কাগজ দেখানোর প্রতি অনীহা ক্রমে গাঢ় হয়ে উঠল। হিতাহিতের হিসাব রাখার কথা মাথায় রাখিনি। মাঝেমধ্যেই পরীক্ষার সকালে ডুব মারি আর ফোন সুইচড অফ করে দিই। মেসের মধ্যেও এই সময় নানারকম ভাঙচুর। বন্ধুদের আসা-যাওয়া। চাকরি পেয়ে দূরে চলে যাওয়া। তা সত্ত্বেও সেই খানিক স্যাঁতসেতে আবছায়া জীবনটাকে খুব একটা অসহ্য বলে বোধ হয় না। বরং ভালোই লাগে। মনে হয়, টাকা জরুরি, তবে টাকা-ই জরুরি নয়।
প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক
১৬.
পুকুরচুরির না হয় রূপকের দোহাই আছে; চোখে দেখা যায় না, টের পাওয়া যায় শুধু। নির্মলদা কলকাতায় এসে হাড়ে হাড়ে টের পেল এবং দেখলও, যে, তার আস্ত ঘরখানাই চুরি গিয়েছে!
রূপকের ছিঁটেফোটা মাত্র নেই সেখানে। জনাকয় অচেনা ছেলে সে-ঘরে ভিড় করে আছে, যেন হকের জায়গা। চৌকিগুলো আকাশে ঠ্যাঙ তুলে আয়েশ করছে আপাতত। তাদের কোলে কোলে যাবতীয় মালপত্তর ঠাসা। দূরের ট্রেন ধরার আগে হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষারত যাত্রী যেন সব। এক কামরা ঘরে জনা চার-পাঁচেকের জিনিসপত্র, ফলত তিল বেচারিও চৌকাঠের ওপারে। আর সেই সৃষ্টির তুমুল ওলটপালটের ভিতরই কমপিউটর বসিয়ে একজন ওয়ার্ল্ড কাপ গেমে মত্ত, অন্যরা দর্শক। এরকমই এক মুহূর্তে যার ঘর সে গুড সামারিটান হয়ে দরজায় উঁকিঝুকি দিতেই সুভদ্র ক্যামেলদের একজন বলে উঠল, ‘কাউকে খুঁজছেন?’ কী আর জবাব দেবে বেচারি আগন্তুক! ভ্যাবাচাকা তার মুখখানি দেখে আমাদেরই বরং মনে হল, আহা বড় আশা করে এসেছে গো, কাছে টেনে নেওয়াই উচিত।
দোস্তির সেই শুরু। বয়সের ক্যালেন্ডার মেসে তামাদি। তখন আমরা পুরনো মেস ছাড়ছি। তড়িঘড়ি। এমন রাতারাতি পালাবদলে আমাদেরই দোষ অন্তত চোদ্দ আনা। মেস তো বদমাস কোম্পানিও বটে। যেখানে বারণ, সেখানেই বারুণী নদীর ডাক। যা করলে ঝামেলা হবে সেই সব কাজেরই মেলা বসে যায়। সংসার-অভিজ্ঞ মালিকরা যতই আমাদের সাবানজলে চুবিয়ে রেখে কেচেকুচে পরিষ্কার করতে চান, সস্তার ক্ষার কিছুতেই যেন জলে ধুলে যায় না। আর কম বয়সে রাগের শামিয়ানা অল্প হাওয়াতেই ফুঁসে ওঠে। ‘মানছি না মানব না’-র জোর তখন কিঞ্চিৎ বেশিই। কিছু কিছু খেসারত তাতে দিতে হয় বইকি। যেমন, এই উচ্ছেদের নোটিশ। তবে, জীবনের সেই সব ওঠা-পড়া আমরা গায়ে লাগতে দিইনি। একদিকে বরং লাভই হল। আমাদের নিজস্ব চৌহদ্দিতে আটকে থাকা মেস আরও অনেককে ছুঁয়ে ফেলতে পারল অনায়াসে। মেসের সঙ্গে জীবনের এই এক মিল। খোপে তাকে বেঁধে দিলে সে যে কী করে খোপ কেটে বেরিয়ে যায়, জানতে এখনও ঢের বাকি। তো নতুন এই মেস গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করতে করতে মনে হল, মেস-ও আসলে বাঁধানো পাড়ের ঝিল হয়ে থাকতে নারাজ; সে আমাদের ছোটনদী; এর ওর সঙ্গে মিলেমিশে এঁকেবেঁকে তার চলা। পুরনো অনেকেই কাজ ফুরিয়ে মেস ছেড়ে গিয়েছে। নতুন বাসিন্দা হয়ে এই মেসে আসবে বুবু, আর