‘টেন্ট’ মানে– ‘টি. ই. এন. টি’– থিয়েটার ফর এক্সপেরিমেন্টস ইন নিউ টেকনোলজিস। ‘টেন্ট’ আসলে– সার্কাস, প্লেগ্রাউন্ড, সিনেমা, অ্যাডভেঞ্চার, এবং আশ্রয়, অনেক কিছু হতে পারে; ছোট, বড় এবং ক্ষণিকের ম্যাজিক প্রতিবিম্বিত হয়ে। কলকাতায় আপাতত বসেছে সেই তাঁবু। একফাঁকে ঘুরে আসা যায় সেখান থেকে। ‘টেন্ট’ নিয়ে কথোপকথনে মধুজা মুখার্জি ও অভীক মুখোপাধ্যায়।
মধুজা: তোমার মনে আছে আমরা যেসময়ে এই প্ল্যাটফর্মটি শুরু করেছিলাম? ২০১২ সালে রোটারডাম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমাদের ছবি– ‘কার্নিভাল’ (পরিচালক: মধুজা মুখার্জী) ও আমার লস্ট আর্কাইভাল ইমেজেস (lost archival images) নিয়ে তৈরি মিডিয়া-ইনস্টলেশন (media -installation, ‘ক্রাম্বলড পেপারস’) দেখিয়ে যখন ফিরলাম, তখন আমার অন্তত উৎসাহের অন্ত ছিল না!
অভীক: হ্যাঁ, সে এক সন্ধিক্ষণ বলা যায়, অর্থাৎ, magic hour. তাছাড়া কুণাল সেনের সঙ্গে আমাদের পূর্ব পরিচয় ও ওঁর বিপিন পাল রোডের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। রোটারডাম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের এক্সপোজারের পর মনে হয়েছিল একটা ‘স্পেস’ গড়ে তোলা যায়, যেখানে সবাই এসে তাঁদের কাজ শেয়ার করবেন। ফিল্ম বিষয়ে নতুন ধাঁচের আলাপ-আলোচনা হবে।
মধুজা: এছাড়াও নতুন ডিজিটাল টেকনোলজি; মানে, আমাদের হাতে আসা ডিজিটাল ক্যামেরা, এডিট সেট-আপ ও কিউ-এর ছবির বার্লিনাল-এ ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার– অনেকগুলো জিনিস দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল।
অভীক: ফলে, ‘টেন্ট’, কলকাতা।
মধুজা: ‘টেন্ট’ মানে– ‘টি. ই. এন. টি’– থিয়েটার ফর এক্সপেরিমেন্টস ইন নিউ টেকনোলজিস। ‘টেন্ট’ নামটি আমার পছন্দের– সার্কাস, প্লেগ্রাউন্ড, সিনেমা, অ্যাডভেঞ্চার, এবং আশ্রয়, অনেক কিছু হতে পারে; ছোট, বড় এবং ক্ষণিকের ম্যাজিক প্রতিবিম্বিত হয়ে। তবে, ‘টেন্ট-কলকাতা’ আসলে কাজের জায়গা; যেমন পরিযায়ী শ্রমিকরা টেন্ট তৈরি করেন কাজের সূত্রে।
অভীক: হ্যাঁ, সেকারণে, আমাদের কোনও রুল-বুক ছিল না, এখনও নেই; কাজেই, ‘আর্ট’ বিষয়টির নানা অভিমুখ ভাবা সম্ভব।
মধুজা: এক্স্যাক্টলি! এবং ‘এক্সপেরিমেন্টস’-এর কথা মনে হয়েছিল সোভিয়েত ফিল্মমেকার জিগা ভারতভ-কে মাথায় রেখে। তাছাড়া, ‘থিয়েটার’– a place where action unfolds. A place of wonder . সেই কারণেই আমরা প্রথমদিকে অনেক প্রোগ্রাম করেছি– ছবি দেখানো তো বটেই, সেমিনার, প্রেজেন্টেশন, কোলাবরেশন। দেশের, বিদেশের, অনেক আর্টিস্টস এসেছেন, থেকেছেন, কাজ করেছেন ও কাজের প্রদর্শনী করেছেন।
