায়ে বন্দি হন। ৪০ বছর আগে নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছিলেন। তারপর থেকেই আপিল মামলার ফাইল ঘুরেছে জেলা আদালত থেকে হাই কোর্টে। শুনানিই হয়নি। ৪০ বছরে ভুলতে বসেছেন পরিচয়-পরিবার-জীবনের সমস্ত স্মৃতি। শুধু নামটাই বলতে পারতেন। হঠাৎ তাঁর বিষয়টিতে চোখ পড়ে হাই কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি টিভিএন রাধাকৃষ্ণনের। দীপক যাতে সুবিচার পেয়ে পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারেন, সে জন্য স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে হাই কোর্ট।
……………………………………………………….
পড়তে পারেন অন্য লেখাও: রাজনৈতিক দলের পেশাদার লোক নিয়োগে সাধারণ মানুষ চটছেন কেন?
……………………………………………………….
আর বিনা বিচারে জেলে থাকার তো ইয়ত্তাই নেই। জামিনের আশায় থেকে থেকে জেলেই মৃত্যু হয়েছে স্ট্যান স্বামীর। জেল থেকে বেরনোর কিছুদিনের মধ্যেই প্রয়াত অধ্যাপক জিএন সাইবাবা। দোষী সাব্যস্ত না হয়েই গারদের অন্তরালে ২৩ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন গার্ডেনরিচের ধর্ম মাহাতো। চার বছর ধরে বিচারের অপেক্ষায় উমর খালিদ। আড়াই বছর জেলে কাটিয়ে জামিন পেয়েছেন সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান। এমন উদাহরণ অজস্র। পরিস্থিতি এমনই যে, সুপ্রিম কোর্ট বারবার বলতে বাধ্য হচ্ছে, জামিন পাওয়া মৌলিক অধিকার। কাউকে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায় না। অথচ, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) রেকর্ডে, ২০২২ সালে ভারতের সমস্ত জেল মিলিয়ে কয়েদির সংখ্যা ৫,৭৩,২২০ জন। তার মধ্যে বিচারাধীন ৪,৩৪,৩০২ জন, প্রায় ৭৬%! বিচার শেষে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাঁরা কবে মুক্তি পাবেন, কেউ জানে না। জেলের বন্ধ কুঠুরির অন্তরালে তাঁদের জীবনের যে মূল্যবান সময় অপচয় হল, তার ক্ষতিপূরণ হবে কীভাবে? কোনও উত্তর নেই। ভারতীয় আইনে এমন কোনও সংস্থান নেই যে, রাষ্ট্র এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ করবে। ব্যতিক্রম বিজ্ঞানী নাম্বি নারায়ণন। মিথ্যা অভিযোগে জেল খাটায় গত বছর সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছিল। যে বা যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে, কারামুক্তির পর তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করা যায়। আদালত তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশও দিতে পারে। কিন্তু তার জন্য যে সময় ও অর্থের প্রয়োজন, তা কতজনের সামর্থ্যে কুলায়।
অন্যদিকে, তথাকথিত ‘উন্নত’ দেশে কী হয়? বিচারকরাও মানুষ। তাঁদের ভুল হতে পারে। মিথ্যা সাক্ষ্য-প্রমাণ অন্য দেশেও হাজির করা হয়। কিন্তু সেই ভুল সামনে এলে তার প্রতিবিধানও রয়েছে। খুন এবং ডাকাতির দায়ে ৩০ বছর জেলে কাটাতে হয়েছিল আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের বাসিন্দা, ৬৪ বছর বয়সি মাইকেল সুলিভ্যানের। এই সময়ের মধ্যে তাঁর মা এবং চার ভাই-বোনের মৃত্যু হয়, প্রেমিকা ছেড়ে চলে যান। তারপর সামনে আসে আসল সত্য। জানা যায়, যে ‘অপরাধে’ সুলিভ্যানের এই তিন দশকের কয়েদবাস– তার জন্য তিনি দায়ীই নন। নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও বিচারে ‘ভুলবশত’ এত বছর ‘শাস্তি’ পাওয়ার মাশুল হিসাবে আদালতের তরফে মিলেছে ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (প্রায় ১০৭ কোটি টাকা) অর্থ সাহায্যও। ১৯৮৩ সালে একটি ধর্ষণ ও খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ড হয় আমেরিকার দুই কৃষ্ণাঙ্গ সহোদরের। হেনরি ম্যাক্কলাম ও লিয়ন ব্রাউনকে ৩১ বছর জেলে কাটাতে হয়। ২০১৪ সালে নির্দোষ প্রমাণিত হলে মুক্তি পান ও মামলা করেন তাঁরা। ২০২১-এ আদালত দুই ভাইকে সাড়ে সাত কোটি ডলার ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছে। অ্যালান হল নামে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডের এক ব্যক্তি খুনের দায়ে দু’দফায় ১৮ বছর জেলে কাটান। পরে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। গত বছর তাঁকে ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয় নিউজিল্যান্ড সরকার। ক্ষমাও চেয়ে নেয়।
ভারতের বিচারব্যবস্থার যা হাল, তাতে সে আশা করা বৃথা। সম্প্রতি এলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি সিদ্ধার্থ এবং বিচারপতি সৈয়দ কামার হাসান রিজভির বেঞ্চ এমনই এক মামলায় বলেছেন, ফৌজদারি মামলায় ভুলবশত দোষী সাব্যস্ত হওয়া আসামিদের জন্য ক্ষতিপূরণ চালু করা উচিত। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? যে দেশে প্রতিবাদীদের বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখা শাসকের অন্যতম ‘অস্ত্র’, তারা করবে প্রতিকার! ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় এমনভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা তৈরি করা হয়েছে, যাতে তার যথেচ্ছ অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। এমনটাই মত বিরোধী থেকে শুরু করে আইন বিশারদদের। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিতে (আইসিসিপিআর) স্বাক্ষরকারী দেশগুলিকে অন্যায়ভাবে কারাবাস এবং আটকের জন্য ক্ষতিপূরণের অধিকার নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছিল। চুক্তিতে সই করলেও ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, দেশের আইনি ব্যবস্থা এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না। ভুলবিচারে ক্ষতিপূরণের আশা এখনও পর্যন্ত তাই ভারতে সোনার পাথরবাটি হিসেবেই থেকে গিয়েছে।