একটু পরে উদয়নদা, রামানুজ, দেবোপম, চম্পকরা। এই দুই পর্বের মাঝে হাইফেন আমাদের নির্মলদা। এসেছে সে অসম থেকে, কাজের বাড়ি কলকাতায়। এখানে তার পরিচিতর একটা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকে। সেই পরিচিতের আর এক ঘর হবে আমাদের ভবিষ্যৎ মেস। মাঝে নির্মলদা বাড়ি গিয়েছিল। আর এর মধ্যেই আমরা উচ্ছেদমানুষ। অনেকদিন পর আবার ব্রোকারের দ্বারস্থ হওয়া। তিনি মোটামুটি এতদিনে পরিচিত। যে চা দোকান তাঁর অফিস কাম আস্তানা, তা আমাদের অনেকেরই নাস্তার ঠেক। অতএব চোখের আলোয় চোখের দেখা একরকম ছিলই। তো তিনি আমাদের জরুরি অবস্থা বুঝেই একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা জনাকয় লটবহর নিয়ে এসে উঠলাম নির্মলদার সেই এক কামরা ঘরে। ক’-দিন পর দরজায় তার ছায়া।
আমরা গুছিয়ে নিলে পরে নির্মলদা মেসেরই একজন হয়ে গেল। আর নির্মলদার ঘর হয়ে গেল মেসের নাটমন্দির। সে কবে গেয়েছি আমি তোমার কীর্তনে বলে আমরা জড়ো হই যত কৃতার্থ দোহার। আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিল যে, দুই ঘরের মাঝে যা কিছু সিঁড়ি-দরজা ইত্যাদি তা দরকার পড়লে উড়ে যায় মার্কেজের ম্যাজিকে। নির্মলদার পেশা তার প্রোডাক্ট চিনিয়ে কোম্পানির বিক্রি বাড়ানো। মাঝেমধ্যে ট্যুরে যায়, এসে গল্প করে যে কীভাবে কার সঙ্গে কথা বলে নিজের কাজ হাসিল করেছে। কথার নাকি মারাত্মক জাদুশক্তি। অথচ, কথা কম কাজ বেশি-ই নাকি কাজের দুনিয়ায় দস্তুর। নির্মলদার গল্প বলছে, কথা-ই কাজ। মানুষের বুকের ভিতর টলটলে জল। কথা বঁড়শিতে গেঁথে সেই জলে ফেলে অপেক্ষা করতে হয়। মানুষের চোখের উপর ভেসে থাকে ফাতনা। তাতে নড়াচড়া পড়লেই বোঝা যায়, কথা তার কাজটি করেছে। তবে, শুধু কথায় তো আর চিড়ে ভেজে না। কথা আর মানুষকে মিলেমিশে যেতে হয় ব্যবহারের গুণে। সেই কথামানুষের সঙ্গে যদি উলটোদিকের মানুষটির একান্তে দেখা হয়ে যায়, তাহলেই কাজ সারা। বাকি তো ব্যবসায়িক ফর্ম্যালিটি। সেটুকু সারতে আর কতক্ষণ!
এদিকে চাকরির হাটে আমরা পড়ে আছি অবিক্রিত। সেই সব গল্প শুনি আর নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবি, তুমি তো তেমন ফেরিওলা নও, তাহলে তোমার হবেটা কী! তবে নির্মলদার কথা কিংবা গল্পের গুণেই বোধহয়, একদিন মনে হতে শুরু করল, আসলে হাটবাজারের ব্যাপার পুরোটাই এ মায়া প্রপঞ্চময়। চ্যানেল ফাইলে ঢোকানো সার্টিফিকেটগুলোয় কোথাও তো আমি নেই। যা দেখিয়ে নিজেকে চেনাতে যাই, তা যদি আমি নাই-ই হই, তাহলে আর চেনা কীসের! আপনাকে এই জানাই ফুরোয় না, তো আপনাকে চেনানো! নিজের থেকে বড় সার্টিফিকেট কি আর কাগজ হতে পারে! অতএব সেই মোক্ষম প্রশ্নের কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ি, আমি কে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখি সাঁতারই তো শিখিনি। জীবনকে আর বলব কী করে, এই তোর জলকে নেমেছি!
