‘ঘরে বাইরে’ শুরু হল নতুন করে চম্পা ভৌমিকের প্রযোজনায়। আমরা কিছু প্রোমো শুট করলাম, ক’দিন ধরে প্রচার চলল, তারপর প্রথম দিনের টেলিকাস্টে বসলাম এক অনন্য নারীকে নিয়ে, তিনি নবনীতা দেবসেন। নব পর্বের ‘ঘরে বাইরে’ অনুষ্ঠানে আমার সেদিন থেকেই গাঁটছড়া। মেয়েদের জীবনে আলোর সন্ধান দিতে, তাদের স্বনির্ভর করার পরামর্শ দিতে কতশত বিচিত্র ধরনের অনুষ্ঠান করেছি। স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানও থাকত। কেবল শরীরের সমস্যা নয়, মানসিক সমস্যা সমাধানের জন্য ‘মন নিয়ে’ নামে একটি পর্ব ছিল ‘ঘরে বাইরে’র অন্তর্গত।
১৭.
নতুন বাড়িতে নতুন নতুন মুখের আগমন ঘটল। ব্রততী তাদেরই মধ্যে এক উজ্জ্বল মুখ। এসেছিল কোনও এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অথবা সংযোজনা করতে, ঠিক মনে নেই। শুধু মনে আছে, তপন রায় প্রধানের ঘরে আলাপ হয়েছিল। নিউজ রিডারের পরীক্ষা দিল।
অ্যানাউন্সারদের অডিশনও এই সময় হয়েছিল। লিখিত পরীক্ষা ছিল প্রথমে, সে খাতা দেখার দায়িত্ব ছিল আমার আর তপনের। তারপর স্ক্রিন টেস্ট। বাইরের বিচারক হিসেবে ছিলেন অপর্ণা সেন। এই অডিশনে উত্তীর্ণ হয়ে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে ছিল সুতপা বন্দোপাধ্যায় ও ঊর্মিলা ভৌমিক। সুতপা কনট্রাস্ট ব্লাউজ পরেছিল শাড়ির সঙ্গে, রিনাদি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সাজটা দ্যাখ্, নিশ্চয়ই সানন্দা পড়ে’, আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিই, ‘রিনাদি, কনট্রাস্ট তো পরবেই, ও আমায় টিভিতে দ্যাখে যে!’
বিভাস চক্রবর্তী ছিলেন অডিশন বোর্ডে, উনিও মশকরা করতে ছাড়েন না। বেশ মজায় চলত সারাদিন ধরে অডিশন নেওয়া। আরও পরে যে ব্যাচে পূর্বাশা রায়, নীলাঞ্জনা দাশগুপ্ত, শর্মিষ্ঠা গোস্বামী এবং আরও নতুনেরা আসে, সব অডিশন বোর্ডেই ছিলাম আমি। এমনকী, আমার অবসর গ্রহণের পর শেষ যেবার অ্যানাউন্সারদের অডিশন হয় বেশ ক’দিন ধরে, তখনও বিচারকের ভূমিকা পালন করতে আমাকে ডাকা হয়। তবে তখন তো ফরম্যাট বদলে গেছে, অনুষ্ঠানের আগে পরে ঘোষণা আর হয় না, তাই যারা নির্বাচিত হয়েছিল তারা বিভিন্ন সেকশনে কমপেয়ার হিসেবে কাজ শুরু করে।
একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো, ৫০ বছর ধরে কলকাতা দূরদর্শনে যে অ্যানাউন্সার, নিউজ রিডারদের দেখা যায়, তারা প্রত্যেকেই ক্যাসুয়াল কনট্র্যাক্টে কাজ করে, অর্থাৎ স্ক্রিনে যাদের দেখা যেত বা যায়, তাদের মধ্যে কেবলমাত্র আমরা দু’জনই ( শাশ্বতী ও আমি ) স্থায়ী পদে ছিলাম। ছন্দা সেন, তরুণ চক্রবর্তী, দেবাশিস বসু অবশ্য আকাশবাণীর স্থায়ীপদে ছিল।
হঠাৎ একদিন কোনও অজ্ঞাত কারণে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘সাপ্তাহিকী’ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আরও কয়েকটি অনুষ্ঠান একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যদিও পরে তা পুরো মাত্রায় ফিরে আসে, যেমন ‘দর্শকের দরবারে’, ‘ঘরে বাইরে’ ইত্যাদি।
‘সাপ্তাহিকী’র মতো ‘দর্শকের দরবারে’ও স্টুডিও ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে ছিল। এই আউটডোর ‘দর্শকের দরবারে’ জেলায় জেলায় গিয়ে করা হবে, ঠিক হল। এমনি একবার আমি আর জগন্নাথ বসু গিয়েছিলাম, তহমিনা ছিল প্রযোজনায়। মানুষজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে দরবারের অভিজ্ঞতা একেবারে অন্যরকম। তাছাড়া, জগন্নাথদার সঙ্গে ট্রাভেল করার মজাই আলাদা, কতবার যে আমরা মিষ্টির দোকানে আর খাবার জায়গায় থেমেছি, তার ইয়ত্তা নেই! তার ওপর যেতে যেতে কতশত বিচিত্র গল্প, অফুরান ভাণ্ডার। জগন্নাথদা যখন অধিকর্তা হয়ে এলেন, শাশ্বতী ওঁকে বলল, ‘জগন্নাথ, তুমি প্লিজ ডিরেক্টরের চেয়ারটায় বোসো না, ওটায় বসলে চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়’, কথাটা ঠাট্টার ছলেই বলা। পরের দিন গিয়ে দেখি, ওই চেয়ারের পাশে ওরকম দেখতে আরেকটা চেয়ার আনিয়েছেন বসবেন বলে!
