কবি হেলাল হাফিজের জীবনের প্রথম ঘটনা, যার ফলে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইতে নিজেকে তিনি উজাড় করে দেবেন। দ্বিতীয় ঘটনা, একান্ত প্রেমিকা হেলেনের অন্যত্র বিয়ে। ’৭৩ সালে সম্পর্কচ্যুতি আর পিতৃবিয়োগ হেলাল হাফিজের সারা জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল। বিপুলা পৃথিবীতে সম্পূর্ণত একা হতে হল তাঁকে। কবি-বন্ধু আবুল হাসান ছিলেন, ছিলেন হুমায়ুন কবিরও। নিজেদের আন্তরিক আড্ডা আর রোমাঞ্চ অভিযানের কোনও কমতি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় নয় মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের দিনগুলোতে যে তরুণ সমাজ আশাভঙ্গের বেদনায় দীর্ণ হচ্ছিলেন, তিনি তাঁদের একজন। নিজেদের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে জৈবসারে অরণ্য নির্মাণের কথা বলেছিলেন তিনি।
আমি, একটু অন্যভাবে যে কবিতা কেউ আজকাল পড়ে না, যাকে কেউ চেনে না, সেসব কবিতা আর কবিতাযাপনের দিকে ঝুঁকেছি বেশ কিছু বছর হল। তাহলে, হেলাল হাফিজ ‘স্মরণ’ রচনায় প্রবৃত্ত হলাম কেন? আমার দিক থেকে প্রথম কারণ, বাংলাদেশে ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর, সারাদেশ জুড়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ পত্তনের চেষ্টার সময়ে, একজন বাংলা ভাষার কবির সম্পূর্ণ একা একটি হোটেলের ওয়াশরুমে মরে পড়ে থাকা মেনে নেওয়া যায় না।
প্রায় সকলেই আমরা বলছি, এটি নতুন সময়। তাহলে, একজন কবির খেয়াল রাখবে না কেন রাষ্ট্র? কেবলমাত্র বিতাড়িত ব্যবস্থার সুবিধা পেয়েছিলেন বলেই এই ব্যবস্থা থেকে তিনি পরিত্যক্ত হবেন? আর সুবিধাই বা কি? রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তো তিনি প্রথম বইয়ের জন্য প্রাপ্যই ছিলেন, আর বাকি থাকে চোখের চিকিৎসার জন্য সরকারি অর্থসাহায্য। অন্য কোনও বিলাস বা বাহুল্যের কথা তো শুনিনি। একটু রাষ্ট্রীয় যত্ন যদি পেতেন হয়তো আরও কিছুদিন তাঁকে আমাদের মধ্যে পেতাম।
এক টানে এই কথাগুলো লেখার পর আমার মনে পড়ল কয়েকটা বাক্য– ‘মানুষ না বোঝে যদি আরেক মানুষ/ আমি আহত হবো না, / আহত হবো না।/ কবিতার কসম খেলাম আমি শোধ নেবো সুদে ও আসলে,/এবার নিহত হবো’– মনে পড়ার পর লিখতে ইচ্ছে হল তাঁকে নিয়ে। এখন, এই স্বল্পদৈর্ঘ্য গদ্যে তাঁর কিছুই যাবে আসবে না জেনে। তিন বছরেই মাতৃহারা শিশুর কাছে বাবা ছিলেন সব। ছাত্র বয়সেই ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি লিখে প্রবাদসম খ্যাতি অর্জন করেছেন। ’৭১-এর ২৫ মার্চ নিজের তখনকার আবাস বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট হলে না থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন। দু’দিন পর, সাতাশ বন্ধু কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁকে খুঁজতে এলে পরস্পরকে জড়িয়ে এক শরীর কান্না।
কবি হেলাল হাফিজের জীবনের প্রথম ঘটনা, যার ফলে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইতে নিজেকে তিনি উজাড় করে দেবেন। দ্বিতীয় ঘটনা, একান্ত প্রেমিকা হেলেনের অন্যত্র বিয়ে। ’৭৩ সালে সম্পর্কচ্যুতি আর পিতৃবিয়োগ হেলাল হাফিজের সারা জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল। বিপুলা পৃথিবীতে সম্পূর্ণত একা হতে হল তাঁকে। কবি-বন্ধু আবুল হাসান ছিলেন, ছিলেন হুমায়ুন কবিরও। নিজেদের আন্তরিক আড্ডা আর রোমাঞ্চ অভিযানের কোনও কমতি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় নয় মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের দিনগুলোতে যে তরুণ সমাজ আশাভঙ্গের বেদনায় দীর্ণ হচ্ছিলেন, তিনি তাঁদের একজন। নিজেদের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে জৈবসারে অরণ্য নির্মাণের কথা বলেছিলেন তিনি। “দু’জনে মিলে গোলাপ গোলাপ স্বদেশ” চেয়েছিলেন। কিন্তু তেমন স্বদেশ তো অধরাই। ইতিহাস পড়লে আমরা জানব, রক্ষী বাহিনী স্বাধীন দেশের মানুষের ওপর কতখানি বিপর্যয় নামিয়ে এনেছিল। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের অব্যাহত লুটপাট, দুর্নীতি আমূলে বিনাশ করতে না-পারার জন্য বাংলাদেশকে ভুগতে হয়েছিল তখন। ’৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ সামাল দিতে পারেনি তৎকালীন আওয়ামী সরকার। বন্ধু হুমায়ুন কবিরের ‘কুসুমিত ইস্পাত’-এর কবিতাগুলো প্রকাশ পাচ্ছিল। আবুল হাসান তখনই বাংলাদেশের হৃদস্পন্দ নিজের মধ্যে ধারণ করে কবিতা লিখছিলেন। আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ মিনিবুক প্রকাশক, কথাসাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের দৌলতে আরও কিছুদূর প্রসারিত করবে পাঠক সীমানা। মোহাম্মদ রফিক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। আর হেলাল হাফিজ? তিনি ভালোবাসাকে ভেবেছিলেন মারণাস্ত্রের মতো তীব্র। বেদনার অনুভূতি জমা দিতে চেয়েছিলেন যৌথখামারে। সম্মেলক বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে চেয়েছিলেন সুখের সমান ভাগ।
২.
