সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার যে, ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্পটি অধিগ্রহণ করেছিল, তার বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি বলছে যে, ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্পটির বাস্তবায়নের ফলে গত পাঁচ বছরের মধ্যেই এ দেশের অন্তত ১২ কোটি পরিবারের জলসমস্যা দূর হয়েছে। আর বহুদূর থেকে জল টেনে আনার কাজটি লাঘব হওয়ার ফলে মেয়েদের হাতে থেকেছে বেশ কিছু বাড়তি সময়। এই সময়টা তারা কাজে লাগিয়েছেন শ্রমবাজারে যুক্ত হয়ে, সম্পদ তৈরি করে। আরও চমকপ্রদ বিষয় হল এই যে, দেখা যাচ্ছে মোটের ওপর মহিলাদের জল বয়ে আনার সময়ের ৮ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার ফলে, তাদের কর্মক্ষেত্রে বা শ্রমের বাজারে যোগদান বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সমানুপাতিক হারে, সাড়ে ৭ শতাংশ।
‘চৈত্রের মধ্য দুপুরে পাখিরাও ডানা গুটিয়ে নেয়,
দূর শহরের রাস্তায় বাবুদের ভিড় নেই,
গাঁয়ের কুকুরগুলি ঢুকে যেতে চায় উঠোনের ছায়ায়;
আমাকে এখন যেতে হবে দূর নদীর চড়ায়,
বালি খুঁড়ে তুলে আনতে হবে ফোঁটা ফোঁটা জল
তারপর ফিরে আসব খরায় ফাটা মাঠ, শুকনো পুকুর
আর টলটলে জলে ভরা নতুন ইঁদারার পাশ দিয়ে–
বাবুদের ইঁদারা…
…মা, আমি এক চণ্ডালিকা’
কবি সব্যসাচী দেবের কবিতা ‘চণ্ডালিকা’, ক্লাস স্ট্রাগল, কাস্ট স্ট্রাগল আর জেন্ডার স্ট্রাগলের ত্রয়োব্যঞ্জনা। কবিতার প্রোটাগনিস্ট নিম্নবিত্ত পরিবার তথা নিম্নবর্গীয় সমাজের এক মেয়ে। রাঢ়বঙ্গের ভদ্রসমাজ ‘ছোটলুকের বিটি’ বলে তাকে গ্রাম-ইদারা থেকে জল তুলতে দেয় না, আর পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক কাঠামো কলসি হাতে তাকে রোজ জল তুলতে পাঠায় গোটা পরিবারের জন্য। জল তোলার মতো বিনি পয়সার কাজ যেহেতু মেয়েদেরই, তাই আজন্মের বিন মজুরির দিনমজুর প্রান্তিক মেয়েরা রোজ পায়ে হেঁটে, মাথায় আর কাঁখে কলসি নিয়ে জল তুলতে যায় ‘দূর নদীর চড়ায়’।
দূর মানে কতদূর? কে জানে! আচ্ছা, বব ডিলান যখন শান্তি, সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্যের দ্যোতনায় লিখলেন, ‘হাউ মেনি রোডস মাস্ট অ্যা ম্যান ওয়াক ডাউন?’, তিনি কি ইনক্লুড করেছিলেন এই প্রান্তিক মেয়েদের?
কী জানি বাপু! ওই এক রসকষহীন সাদাকালো স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিপোর্ট ছাড়া, মেয়েদের হেঁটে যাওয়া সড়ক পথই হোক কিংবা জীবনযুদ্ধের পথ, কোনওটিরই হিসেবনিকেশ জগৎ সংসার বিশেষ রাখে বলে তো মনে হয় না! এই যেমন ধরুন এক্ষুনি যদি বলি যে, এদেশের প্রান্তিক মেয়েরা এখনও প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে কুড়ি কিলোমিটার পথ হেঁটে জল তুলতে যান, বিশ্বাস করবেন? আমি বলছি না কিন্তু, এ কথা ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের ২০১৮ সালের জুলাই মাসের প্রতিবেদন বলছে। অথচ নিজেকে চিমটি কেটে হলেও এই বাস্তবটা বিশ্বাস করাতে কষ্ট হয় যে, এ দেশের গড়পড়তা অন্তত ৬০ কোটি মানুষ প্রতিদিন প্রবল জলকষ্টে জীবন কাটান আর ফি-বছরে স্রেফ পানীয় জলের অভাবে প্রাণ হারান অন্তত এদেশের অন্তত দু’-লক্ষ মানুষ।
এত কিছুর পরেও এ দেশের পূরণযোগ্য ভূগর্ভস্থ যে জলের ৪০ শতাংশই আসতে পারত গঙ্গা থেকে, কেবলমাত্র দূষণের কারণে তা জনজীবনে ব্যবহারযোগ্য থাকে না। কিন্তু জল ছাড়া তো জীবন বাঁচে না, তাই তার আহরণে যেতেই হয়। কাছে না পাওয়া গেলে দূরে, আরও দূরে; যতদূর গেলে জলের দেখা মেলে, ততদূর। আর যায় কারা? অবশ্যই মেয়েরা। দূষণের কারণে নষ্ট হওয়া প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি আমরা পূরণ করে নিই বিনিপয়সার নারীশ্রমসম্পদের বিনিময়ে। ‘জলসংকট ও ভারতের মেয়েরা’ প্রবন্ধে আলেজান্ড্রা বারটন হিসেব দিচ্ছেন যে, এদেশের প্রান্তিক মেয়েরা প্রতিদিন গড়পড়তা প্রায় ৯০ লিটার জল বয়ে আনে। একেকবারে বয়ে নিয়ে যায় প্রায় ১৫ লিটার। অন্তত বার ছয় তারা যাতায়াত করে এইভাবে। প্রতিদিন, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা পেরিয়ে…
বচ্ছরভর বয়ে চলা এই ভারের অবশ্যম্ভাবী ভার পড়ে মেয়েদের শরীর ও মনে। নিত্যকার এই যাপনে, তাদের যে শারীরিক ও মানসিক শক্তিক্ষয় হয়, তাকে যদি চালনা করা যেত অন্য খাতে, অন্য কোনও গঠনমূলক বা সম্পদ তৈরির কাজে, তাহলে কি মেয়েদের তথা গোটা দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির পথটাই সুগম হত না?