……………………………
যাঁদের টিভি নেই বা দেখার সুযোগ নেই, রাস্তায় তাঁরা ছোট রেডিওখানা হাতে নিয়ে চলেছেন; ধারাবিবরণী শুনে কল্পনা করে নিচ্ছেন দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ নামে দু’জন মানুষ কী করে যেন একটু একটু করে রূপকথা হয়ে যাচ্ছেন। আকস্মিকের খেলা তখন অসম্ভবের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে বেশ জোরদার। কলার-তোলা অধিনায়ক জার্সি খুলে যে-নিশান উড়িয়েছিলেন, তাতে আমাদের গোটা প্রজন্মটারই মুড সেট হয়ে গিয়েছিল– হবে না মানে! হতেই হবে।
……………………………
এই সাত পাঁচ কারণেই বোধহয় কাগজ দেখানোর প্রতি অনীহা ক্রমে গাঢ় হয়ে উঠল। হিতাহিতের হিসাব রাখার কথা মাথায় রাখিনি। মাঝেমধ্যেই পরীক্ষার সকালে ডুব মারি আর ফোন সুইচড অফ করে দিই। মেসের মধ্যেও এই সময় নানারকম ভাঙচুর। বন্ধুদের আসা-যাওয়া। চাকরি পেয়ে দূরে চলে যাওয়া। তা সত্ত্বেও সেই খানিক স্যাঁতসেতে আবছায়া জীবনটাকে খুব একটা অসহ্য বলে বোধ হয় না। বরং ভালোই লাগে। মনে হয়, টাকা জরুরি, তবে টাকা-ই জরুরি নয়। নির্মলদা বেশিরভাগ দিন সকালে আমাদের ওঠার আগেই বাজার করে আনে। রোববার একসঙ্গে আমরা মুদির দোকানে কেনাকাটা করতে যাই। প্রতিদিন সকাল সকাল সে কাজে বেরিয়ে যায়। চারা পোনা হোক বা মাংস দুই-ই সে খায় তৃপ্তি করে। ফেরে সেই রাতে। ছুটির দিন দুপুরে তার আয়েশি অভ্যাসে মিঠে পাতা-একশো বিশ-কিমামের স্বাদ আর গন্ধ যখন ছড়িয়ে পড়ে, দেখি, সে-জীবনের গায়ে অভিযোগ লেগে নেই। অতৃপ্তি নেই। অযথা দৌড় মিশে নেই। খাটনি আছে। খাটনির ভিতর বেঁচে থাকার ছোট ছোট তৃপ্তি-আনন্দও আছে। শহরের ভিতর ছোট একটা গলি হয়ে থেকে যাওয়ার তৃপ্তি। এই বিরাট ব্যস্ত শহরটায় নিজেকে টিকিয়ে রাখা সহজ নয়। আবার খুব কঠিন কী! আসলে নিজেকে শহর না করে ফেললেই হল। তাহলেই ধুলোবালি-কংক্রিট-আবর্জনা-দূষণ। নিজের কাছে নিজের ঢাকা পড়ে যাওয়া। তাহলেই বড় উঁচু উঁচু হয়ে বাঁচা, অথচ কারুর সঙ্গে কারুর মুখ দেখাদেখি নেই। তাহলেই এর বাড়ির জল ওদিকে গড়িয়ে গেলে তুলকালাম বেধে যায়। এই শহরের ভিতর খুঁজেপেতে দেখলে এখনও যেটুকু মাটির দেখা মেলে, তা তোলা আছে কোনও কোনও মানুষের কাছেই। সেই সব মানুষ শহরে লেখচিত্রে খুদে খুদে বর্গ-ঘর। এমনিতে আলাদা করে বলার কিছু নেই। তবে তাদের হিসাবের বাইরে রাখলে শহরের স্থানাঙ্ক নির্ণয়ে ভুল হয়ে যায়। নির্মলদার সেই আটপৌরে আনন্দে বাঁচা যেন ভরসা দিয়ে বোঝাচ্ছিল, সফলতা-নিষ্ফলতার এক্স-ওয়াই অক্ষে আমরা ছোট বর্গ ঠিকই, তবে হিসাবের বাইরে নই।
