বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সেই সাত বছরের শিশুটি দরজায় টোকা মারে। কিন্তু কেউ শুনতে পায় না সেই ডাক। সেই শিশু যুদ্ধের খবর আনে, সেই শিশু যুদ্ধাতঙ্কের চেতনা হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু কেউ তাকে দেখতে পায় না, কেউ তাকে শুনতে পায় না। সবাই কি তাকে ভুলে গেল? সেই শিশু যুদ্ধক্ষেত্রে ধুলো হয়ে উড়ে গেছে। তার আর কণামাত্র অবশিষ্ট নেই এ পৃথিবীতে। সাত বছরের এক শিশু মাত্র। সাত বছরের শরীরকে একটি অস্ত্র বিপজ্জনক মনে করেছিল। এত ভয় যুদ্ধবাজদের, এত ভয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের।
১০.
আই কাম অ্যান্ড স্ট্যান্ড অ্যাট এভরি ডোর, নাজিম হিকমত, তুরস্ক
৬ অগাস্ট, ১৯৪৫। প্রশান্ত মহাসাগরের গাঢ় নীল জলের ওপর সূর্যের আলো চিকচিক করছে। চারিদিক সুন্দর, কোমল, মনোরম। একটা শান্ত-স্বাভাবিক দিন শুরু হয়েছে। মানুষ কাজে বেরিয়েছে, গল্প করছে, খবরের কাগজ পড়ছে, প্রেম করছে, সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আগত দিনের সম্ভাবনায় মুখর হয়ে রয়েছে। ওই মহাসাগরের ওপর কোনও ছায়া নেমে আসছে কি? না, এই সম্ভাবনার কথা কেউ ভেবে দেখেনি। কিন্তু ওই একটা নিশ্চিন্ত দিনের ওপর দিয়ে দুর্বার গতিতে চলছে সাতটি মার্কিন বোমারু বিমান। বি ২৯। তার মধ্যে একটিতে পারমাণবিক বোমা। কোড নেম: লিটল বয়।
সকাল ৮টা ১৬। প্লেনগুলো পৌঁছল হিরোশিমার ওপর। পাইলট পল টিবেটস তার প্লেন থেকে নিক্ষেপ করল পারমাণবিক বোমা। মুহূর্তের মধ্যে ঝলসে গেল হিরোশিমা শহর। ঝলসে গেল প্রায় নব্বই হাজার সাধারণ নাগরিক। মৃতের সংখ্যা তিনদিনের মধ্যে ছাড়িয়ে গেল ১.৬০ লাখ। ওই পারমাণবিক বিকিরণের প্রভাব সহজে গেল না। বছরের পর বছর বিকলাঙ্গ ও অন্ধ শিশু জন্মাতে লাগল সে দেশে। বিস্ফোরণ শুধু হিরোশিমা বা তার তিনদিন পর নাগাসাকিতে ঘটেনি। বিস্ফোরণ ঘটল বিশ্ব নাগরিকের মনে। যুদ্ধের এই ভয়াবহ পরিণতির কথা কেউ চিন্তা করেনি। কেউ চিন্তা করেনি যে কোনও অস্ত্র ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর নিক্ষেপ হবে, কোনও অস্ত্র না-জন্মানো শিশুকেও আক্রান্ত করবে। এমন যুদ্ধ আগে কেউ দেখনি। দিকে দিকে গান, কবিতার মাধ্যমে ধিক্কার জানাতে শুরু করে বিশ্বনাগরিক। দিকে দিকে যুদ্ধবিরোধী, মানবতাবাদী চিন্তার প্রবাহ শুরু হল। কে না আক্রান্ত হয়েছিল সেদিন, কে না ডুকরে কেঁদে ওঠেনি। ১৯৫৬-তে তুর্কি বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত লিখলেন ‘I come and stand at every door’। পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, এমনকী, আজও হয়ে চলেছে। কিন্তু নাজিম হিকমত লিখলেন একদম অন্য ধাঁচের কবিতা। একটি সাত বছরের মৃত শিশুর দৃষ্টিভঙ্গিতে। মৃত শিশুদের বয়স বাড়ে না, মৃত শিশু সভ্যতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে যুদ্ধের ভয়াবহতার চিহ্ন হয়ে।
নাজিম হিকমতের এই কবিতাটা লেখার কয়েক বছর পর জেনেট টার্নার নামে এক সংগীতশিল্পী কবিতাটির একটি ইংরেজি খসড়া করে পাঠালেন পিট সিগারকে। যদি এটা গানে রূপান্তর করা যায়! পিট সিগার নাজিমের ইংরেজি অনুবাদটিকে জেমস ওয়াটারের একটি আইরিশ লোকগান ‘the great selche of sule skerry’-র সুরে বসালেন। গানটি ১৯৬৪-তে কলম্বিয়া রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত হল।
I come and stand at every door
But no one hears my silent prayer