এ সব কথা ক’দিন আগে অবধিও একবগগা ফেমিনিস্ট আর্গুমেন্ট বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার যে, ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্পটি অধিগ্রহণ করেছিল, তার বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি বলছে যে, ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্পটির বাস্তবায়নের ফলে গত পাঁচ বছরের মধ্যেই এ দেশের অন্তত ১২ কোটি পরিবারের জলসমস্যা দূর হয়েছে। আর বহুদূর থেকে জল টেনে আনার কাজটি লাঘব হওয়ার ফলে মেয়েদের হাতে থেকেছে বেশ কিছু বাড়তি সময়। এই সময়টা তারা কাজে লাগিয়েছেন শ্রমবাজারে যুক্ত হয়ে, সম্পদ তৈরি করে। আরও চমকপ্রদ বিষয় হল এই যে, দেখা যাচ্ছে মোটের ওপর মহিলাদের জল বয়ে আনার সময়ের ৮ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার ফলে, তাদের কর্মক্ষেত্রে বা শ্রমের বাজারে যোগদান বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সমানুপাতিক হারে, সাড়ে ৭ শতাংশ।
এ-এক অভূতপূর্ব সাফল্য। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে, যেখানে কর্মক্ষেত্রের সাফল্য নয়, মেয়েদের আইডেন্টি তৈরি হয় তার সাংসারিক নৈপুণ্যে আর সুখী গৃহকোণে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে দেখতে পাই যে, কাজের বাজারে মেয়েদের যোগদানের নিরিখে, ২০২৩ সালে ভারতের অবস্থান বিশ্বের ১৮৭টি দেশের মধ্যে ১৬৫তম। এ-বড় লজ্জার কথা। স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও যদি এ দেশের শ্রমের বাজারে মেয়েদের মুক্তি না-ঘটে, যদি তাদের গতিপথ এখনও আবর্তিত হতে থাকে সংসারে জল তোলা আর ভাত রাঁধার বৃত্তে, তাহলে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কান্ডারি তথা আজাদ হিন্দ সরকারের মহিলা উন্নয়ন মন্ত্রী, ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গলের কথা মনে করে মেনে নিতেই হয় যে, ১৯৪৭ সালে আমরা কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতাই পেয়েছি। পাইনি অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক স্বাধীনতা, অর্থাৎ কিনা পূর্ণ স্বাধীনতা।
এমন অবস্থায় ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্পটি বিশেষ আশার আলো দেখায়। যদিও, রিপোর্ট অনুযায়ী দেখতে পাচ্ছি যে, জলকষ্ট মিটে যাওয়ার ফলে বেঁচে যাওয়া সময়ে মহিলারা যে শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন, তা মূলত পারিবারিক চাষআবাদ বা পশুপালন সম্পর্কিতই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এতে অবশ্যই ‘সম্পদ’ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ভয় হয় যে তা নিতান্তই বিনামূল্যের ঘরোয়া শ্রম হয়ে থেকে যাবে না তো? উৎপাদিত সম্পদের মূল্যভাগ, পাবেন তো মেয়েরা? তা না-হলে দেশীয় সম্পদ হয়তো সৃষ্টি হবে, কিন্তু নারী উন্নয়নের পথটি অধরাই থেকে যাবে।
কী করা যায় তাহলে?
আচ্ছা, যদি আসন্ন এল.আই.সি-র ‘বিমা সখী যোজনা’-র মতো (যা আগামী এক বছরের মধ্যে অন্তত এক লক্ষ গ্রামীণ মহিলাকে মাসিক ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগারের সুবিধা করে দেবে) নানা জাতীয় কর্মসংস্থানকারী প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায় এই মেয়েদের, তাহলে?
তাহলে হয়তো ঘরের চৌকোণ পেরিয়ে, প্রান্তিক মেয়েদের পরিচয় ঘটবে বৃহত্তর বহির্বিশ্বের সঙ্গে। তাদের কাজ, শুধু বিনামূল্যের ঘরোয়া শ্রম হয়ে না-থেকে, জায়গা করে নেবে অর্থকরী বাজারেও। আর সেই অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করে মুছে দেবে জাতপাতের সংকীর্ণতাকে।
তখন হয়তো আমাদের কবিতার চণ্ডালিকারা জেন্ডার স্ট্রাগল, ক্লাস স্ট্রাগল আর কাস্ট স্ট্রাগলের সব যুদ্ধ জিতে পূর্ণ স্বরাজ প্রাপ্ত হবে, একসঙ্গেই।