‘ঘরে বাইরে’ শুরু হল নতুন করে চম্পা ভৌমিকের প্রযোজনায়। আমরা কিছু প্রোমো শুট করলাম, ক’দিন ধরে প্রচার চলল, তারপর প্রথম দিনের টেলিকাস্টে বসলাম এক অনন্য নারীকে নিয়ে, তিনি নবনীতা দেবসেন। নব পর্বের ‘ঘরে বাইরে’ অনুষ্ঠানে আমার সেদিন থেকেই গাঁটছড়া। মেয়েদের জীবনে আলোর সন্ধান দিতে, তাদের স্বনির্ভর করার পরামর্শ দিতে কতশত বিচিত্র ধরনের অনুষ্ঠান করেছি। স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানও থাকত। কেবল শরীরের সমস্যা নয়, মানসিক সমস্যা সমাধানের জন্য ‘মন নিয়ে’ নামে একটি পর্ব ছিল ‘ঘরে বাইরে’র অন্তর্গত। বিশেষজ্ঞ হিসেবে থাকতেন ডাক্তার রীমা মুখার্জি।
এই পর্যায়ের ‘ঘরে বাইরে’-তে একবার গেলাম সুচিত্রা ভট্টাচার্যর বাড়িতে। সুচিত্রাদির সঙ্গে আলাপ ছিল আগেই, অন্য এক কাজের সূত্রে, দূরদর্শনের বাইরে। তাই চম্পা যখন বলল, সুচিত্রাদির সাক্ষাৎকার নিতে যেতে হবে তখন খুশি হলাম। ঘরোয়া মুডে আলাপচারিতা বেশ জমল। পরবর্তী কালেও আমার সঞ্চালনা করা বহু অনুষ্ঠানে পেয়েছি তাঁকে ও আরেক বিশিষ্ট সাহিত্যিক বাণী বসুকে। মনে পড়ল, ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’-তে একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম, ‘সাহিত্যে বর্ষা’। বাণীদি ছিলেন সে অনুষ্ঠানে, আর ছিলেন আমার প্রিয় মাস্টাররমশাই পিনাকেশ সরকার। বর্ষা নিয়ে আলোচনা যখন গান তো থাকবেই, শৌণক চট্টোপাধ্যায় রাগসংগীতে বন্দিশ ও রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে সৃষ্টি করেছিল ঘন ঘোর বর্ষার আবহ। অনুষ্ঠানটি কিন্তু রেকর্ডেড নয়, লাইভ ছিল। সাহিত্য সংস্কৃতিতে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করেছিলাম, তার মধ্যে অনেকগুলি রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত। আমার আরেক মাস্টারমশাই পবিত্র সরকার ছিলেন এমন এক অনুষ্ঠানে।
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের অনুষ্ঠান দিয়েই ১৯৭৫-এর জুলাইয়ে আমার টেলিভিশন-যাত্রা শুরু, বারেবারে বর্ষা ফিরে ফিরে এসেছে বিষয় হিসেবে আমার সঞ্চালিত অনুষ্ঠানে। বর্ষার গান নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম, ‘এ ভরা বাদর’। রোহিণী, শৌণক, সুপ্রতীক গান করেছিল, ভাষ্য রচনা ও পাঠ আমার।
ফিরে আসি ‘ঘরে বাইরে’র কথায়। ভুবনেশ্বর দূরদর্শন থেকে এল রঞ্জনা গিরি, ওকে দেওয়া হল ‘ঘরে বাইরে’র ভার। আমাকে ওর সঙ্গী করে নিল, অনুষ্ঠানের বিষয় নির্বাচন থেকে ট্যালেন্ট (আর্টিস্ট অর্থাৎ, যাঁরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে আসেন তাঁদের আমরা ট্যালেন্ট বলি, আমাদের নিজস্ব কিছু টার্ম আছে যেমন পরিচালককে এখানে প্রযোজক বলে) ঠিক করে, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, সব ভার আমাকে দিল। এখান থেকে শুরু হল আমার এক নতুন যাত্রা। আমরা শুরু করলাম এক নবধারার অনুষ্ঠান, ‘মা ও মেয়ে’ সিরিজ। বাংলা টেলিভিশনের ইতিহাসে এমন কাজ আগে কখনও হয়নি। এই সিরিজের প্রথম অতিথি বিশ্ববিখ্যাত মা ও মেয়ে, প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর এবং তাঁর সুযোগ্যা-কন্যা নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী মমতাশঙ্কর। দু’টি পর্বে বিন্যস্ত এই অনুষ্ঠান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্যচিন্তা নিয়ে তথ্যচিত্র সেই প্রথম
পর্ব ১৫: ট্রেনে শুটিং-এর সময় সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’
পর্ব ১৪: দূরদর্শনের জন্য প্রথম তথ্যচিত্র করা আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার!
পর্ব ১৩: সেন্ট পল ক্যাথিড্রালকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর সাপ্তাহিকীর শুটিং হয়েছিল!
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
তাঁর ছাত্রীবেলাতেই প্রদোষ দাশগুপ্ত তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন– প্রকৃতিকে শিক্ষার্থীর মতো নতজানু আবেগে চিনে নিতে। যে প্রকৃতি রং-রূপের আধার, রূপভেদের আবাদভূমি। সেই শিক্ষা আত্মস্থ করে, ধাতুর শরীরে প্রকৃতির নৈঃশব্দ্যের ছন্দটি অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন উমাদি।