অভীক: আমার কাছে যেটি স্মরণীয়, সেটি হল অভিদার, মানে ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট অভিজিৎ গুপ্ত, ছত্রদা (ছত্রপতি দত্ত), ও খোজঁ-এর আরও অনেকের সঙ্গে বিপিন পাল রোডের ওই বাড়িতে ইনস্টলেশন। তোমার ও অমৃতা সেনেরও কাজ ছিল।
মধুজা: খুব ভালো-ভালো কাজ করেছিলেন অনেকে। গ্রাফিক-নভেলিস্ট শঙ্খ ব্যানার্জি… আরও অনেকে। আমার আরও মনে আছে পিপল’স ফিল্ম কালেকটিভ যখন রোলি মুখার্জির কাশ্মীর নিয়ে কাজ দেখতে চাইছিল এবং কোথায় স্পেস পাচ্ছিল না বা কেউ রাজি হচ্ছিলেন না– আমরা ওদের হোস্ট করেছিলাম ২০১৭-এ।
অভীক: কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর মুহূর্ত ছিল যখন আমার ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ দেখাই ( ২০১৮-এ)। যে ছবির প্রোডাকশনের সঙ্গে তিনটি দেশ যুক্ত ছিল।
মধুজা: একদম! চিটাগাং, ঢাকা, কলকাতা, দিল্লি, বোম্বে, করাচি, লাহোর-এ একসময়ে শো হয়েছিল। মানে ৬টা, সাড়ে ৬টা, ও ৭ টায়ে শুরু হয়। তোমার মনে থাকবে, আমাদের এখানে এত লোক হয়েছিল যে জানলা দিয়ে, বারান্দা থেকে, দরজার বাইরে থেকে লোকে দেখছিলেন। এক্সেপশনাল মোমেন্ট। That cannot be repeated– for political reasons… সে দেশও নেই, সে টেন্ট-এর বাড়িও নেই– মানে, বাড়ি আছে, কিন্তু কুণালদা নেই।
অভীক: হুম। ওই স্পেসটিই এমন ছিল, মানে আর্কিটেকচারটা যেরকম, তাতে ছবি দেখানো, ইনস্টলেশন, পারফরমেন্স করা সম্ভব ছিল।
মধুজা: তোমার কি মনে হয়ে, আমরা ‘ঘরের খেয়ে, বনের মোষ’ কেন তাড়াচ্ছি? মানে, টেন্ট তো শুধু নন প্রফিট মেকিং অর্গানাইজেশন নয়, আমার তো মনে হয়ে ‘লস-মেকিং’ প্রোগ্রামও– খানিকটা! মানে নিজেদের টাকা ও শ্রম খরচ করে আমরা এই কাজ কেন করছি? বা আমি করছি, কিন্তু তুমি পাশে রয়েছ, বা কুণালদা ছিলেন– কেন? আমাদের তো কোনও দিন, কারও সঙ্গে টাকা-পয়সার কোনও লেনদেন হয়নি। কোনও কর্পোরেট ফান্ড করেনি, বা ক্রাউড ফান্ডিংও করিনি। অথচ, গত দশ বছর ধরে ‘লিটল সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল’ করছি। ওয়েল, হাউ?
অভীক: আমার মনে হয়ে টেন্ট ভাবা হয়েছিল একটি ফিল্ম-কম্যুন হিসাবে। এবং আমাদের মতো সারা বিশ্বে আরও অনেক মানুষ– আর্টিস্টস, ফিল্মমেকার্স, অর্গানাইজেশন – নিশ্চই রয়েছে, নাহলে, তারা কলাবোরেট করবেন কেন? কিন্তু আমরা যখন ২০১৪-এ ফেস্টিভ্যাল শুরু করলাম তুমি ‘লিটল সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল’ নাম দিলে কেন?
মধুজা: Well, there is nothing ‘little’ about our ‘little cinema’! ‘লিটল’ মানে ছোটদের ছবি নয়, ‘লিটল’ মানে শর্ট ফিল্ম নয়, বা কম বাজেটের ছবি নয়। ‘লিটল’-এর ভাবনা এসেছে– উৎপল দত্তের ‘লিটল থিয়েটার’ থেকে, ‘লিটল ম্যাগাজিন’-এর অবাণিজ্যিক আদর্শ থেকে। অর্থাৎ, এক রাজনৈতিক চেতনা থেকে।
অভীক: এবং ২০১৯-এ নাম বদল ও ‘টেন্ট বিয়েনালে’?