তৃতীয় বিশ্ব অনেক বছর ধরেই পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। ধরা যাক, কুরোসাওয়ার পঞ্চান্ন সালের চলচ্চিত্র– ‘আই লিভ ইন ফিয়ার’ এর কথা। মহান ঋত্বিক ঘটক দশ বছর পর নির্মাণ করবেন স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রায় একই ধরনের অসহ ভার থেকে। হেলাল হাফিজ লিখবেন মাত্র দুই লাইনে– ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/ মানুষ বোঝ না!’ তাঁর কবিতার কেন্দ্রে মানুষের যুদ্ধ পরিস্থিতি, হৃদয়ভাঙার বিপন্নতা আর ভবিষ্যত সুখের সম্ভাবনা।
হেলেনের কথা আরেকটু বলি। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটি বইমেলা থেকে কিনে এনে দিয়েছিলেন হেলেনের বর। নিজের নামের অব্যাহত জপ দেখে, নিজের নামটিকে কবিতাগ্রন্থের শীর্ণ অথচ দিগন্তবিস্তারী চরাচর জুড়ে বার বার গীত হতে দেখে তিনি তাঁর মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারেননি। স্বামী নিতান্তই ভালো মানুষ ছিলেন, দেশে-বিদেশে চিকিৎসার একাধিক চেষ্টাও হয়েছিল। হেলেন নিজেকে ফিরে পেলেন না আর।
আর হেলাল হাফিজ? আর সংসার করলেন না, থিতু হলেন না। ঢাকার শাহবাগের একটি হোটেলে কাটালেন জীবনের অনেকগুলো বছর। প্রেসক্লাবে গিয়ে খেয়ে আসতেন। প্রথম জীবনে তিনি লিখেছিলেন– ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,’ মিছিল আর যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্পষ্ট সময় নির্দেশ করে কবির পাশাপাশি গণবুদ্ধিজীবিতার দায়ও তিনি পালন করেছিলেন।
……………………………………..
’৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ সামাল দিতে পারেনি তৎকালীন আওয়ামী সরকার। বন্ধু হুমায়ুন কবিরের ‘কুসুমিত ইস্পাত’-এর কবিতাগুলো প্রকাশ পাচ্ছিল। আবুল হাসান তখনই বাংলাদেশের হৃদস্পন্দ নিজের মধ্যে ধারণ করে কবিতা লিখছিলেন। আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ মিনিবুক প্রকাশক, কথাসাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের দৌলতে আরও কিছুদূর প্রসারিত করবে পাঠক সীমানা। মোহাম্মদ রফিক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। আর হেলাল হাফিজ? তিনি ভালোবাসাকে ভেবেছিলেন মারণাস্ত্রের মতো তীব্র। বেদনার অনুভূতি জমা দিতে চেয়েছিলেন যৌথখামারে। সম্মেলক বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে চেয়েছিলেন সুখের সমান ভাগ।
……………………………………..
‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে কোনও পত্রিকা ছাপতে রাজি হয়নি। কিন্তু, অমোঘ বাক্য দু’টি বন্ধু-কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা আর কবি হুমায়ুন কবির ওই গনগনে ঊনসত্তরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর দেওয়ালে দেওয়ালে উৎকীর্ণ করেছিলেন। তখন থেকেই তিনি ইতিহাস। প্রথম কাব্যগ্রন্থে তিনি তাঁর সময়টাকে ধরতে পেরেছিলেন বলেই অর্ধশতাব্দী পরেও কবিতার বইটি প্রাচীন হয়নি।
দ্বিতীয় বই ‘বেদনাকে বলি কেঁদো না’, প্রকাশিত হয় দীর্ঘ বিরতি দিয়ে। সময় উজানো কবিতা খুঁজে পাইনি। এই দুই বইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে ১০টি ছোট ছোট কবিতাসদৃশ রচনা নিয়ে প্রকাশ পায় অলংকৃত কার্ড-কবিতা সংকলন। নতুন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেমিক-প্রেমিকার পরস্পরকে উপহার দেওয়া বাদে উক্ত সংকলনের কোনও উপযোগিতা পাইনি আমি। একটি নমুনা রইল– “ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’/ মন না দিলে /ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা”।
হেলাল হাফিজের কাছে শিক্ষা নেওয়ার আছে একটাই। নিজেকে নিঃশেষ করে কবিতায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে জীবনের সর্বক্ষেত্র ব্যাপ্ত করে, সাফল্য-ব্যর্থতার তোয়াক্কা না রেখে। এখন, মরণোত্তর একাধিক সম্মান অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। কবির প্রয়াণমুহূর্ত আমাদের অনেকের স্বপ্নের মধ্যে হানা দেবে, আরও আরও অতি তরুণ কবি তবুও নিজের রক্তের মধ্যে মিশিয়ে নেবেন প্রগাঢ় নিঃসঙ্গতার বোধ।
অভক্তের শেষ প্রণাম জানাই।
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..