কলেজের পক্ষ থেকে পিডব্লুডি-কে নির্দেশ দেওয়া ছিল আর্চের ওপরের অংশের যে ফাটল দেখা যাচ্ছে, তাকে যথাযথ মেরামত করে দেওয়াল চিত্রটির ঝরে যাওয়া অংশগুলিতে একখানি নিউট্রাল গ্রে (ধূসর) রং করে (যা ঝরে যাওয়া ম্যুরালের ক্ষেত্রে সাধারণত করা হয়) বাকি অংশকে অক্ষত রেখে দিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই কাজটি পুজোর ছুটির সময় সম্পন্ন করা হয়। তাঁরা ভঙ্গুর এই রঙের স্তরকে যথাযথভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। কলেজ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে সম্পূর্ণ জায়গাটি তাঁরা রং করেন।
ভারতের মতো ঐতিহ্যবহুল দেশে, যেখানে যুগে যুগে সৃষ্টি ও নির্মাণের ফল্গুধারা অবলীলায় বয়ে চলে এসেছে, সেখানে সংরক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সমস্যাবহুল বিষয়। ভারতে সৃষ্টির ইতিহাসের তুলনায় সংরক্ষণের ইতিহাস সাম্প্রতিক। সরকারি আর্ট স্কুলে হয়তো ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট ওয়ালটার গ্র্যান্ডভিলের তৈরি করা স্থাপত্য সেই রীতির অনুকরণে আঠেরশো শতকের শেষভাগে তৈরি হয়েছিল কলোনিয়াল স্টাইলের এই অসাধারণ স্থাপত্যটি।
ঐতিহ্যমুখর এই স্থাপত্যটির বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য– ছাদের রেলিং, এর বহিরাংশের হাই রিলিফ ফলিয়েজ প্যাটার্ন, বাড়ির দক্ষিণের দোতলার সুদৃশ্য ঝুলন্ত কাঠের বারান্দা, দক্ষিণে ও উত্তরে প্রবেশ ও বাহির পথের বরাবর তিনতলা পর্যন্ত একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নকশা, যার মধ্যে গ্লেসড ইট স্থাপন করা হয়েছে, যা অত্যন্ত দুর্লভ, বাড়িটির ভেতরে রয়েছে প্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি (যদিও এটি বহু কলোনিয়াল সময়ে নির্মিত বাড়িতেই দেখতে পাওয়া যায়)। ভিতরের তিনটি তলের আর্চের ভিত্তিতে ও দৈর্ঘ্যে প্রকৃতপক্ষে রাজস্থানি ফ্রেস্কো টেকনিকে করা ম্যুরাল (ভিত্তিচিত্র)। যা বর্তমানকালেও অক্ষত। কলেজ লাইব্রেরির ভিতরাংশে প্রায় শতবর্ষ পুরনো ম্যুরাল ও পরবর্তীকালে করা ‘অবন গ্যালারি’র পাশে ম্যুরাল উল্লেখযোগ্য। যদিও মহাকালের নিয়মে নানা বিবর্তনের সাক্ষী এই স্থাপত্য।
এই বিবর্তনগুলির মধ্যে যা যা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল পূর্বে উল্লেখিত দক্ষিণের সেই কাঠের বারান্দাটি, ছয়-সাতের দশকের মধ্যেই ভঙ্গুর হতে শুরু করেছিল। নয়ের দশকের গোড়ায় সেটিকে সিমেন্ট ও কংক্রিট দিয়ে কাঠের পরিবর্তে পুনর্নির্মিত করা হয়েছিল। তখন না বোঝা গেলেও কালক্রমে দেখা যায় যে, এই বাড়িটির যা ভারসাম্য ছিল, তা ধীরে ধীরে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। কাঠের বদলে কংক্রিটের ওজনের ভারে দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ক্রমশ বসে যেতে শুরু করে। ত্রিতল এই বাড়িটির দেওয়াল, মেঝে ও সিলিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাড়িটির নানা দেওয়ালে দেখা যেতে থাকে সুদীর্ঘ ফাটল। ইটের চওড়া দেওয়ালের ওপর ভর করা লোহার বিম ও টেরাকোটার স্ল্যাব দিয়ে তৈরি মেঝে ও সিলিং আন্দোলিত হয়। বহু জায়গায়, বিশেষ করে দোতলায় ও তিনতলায়– এই অবক্ষয় রোধ করতে বহুদিনের প্রচেষ্টায় ২০২২ সালে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে এই পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয় পিডাব্লুডির সাহায্যে। প্রথমেই ফেলে দিতে হয় কংক্রিটের বারান্দাটি। দক্ষিণ-পূর্ব কোণের প্রায় পুরোটাই নতুন করে তৈরি করতে হয়।
মেঝে থেকে লোহার খুঁটি দিয়ে ধরানো হয় সিলিংয়ের ঝুলে থাকা অংশগুলি, মেঝের উত্তল অংশগুলি খুলে নতুন করে বসানো হয় টেরাকোটা টাইলস, দেওয়ালের ফাটল ক্লিপিংয়ের মাধ্যমে ঠিক করার চেষ্টা করা হয়। নোনাধরা সিলিং ও দেওয়ালের বিস্তৃত অংশ ফেলে দেওয়া হয়। এরপর শুরু করা হয় সিলিং ও দেওয়ালের মেরামতের কাজ ও বাকি বাড়িটির প্রয়োজনীয় পুনর্নির্মাণ। শুরু হয় রঙের কাজ। বহু বছর ধরে কোনও রঙের প্রলেপ গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি। সমস্যা দাঁড়াল বাড়ির তিনটি তলের আর্চের উপরিভাগের এবং তিনদিকের দেওয়াল চিত্রকে নিয়ে। এই