I knock and yet remain unseen
For I am dead, for I am dead
I’m only seven although I died
In Hiroshima long ago
I’m seven now as I was then
When children die they do not grow
My hair was scorched by swirling flame
My eyes grew dim my eyes grew blind
Death came and turned my bones to dust
And that was scattered by the wind
I need no fruit I need no rice
I need no sweets nor even bread
I ask for nothing for myself
For I am dead, for I am dead
All that I ask for is for peace
You fight today, you fight today
So that the children of this world
May live and grow and laugh and play
বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সেই সাত বছরের শিশুটি দরজায় টোকা মারে। কিন্তু কেউ শুনতে পায় না সেই ডাক। সেই শিশু যুদ্ধের খবর আনে, সেই শিশু যুদ্ধাতঙ্কের চেতনা হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু কেউ তাকে দেখতে পায় না, কেউ তাকে শুনতে পায় না। সবাই কি তাকে ভুলে গেল? সেই শিশু যুদ্ধক্ষেত্রে ধুলো হয়ে উড়ে গেছে। তার আর কণামাত্র অবশিষ্ট নেই এ পৃথিবীতে। সাত বছরের এক শিশু মাত্র। সাত বছরের শরীরকে একটি অস্ত্র বিপজ্জনক মনে করেছিল। এত ভয় যুদ্ধবাজদের, এত ভয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের।
শিশুটি বায়না করা ছেড়ে দিয়েছে। শিশুটি আর ফল খেতে চায় না, ভাত খেতে চায় না। শিশুটি আর কিছুই চায় না। কিন্তু সাত বছরের এই শিশুটি ফিরে এসেছে কিছু একটা চাইতে। কার কাছে? আমাদের কাছে। আমাদের কাছে সে চাইছে বিশ্বজোড়া শান্তি। তার জন্য সে বায়না করার মতো করেই বলছে লড়াই করতে। যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে শান্তিকামী মানুষের লড়াই। শিশুটি চাইছে আমরা যেন এবার উঠে দাঁড়াই। আমরা উঠে দাঁড়ালেই নীল আকাশ চিরে আর কোনও বোমারু বিমান উড়বে না।
গানের কথা সহজ, সরল। ঠিক একটি শিশুর অভিব্যক্তি যেমনটি হয়। কিন্তু গানের পরিবেশনে পিট সিগার তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ ঘটিয়েছেন। গানটি শুরু করেন ওঁর সিগনেচার লো হুইসেল আর তার সঙ্গে টুয়েলভ স্ট্রিং গিটারে গুরুগম্ভীর স্ট্রামিং দিয়ে। একদিকে কথাতে সারল্য, সুরে আইরিশ লোকগানের মাদকতা। আর গানটির অ্যারেঞ্জমেন্টে ডার্ক মিনিমালিস্টিক এক চেতনা।
শিশুটি শান্তির জন্য আবেদন করছে আর বলছে– শান্তির জন্য তোমরা যুদ্ধ করো। যাতে আমার মতো কোটি কোটি শিশুকে এইভাবে ঝলসে মরতে না হয়। আজ ৭৯ বছর কেটে গেছে। পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের হুমকি এলেও আর ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু যুদ্ধ এখনও চলছে। গাজা, ইউক্রেনের হিরোশিমার সেই সাত বছরের শিশুটির মতো হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছে। পারমাণবিক বোমার তাপে নয়, মানুষের হিংস্র উন্মাদনার তাপে। যুদ্ধক্ষেত্র আজও শিশুদের লাশে ভরে রয়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে ফসল ফলুক, যুদ্ধক্ষেত্রের মাটি উর্বর হোক। ফুটে উঠুক অলিভ গাছ।
…পড়ুন গানস অ্যান্ড রোজেস-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯। একটা আশাবাদ ও একটা অনলস কৌম চেতনা
পর্ব ৮। একটা গান থেমে যায়, চিৎকার ভেসে ওঠে
পর্ব ৭। সচ্ছলতার বিনিময়ে দমবন্ধ করা এক স্বপ্নহীন, স্বাধীনতাহীন জীবন
পর্ব ৬। তিনটি মানুষ ও একটি কারাগার