নির্মলদা টিভি কিনল বলে আমাদের আনন্দের শেষ নেই। তার ঘর তো আগাগোড়া আমাদেরই। চ্যানেল পালটে যা খুশি দেখা যায় ইচ্ছেমতো। সেই সঙ্গে সন্ধের আড্ডাগুলোয় যে যেমন পারে এসে বসে যায়। গল্পে গল্পে জলে-স্থলে-বনতলে ঘুরে বেড়াই আমরা। না আছে সময়ের ঠিক, না আছে কথাবার্তার। এই টিভিতেই ২০১১ সালের বিশ্বকাপ। যে শাপমোচনে উত্তম-সুচিত্রা নেই। আছে এক যুবরাজ-ধোনি। আমাদের বয়সি সকলেরই বুকে ২০০৩-এর দীর্ঘশ্বাস পাথরের নিচে চাপা। তর্কযোগ্য যদিও, তবু অমন অতিমানবিক অস্ট্রেলিয়া আর দ্বিতীয়বার দেখা গিয়েছে কি-না সন্দেহ। তা সত্ত্বেও ফাইনালের দিন আত্মবিশ্বাসে টান পড়েনি, সিনা টানটান সকলের। বছরকয়েক আগের কথা। ইডেনে সেই টেস্ট হচ্ছে। টিফিন টাইম পেরিয়ে পাশের ক্লাসঘরে মিনিট কয়েক এক্সট্রা দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও স্যরেরা বিশেষ বকাঝকা করেননি। যাঁদের টিভি নেই বা দেখার সুযোগ নেই, রাস্তায় তাঁরা ছোট রেডিওখানা হাতে নিয়ে চলেছেন; ধারাবিবরণী শুনে কল্পনা করে নিচ্ছেন দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ নামে দু’জন মানুষ কী করে যেন একটু একটু করে রূপকথা হয়ে যাচ্ছেন। আকস্মিকের খেলা তখন অসম্ভবের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে বেশ জোরদার। কলার-তোলা অধিনায়ক জার্সি খুলে যে-নিশান উড়িয়েছিলেন, তাতে আমাদের গোটা প্রজন্মটারই মুড সেট হয়ে গিয়েছিল– হবে না মানে! হতেই হবে।
এই করতে করতেই ফাইনাল। পাড়ায় এ-বাড়ি ও-বাড়ি যে যতটা পেরেছে উঁচুতে টাঙিয়েছে জাতীয় পতাকা। যেন পতাকা যত উঁচুতে তোলা যাবে, জেতার সম্ভাবনা তত বেশি। তা জাহির খানের ওভার যখন শুরুতেই বেলাইন হল তখনই আমলকি বনের বুক কাঁপে দুরুদুরু। তারপর তো চলল তাণ্ডব। তাও কেমন যেন একটা বিশ্বাস হচ্ছিল যে, হয় শচিন, নয় সেহবাগ, নয় কাইফ-যুবরাজ কেউ-না-কেউ ম্যাচ বের করে দেবে ঠিক। ট্রফিটা সৌরভের হাতে না উঠলে বিশ্বের কী যেন একটা ছন্দপতন অবশ্যম্ভাবী, এমনটা আমরা বাঙালিরা ধরেই নিয়েছিলাম; দুর্ভাগ্যবশত, অস্ট্রেলিয়া ভাবেনি। দ্রাবিড়-সেহবাগ আউট হয়ে যেতে সেই যে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোতে বেরোতে আর বেরোল না, চাপা পড়ে গেল পাথর-সময়ে। আর গোপন গলাব্যথার মতো থেকে গেল আজীবন। জানলা থেকে, ছাদ থেকে পতাকা সব ধীরে ধীরে নেমে সরে যাচ্ছে দৃষ্টি থেকে। পাড়াময় এমন অতলান্ত বিষাদের স্মৃতি আর দ্বিতীয় নেই। যেখানে জটলা-হল্লা হওয়ার কথা সে সব জায়গা যেন দশমীর প্যান্ডেল। আলো বলে সেখানে কিছু কল্পনা করাই মুশকিল। গোটা পাড়া যেন নির্বাক চলচ্চিত্র। মুখ বুজিয়ে যে যার কাজ করে যাচ্ছে মাত্র। সন্ধে মাড়িয়ে ফাঁকা রাস্তায় দু’জন শুধু গজরাতে গজরাতে বলে চলে গেল- এত রান দিলে হয়! যেন পন্টিং খেটে ব্যাটে রান করেননি, রান দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা হোক, সেও এক সান্ত্বনা যে, বেশি রান নেহাত দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, নইলে তো ম্যাচ আমাদেরই। ‘১১-তে এসে আমাদের স্কুলড্রেস ছোট হয়ে গেছে, কলেজও শেষ। সেই সন্ধের বিষাদ মুছবে না জেনেও সকলেই তাকিয়েছিলাম ধোনি-র দিকে। তখন রাত নেমেছে। ধোনির ব্যাটে এসে গেল সেই বহু কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। মনে মনে দেখতে পেলাম, পুরনো জানলায় সরে যাওয়া সেদিনের পতাকা আবার যেন ফিরে এসেছে। উড়ছে হাওয়ায়। কিন্তু পুরনো বয়স! তা কি আর ফিরে পাওয়া যায় নাকি! নির্মলদা বলল, ‘চলো বাইরে যাই।’ বেরিয়ে দেখি, রাস্তাটা যেন আনন্দে টলটলে ঝিল। তাড়াতাড়ি এইটবি পৌঁছলাম। জনস্রোত বইছে সেখানে বহুদিন পর আনন্দ পুরস্কার পেয়ে। কেউ চেনা নয়, কেউ অচেনাও নয়। গোটা দেশটাই যেন নেমে এসেছে রাস্তায়, আলিঙ্গন করছে একে অপরকে। আর সেই অবিরল মুগ্ধধারার ভিতর কোথাও যেন থেকে গিয়েছিল ২০০৩-এর স্কুলবালক, বালিকারাও। একদা অকস্মাৎ ফিকে হয়ে গিয়েছিল যাদের সন্ধে, জীবন তাদের একেবারে খালি হাতে ফেরায়নি। দিয়েছে পোয়েটিক জাস্টিস!
জীবনের এই সমুদ্রস্বভাব চিনতে শিখেছি সেই বেকার মেসের দিনেই। একটা দুনিয়া বলছে, বাপু হে তুমি ফেলনা! ঠিক তার পাশেই যেন যমজের মতো আছে আর এক দুনিয়া। সে কাউকে ফেলে দেয় না, উচ্ছিষ্ট করে না। বরং সেই ড্যাম্প ধরা আবছা অনুজ্জ্বল পৃথিবীটার ভিতর একখানা আশ্চর্য চকচকে আধুলি রাখা আছে। চেনা আধুলি। পরে তা হারিয়ে যায় বলেই জীবনের হিসাব মেলানো ভার। সেইসব দিন তাই কানে কানে যেন বলে যাচ্ছিল, পৃথিবীর কেউ ভালো তো বাসে না, এ পৃথিবী ভালো বাসিতে জানে কথাটা মোটেও সত্যি নয়। কেন কে জানে আমাদের আশেপাশের সকলেই খুব আত্মবিশ্বাসী; তাঁরা যেন জানেন, আমাদের টিকিট কাটা অনেক দূরে। দূরপাল্লার যান একটু জিরিয়ে নিচ্ছে মাত্র! তাতে দোষের কিছু নেই, অস্বাভাবিকও কিছু না। চাকরিহীন মানুষ মানেই বেকার কেন হতে যাবে! তার কাজ নেই বুঝি! যে-মাসি সবুজ বাঁধাকপি পাতে দিয়ে মেস চিনিয়েছিলেন, তিনিই এবার পৃথিবী চেনালেন। একদিন বললেন, ‘আমার নাতি-নাতনিকে পড়াও দিকি।’ এতে আর আপত্তির কী! শুরু হয়ে গেল। পৃথিবীর এক গোলার্ধ যখন কাউকে অপাঙক্তেয় করে, অপর গোলার্ধ তাকেই চেয়ারে বসায়। সাধে কী আর পৃথিবী গোল! একদিকে অন্ধকার বলেই অন্যদিকে আলো। দুই পোড়োর একজন শান্ত, অন্যজন দুরন্ত। দুরন্তটির সঙ্গে নানা কিসিমের গল্প করে ভাব জমাই। গল্পের সন্ধে এত জমজমাট যে, পড়া না-করলে আমি যদি আসা বন্ধ করি তাহলে সব মাটি। অতএব পড়া দিব্যি হয়ে যায়, তাতে সকলেই খুশি। যত দিন যায় পড়াশোনার দলও বাড়ে। বেশ কিছুদিন পরের কথা। মেসে তখন অন্য মাসি কাজ করছেন। একবার মাসমাইনের টাকা দিতে গেলাম, বললেন, ‘এক কাজ করো পরের মাস থেকে আর টাকা দিতে হবে না, আমার ছেলেকে পড়িয়ে দাও।’ সকালবেলা সে আমার কাছে চলে আসে। যতক্ষণ না তার মা কাজ সেরে বাড়ি ফিরছে, ততক্ষণ পড়া আর গল্প-খেলায় দিব্যি কেটে যায়। মোটকথা দেখলাম, একটা আস্ত পৃথিবী রোজ রোজ ঘুরে যাচ্ছে অবলীলায়, অর্থ অনেক দৌড়েই কিছুতে যার সঙ্গে পেরে ওঠে না। এই ময়লাটে জীবন সময়মতো নিজেকে কেচে সাফসুতরো করে নিতে জানে দিব্যি। অবসাদ কিংবা ক্লান্তিতে ইউজ-অ্যান্ড-থ্রো হয়ে ওঠে না কিছুতেই।
তারপর একদিন পড়ানোর পাট চুকে গেল। ঢুকে পড়লাম সেই দৌড়েই। দৌড় আর ফুরোয় না। পালবাজারের মোড়ে হারিয়ে যাওয়া আধুলি শেষমেশ কিছুতেই আর খুঁজে পাওয়া গেল না। মোড়টাও বদলে বদলে গেল। আলো বাড়ল। লোক বাড়ল। নতুন নতুন দোকান বাড়ল। আমাদের বয়সও কিঞ্চিৎ বাড়ল। অনেকদিন পরে ছুটির বেলায় ঝিলের পারে আমাদের সেই পুরনো মাসির সঙ্গে দেখা। রোদ এড়িয়ে ছায়ায় এসে দাঁড়াই। কথা বলি, গল্প করি খানিক। তখন তিনি আমাদেরই মতো কোনও এক মেসে রান্না করে ফিরছেন। এটা সেটা কথা হওয়ার পর বললাম, ‘অনেক তো হল, এবার তো একটু রেস্ট নিতে পারো। টাকা নিয়ে যখন…।’ মাসি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘টাকাপয়সার ব্যাপার না গো, কাজ করি, না করলে শরীরটায় জং পড়ে যাবে। অলসতা হবে। যদ্দিন পারি, কাজ করি।’ তার পর আরও দু’এক কথার শেষে আমি যেন ভালো থাকি বলতে বলতে বাড়ির পথ ধরলেন। আমিও পা বাড়াই। পিছনে পড়ে থাকে চেনা রেললাইন, কলোনির ঘর, সরষের তেলের মিল, শনিমন্দির। পিছনে পড়ে থাকে মেসে ফেরার রাস্তা। আর তখনই সেই আধুলির সঙ্গে চকিতে আমার দেখা হয়ে যায়। যে-আধুলি খুব চেনা, জীবনের সঙ্গে যে কথার খেলাপ করে না কখনও। বাড়ি ফেরার রাস্তায় চোখ তুলে তখন মনে হয়, কাছেই কোথাও যেন দাঁড়িয়ে আছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দেখছেন আমাকে, বুঝি হাসছেন আমার দিকে তাকিয়েই।
…পড়ুন মেসবালক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৪। বেকারদের মেসে বিশ্ব এসে মেশে
পর্ব ১৩। মেস আমাদের শিখিয়েছে, দেশ অনেক রকম
পর্ব ১২। মেসবাসীর হিসাবশাস্ত্র এমন কুটিল যে স্বয়ং কৌটিল্যও তল পান না
পর্ব ১১। ছেড়ে যাওয়া ঘরে মেরা কুছ সামান থেকেই যায়
পর্ব ১০। বই বন্ধ করলেও, বন্ধ হয় না কিছু কিছু বই
পর্ব ৯। বোবার শত্রু নেই, বন্ধু তো আছে
পর্ব ৮। মেস কি কোনও নারীচরিত্রবর্জিত একাঙ্ক নাটক!
পর্ব ৭। যে ভাতের হোটেলে মাছকে ‘তেরা ক্যায়া হোগা কালিয়া’ বলতে হবে না, সেখানেই রোজের বেঞ্চি বুক করতাম
পর্ব ৬। মেসের বাড়ি না থাকলে দেশের বাড়িকে ঠিক চেনা যায় না
পর্ব ৫। মেসে থাকতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিছানা আর বেডের মধ্যে বিস্তর তফাত
পর্ব ৪। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কখনও মেসে থাকেননি
পর্ব ৩। মেস আসলে জীবনের ক্রিকেট-সংস্করণ
পর্ব ২। আদরের ঘরের দুলালদের সদর চেনাল মেস
পর্ব ১। মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।