চিত্রটির নির্মাণকাল সঠিকভাবে সনাক্ত করা যায় না। তবে এ কথা নিশ্চিত যে, এই দেওয়াল-ছবিটি জয়পুরী ফ্রেস্কো টেকনিকে নির্মিত নয়। বরং সেটি রাজস্থানি মিনিয়েচারের আদলে নির্মিত। এই দেওয়াল চিত্রটিকে বহুবার সংরক্ষিত করার প্রয়োজন পড়েছে, যার শেষ প্রচেষ্টা ঘটেছিল ২০০৯ সালের কাছাকাছি। এই শেষ সংরক্ষণের কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পরে, হয়তো বা তার আয়ু দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে রঙের ওপর ভার্নিসের স্তর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক দশক যেতে না যেতেই আমাদের হাওয়াবাতাস এবং আর্দ্রতার কারণে রঙের ওপর ভার্নিসের স্তর সংকুচিত হতে আরম্ভ করে। রঙের থেকে ভার্নিসের ধারণ ক্ষমতা বেশি হওয়ার দরুন মূল দেওয়াল থেকে সেই রঙের স্তরের সঙ্গে পাপড়ের মতো খসতে আরম্ভ করে। ভার্নিসের স্তর গত দু’-তিন বছরে সময়ের বহমানতার সঙ্গে দ্রুত অবক্ষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বেশিরভাগ অংশ হয় ঝরে পড়ে, অথবা ঝরে পড়ার অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে।
কলেজের পক্ষ থেকে পিডব্লুডি-কে নির্দেশ দেওয়া ছিল আর্চের ওপরের অংশের যে ফাটল দেখা যাচ্ছে, তাকে যথাযথ মেরামত করে দেওয়াল চিত্রটির ঝরে যাওয়া অংশগুলিতে একখানি নিউট্রাল গ্রে (ধূসর) রং করে (যা ঝরে যাওয়া ম্যুরালের ক্ষেত্রে সাধারণত করা হয়) বাকি অংশকে অক্ষত রেখে দিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই কাজটি পুজোর ছুটির সময় সম্পন্ন করা হয়। তাঁরা ভঙ্গুর এই রঙের স্তরকে যথাযথভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। কলেজ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে সম্পূর্ণ জায়গাটি তাঁরা রং করেন। জানতে ইচ্ছে করে, কোনও পুনরুদ্ধারের চেষ্টা না করে যদি ম্যুরাল কালের নিয়মে ঝরে পড়ে যেত, কেউ কি বিব্রত হতেন?
এমন আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এই মুহূর্তে ঘটে চলেছে, কলাভবন বয়েজ হস্টেলে সিলিং শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের নিজ হাতে গড়া ফ্রেস্কোটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। বিখ্যাত ‘ব্ল্যাক হাউস’-এর ক্রমশ খসে পড়ে যাওয়া রিলিফ ম্যুরালটির যথাযথ কোনও সুরাহা করা সম্ভব হচ্ছে না, কলাভবনের হ্যাভেল হলের অজন্তা বাঘ গুহার অনুকরণে চিত্রিত ফ্রেসকো রোজ অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বভারতীর মতো কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে অর্থের কোনও অভাব নেই, সেখানেও যথাযথ সংরক্ষণ কিছুতেই সম্ভবপর হচ্ছে না। ইনস্টিটিউশনাল স্পেসে এই সমস্যাগুলি ডেলিকেট এবং চিরন্তন। অপ্রত্যাশিত এবং অনভিপ্রেত এই ঘটনাটি স্বভাবতই খুব দুর্ভাগ্যজনক। যেহেতু এটি একটি রিপিটেড প্যাটার্নের ডিজাইন এবং কোনও ব্যক্তিগত শিল্পীর শিল্পকর্ম নয়, এটিকে অবশ্যই পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন এবং সম্ভবপর। এই উদ্দেশ্যে রাজস্থানের আলিয়াবাদ অঞ্চলে অবস্থিত ‘বনস্থালি বিদ্যাপীঠ’-এর প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর ভবানীশঙ্কর শর্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ওঁর মাধ্যমে দিল্লির কনজার্ভেসনের প্রধান আধিকারিক ড. আঁচল পান্ড্যার কাছে পরামর্শ নেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে।
………………………………………
আরও পড়ুন সনাতন দিন্দার লেখা: আর্ট কলেজেই শিল্প সংরক্ষণ হয় না, এদেশে শিল্প বাঁচবে?
………………………………………
কলেজের সমস্ত শিক্ষক, ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ ও বাকি স্টেক হোল্ডারদের হাত ধরে এই কাজটি সম্পন্ন করার অঙ্গীকার নেওয়া অবশ্যই সম্ভব। মূল প্রসঙ্গের রেশ টেনে আরও কিছু পর্যবেক্ষণ– ওয়াল পেন্টিং-এর ঘটনাটি দিনের পর দিন সবার চোখের সম্মুখে ঘটেছে। অথচ, কোনও দিন এই বিষয়ে কারও তরফ থেকে কোনও ক্ষোভ বা পরামর্শ– কোনওটাই পাওয়া যায়নি। তাদের সে সম্পর্কে কোনও বিশেষ দৃকপাতও ছিল না।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না... পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে।