হারানো মানুষ আর হারানো সময়ের আলোছায়ার কোলাজ ‘শ্রীনিকেতন’ বইটি। শান্তিনিকেতনের কথা আশ্রমিকেরা বলে বলে ফুরোতে পারেননি, কিন্তু পড়শি শ্রীনিকেতন সে আলোর খানিক আড়ালেই রয়ে গিয়েছে। অন্তরঙ্গ স্মৃতির সফরে সেই শ্রীনিকেতনকেই দু’মলাটে ধরে দিয়েছেন লেখিকা। ছোট্ট বইয়ের সংক্ষিপ্ত যাত্রা দ্রুত ফুরোয়, কিন্তু সেই সময়ের গন্ধ ঘিরেই থাকে পাঠককে।
প্রদর্শনীতে প্রথম হয়েছে বাবার তৈরি করা বাটিকের শাড়ি। সে শাড়িটি সংগ্রহ করে নিয়েছে জাপান কনস্যুলেট। তারপরেই শোনা গেল, জাপানের কনস্যুলেট জেনারেল মিয়াকি আসবেন শান্তিনিকেতন দেখতে। থাকবেন তাদের অতিথি হয়েই। ছোট্ট মেয়েটি তো বটেই, মা-বাবা-ঠাকুমাও চিন্তা করছেন, কোথায় থাকতে দেওয়া যায় মহামান্য অতিথিকে। কেন-না, খড়ের চাল থেকে চটের সিলিংয়ের ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যেই সাপ কিংবা বিছের পতন ঘটে। কিন্তু তাতে কী! পাশের বাড়ির পড়শিরা এসে আশ্বস্ত করলেন, তাঁদের তো দালানবাড়ি, মহামান্য অতিথি সেখানে থেকে গেলেই হল! আর অতিথি এসে দেখলেন, বাড়ির পেয়ারা গাছে উঠে মহানন্দে পেয়ারা পাড়ছে দুই বাড়ির দুই খুদে। জাপানের কনস্যুলেট জেনারেল বিনা দ্বিধায় তাদের নামকরণ করে বসলেন, ‘দ্বৈত মাঙ্কি’। তারপর অবশ্য শুধু ‘দ্বৈত মাঙ্কি’ নয়, পাড়ার সব খুদেকেই ঘুরিয়ে আনলেন নিজের জাপানি গাড়িতে চড়িয়ে।
সব হতে আপন যে শান্তিনিকেতন, তা আসলে সবাইকে আপন করতেও শিখিয়ে দিয়েছিল এমন করেই। সেখানে আপন আপন পরিসর ছিল বটে, তবে তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণ্ডিতেই কেবল সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়েনি। তার ফলে সেকালের জীবনও ছিল ভারী সহজ। আর সেই সহজ জীবনের গল্পই ক’টি সহজ আঁচড়ে বুনেছেন ঈপ্সা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষাসত্রের হোম সায়েন্সের শিক্ষিকা মায়ের সুবাদে যাঁর পড়ুয়াজীবন কেটেছে শান্তিনিকেতন লাগোয়া শ্রীনিকেতনে। বিশ্বকে নীড় বানিয়ে তোলার যে রবীন্দ্রভাবনা, তার আঁচ পড়েছিল শান্তিনিকেতনের সহোদর শ্রীনিকেতনেও। রবীন্দ্রনাথের পল্লি উন্নয়নের ভাবনা বুকে নিয়ে গড়ে ওঠা সেই জনপদটি শান্তিনিকেতনের আদল ছুঁয়ে থাকলেও তার নিজস্বতাও জেগে ছিল ভিতরে ভিতরে। সেই অন্যরকম জগতেই বেড়ে ওঠা লেখিকার, প্রকৃতি আর মানুষের অত্যাশ্চর্য নিবিড় সাহচর্যে।
কেমন ছিলেন সেই মানুষেরা? ছিলেন ‘তানসেন’ গুলি বিলিয়ে চলা, ভেটেরিনারির অধ্যাপক, ছোট-বড় সকলের সেনদা। যিনি বাড়িতে এলে কখনও চা-এর বদলে খেতেন এক কাপ ডালের জল, কখনও আবার পিসির বাড়ি যাওয়ার দলে শামিল হতেন বিনা আপত্তিতে। পড়শির বাড়িতে মাংস আনা হলে, নেমন্তন্ন না পেলে মুষড়ে পড়তেন ডাক্তারবাবু ইন্দুজ্যোতি ঘোষ। ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ নাটকে রানি কল্যাণীর মুকুট নেই দেখে নিজের বিয়ের সোনার মুকুট এনে পরিয়ে দিয়েছিলেন বউদি, শ্রীমতী মীরা ঘোষ। ছিলেন প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। এক ঝড়ের রাত শেষে সবাই যখন ওলটপালট হওয়া বাড়ি ঠিক করতে ব্যস্ত, হঠাৎ একটি মোরগ এসে স্থির দাঁড়িয়ে গেল দোতলার ডাইনিং টেবিলের উপর আর অমনি কাগজ টেনে তাকে আঁকতে বসে গেলেন প্রভাতজেঠু। অপূর্ব বীণা বাজাতেন পদ্মা শ্রীনিবাসন, আর সেতারে পাকা হাত ছিল শিক্ষাসত্রের ইংরেজি শিক্ষক অশোক বাজারির। বাবা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আঁকা আর আবৃত্তির হাতেখড়ির পাশাপাশি এইসব সুর-তাল-ছন্দে বাঁধা হয়ে ছিল জীবন।
আর নামী লোকজনেরা তো ছিলেনই! শান্তিনিকেতন চত্বরে সেকালে সিপাইসান্ত্রির তদবির ছাড়াই তাঁদের অবাধ আনাগোনা। পাঁচ বছর বয়সে লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে চন্দনের ফোঁটা দিতে গিয়ে একবার-দুবার-তিনবারেও ফোঁটা দেওয়া শেষ হচ্ছিল না, আর পুরো সময়টাই হাসিমুখে সেই ভালোবাসার অত্যাচার সহ্য করেছিলেন শাস্ত্রীজি। পড়শি ডাক্তারবাবুর বাগানে ফুল দেখতে এসেছিলেন পদ্মজা নাইডু। আবার ‘অশনি সংকেত’-এর শুটিং চলছে বল্লভপুর পেরিয়ে, বাড়ি থেকে অনুমতি নিয়ে খুদেরা সেখানে সদলবলে হাজির। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, এদিকে সামনে খোদ সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কেউ নেই যে জিজ্ঞেস করা যাবে! এ ওকে ঠেলাঠেলি করে শেষে একজন তাঁকেই জিজ্ঞেস করতে গেল, কিন্তু ঘাবড়ে গিয়ে গুলিয়ে গেল প্রশ্নটাই, ‘সত্যজিৎ রায় আসবেন না?’ জলদগম্ভীর স্বরে উত্তর এল, ‘উনি তো আসেন না।’
সেইসব হারানো মানুষ আর হারানো সময়ের আলোছায়ার কোলাজ ‘শ্রীনিকেতন’ বইটি। শান্তিনিকেতনের কথা আশ্রমিকেরা বলে বলে ফুরোতে পারেননি, কিন্তু পড়শি শ্রীনিকেতন সে আলোর খানিক আড়ালেই রয়ে গিয়েছে। অন্তরঙ্গ স্মৃতির সফরে সেই শ্রীনিকেতনকেই দু’মলাটে ধরে দিয়েছেন লেখিকা। ছোট্ট বইয়ের সংক্ষিপ্ত যাত্রা দ্রুত ফুরোয়, কিন্তু সেই সময়ের গন্ধ ঘিরেই থাকে পাঠককে।
শ্রীনিকেতন
ঈপ্সা বন্দ্যোপাধ্যায়
রাবণ
২০০ টাকা
পাশাপাশি এ-ও বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমুখে যেমন অনেকে নতুন বউঠানের মিল খুঁজে পান, তেমনই কারও চোখে সেখানে উদ্ভাসিত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আদল। এই দ্বিতীয় মতে, চিত্রী রবি ঠাকুরের চোখে ওকাম্পোর ছায়া নিঃসন্দেহে আরও প্রবলতর, কারণ নতুন বউঠান সেখানে দূর গ্রহান্তরের বাসিন্দা।