মধুজা: তুমি তো জানো আমাদের দু’জনের পক্ষে একটা এত বড় মাপের ফেস্টিভ্যাল প্রতি বছর করা সম্ভব নয়। যদিও আমরা এতগুলো বছর অনেক ভলান্টিয়ার্সদের সাপোর্ট পেয়েছি। তাদের কেউ-কেউ এখনও সঙ্গে রয়েছেন। তাও, physically, emotionally, financially, everything… is stressful. আমার মনে হয়, এক বছর অন্তর করলে আমরা বেটার ছবি বা কাজ পাব। তাছাড়াও, কলকাতার বাইরে প্রোগ্রাম ভাবতে বা করতে পারব। যেমন গত তিন বছর শান্তিনিকেতনে ওয়ার্কশপ করছি। গত বছর শৌনক সেন এসেছিল। আমি ছিলাম, শ্রীময়ী সিংহ ও পল্লবী পল– ও এখন ইন্টারন্যাশনালি খুব ভালো কাজ করছে– ছিল। ভালো একটা ওয়ার্কশপ হয়েছিল।
অভীক: তাছাড়া পান্ডেমিক এসে গেল– ফলে, বিয়েনালে। কিন্তু, তুমি ভুলে যাচ্ছ, সেই সময়– ২০২০ ও ২০২২-এ, যখন সব বড় বড় ফেস্টিভ্যাল বন্ধ হয়ে যায়, তখনও আমরা অনলাইন ফেস্টিভ্যাল করেছি। ইনফ্যাক্ট, তখনই টেন্ট বিয়েনালে-এর সূত্রপাত হয়।
মধুজা: হ্যাঁ, ঠিক। তাছাড়া, আমরা তো ফিল্ম-লিটারেসি তৈরি করার জন্যে ফেস্টিভ্যাল করছি না। বা, সেইভাবে কোনও এজেন্ডা নেই। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই– আমরা critically thinking ফিল্মমেকার ও ভিজ্যুয়াল আর্টিস্টদের কথা ভাবছি।
অভীক: হুম। যে কথা আগে বলছিলাম– ফ্রম কমিউনিটি টু কম্যুন।
মধুজা: হ্যাঁ। সেই জন্যেই অনলাইন ফেস্টিভ্যালের সময়ে এতগুলো মাস্টার-ক্লাস/লেকচার-সিরিজ করা হয়েছিল। গীতাঞ্জলি রাও, অনুপ সিংহ, পল্লবী পল, শৌনক সেন, আশিষ রাজাধ্যাক্ষ, আরও অনেকে বলেছেন। গত তিন বছর শান্তিনিকেতনে ওয়ার্কশপ করেছি। এবছরও করছি– খুব ভালো রেসপন্স।
অভীক: এ বছর, টেন্ট বিয়েনালে ২০২৪-এ তো অনেক ভালো ছবি রয়েছে।
মধুজা: রয়েছে তো। কানে-এর এই বছরের পুরস্কার-প্রাপ্ত ছবি– বেস্ট শর্ট– ‘সানফ্লাওয়ার্স ওয়ার দি ফার্স্ট ওয়ান্স টু নো’ (পরিচালক: চিদানন্দ নায়েক), শ্রীলংকার উঠতি ফিল্মমেকার রাজী সামারাসিংহে-এর ছবি, ওহিদা খন্দকারের ‘ড্রিম ইওর মিউজিয়াম’। ছবিটি এই বছর লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট মিউজিয়াম-এর জামিল প্রাইজ পেয়েছে। দেবদীপ গুপ্তর অসমের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে অডিও-ভিজ্যুয়ালের কাজ, অভিষেক মজুমদারের অসামান্য অ্যাডাপটেশন ‘দি ওয়াটার স্টেশন’। তাছাড়া, আর্কাইভস নিয়ে একাধিক কাজ রয়েছে।
অনেক অ্যানিমেশন রয়েছে, তাছাড়া, আমি থাকলে মেয়েদের তৈরি ছবি একটু বেশি থাকবে– সে আর বলতে! সারা বিশ্বের ৭০টির বেশি ছোট-বড় ছবি রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে, পৃথিবীর এই প্রান্তে যে ছবি কখনও দেখানো হয়নি– সেই মারিয়া লাসনিগ-এর অ্যানিমেশন রয়েছে। সাতের দশকে তৈরি, ১৬-এমএম ও ৮-এমএম শুট করা, এখন রেস্টোরড করা হয়েছে। ওঁর, একটি বাদে, সবক’টা ছবিই দেখাতে পারছি– এটা খুবই আনন্দের ব্যাপার আমার কাছে।
অভীক: এই নতুন স্পেস, বি-কাফ, রিজেন্ট এস্টেট-এ, এইবার যে যেখানে ছবি দেখাচ্ছি, তোমার কেমন লাগল?
মধুজা: দেখো, ‘টেন্ট’-কে I imagine it as a mobile thing – পরেরবার হয়তো পাহাড়ে ফিল্ম-ফেস্টিভ্যাল বা ওয়ার্কশপ করব, বা অন্য কোনওখানে। এইবারের মতো আরও অনেক ফিল্মমেকার্স ও আর্টিস্টস আসবেন। ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে যুক্ত হবেন। অনেক মানুষ কাজ দেখতে, কথা বলতে, আলোচনা করতে আসবেন। এক ধরনের ফ্র্যাটারনিটি বা কমিউনিটি নির্মিত হবে।
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………