পণ্ডিত হলেন জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন। হেস্টিংস তাঁকে নিজে ‘পণ্ডিত’ হিসেবে সম্বোধন করতেন। হেস্টিংস থেকে শুরু করে বহু ইংরেজ রাজপুরুষ তাঁকে তলব করে নয়, নিজেরা সরাসরি তাঁর গ্রাম সুবাদের বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসতেন। বাংলায় ডাকাতের রমরমা হওয়াতে স্যর উইলিয়াম জোন্স জগন্নাথ তর্ক পঞ্চাননের বাড়িতে নিজের খরচে বন্দুকধারী প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন। শোভাবাজারের রাজা, নদীয়ার রাজা, ওয়ারেন হেস্টিংস, স্যর জন শোর তাঁকে পণ্ডিত হিসেবে মান্যতা দিতেন। এমন মান্যতার কারণেই হেস্টিংসের মূর্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন। এই সংযুক্তি-ব্যতীত হেস্টিংস যে প্রাচ্য অনুরাগী, তা বোঝানো যেত না।
৪.
১৯১৪ সালে যখন কলকাতা কর্পোরেশন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে একটি মূর্তি উপহার দিল তখন বোঝা গেল ইনি হলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। যাঁর মূর্তি নির্মাণ করেছেন রিচার্ড ওয়েস্টম্যাকট। কিন্তু সেখানে শুধু হেস্টিংসের মূর্তিই ছিল না, সঙ্গে ছিল আরও দু’টি অঙ্গ মূর্তি। এ কথা আমাদের অজানা নয় যে, মূর্তিতে হেস্টিংসকে প্রাচ্যবিদ্যার প্রসারে আগ্রহী এমন একজন শাসক হিসেবেই দেখানোর কথা ভাবা হয়েছে। মাদ্রাসা স্থাপন, এশিয়াটিক সোসাইটি– এ ধরনের নানা প্রতিষ্ঠানই স্থাপনের অন্তরালে রয়েছে হেস্টিংসের অবদান। তার সঙ্গে অবশ্য স্মরণীয় কীর্তি ছিল হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অফ্ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গোয়েজ’ ছাপার উদ্যোগ। এসব কারণেই আমরা জানি যে, প্রাচ্যবিদ্যার অনুরাগী হিসেবে দেখানোর কথা ভেবেছিলেন মূর্তি নির্মাতা।
আর এই কাজটি সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মূর্তি রচয়িতা মনে করলেন, প্রাচ্যের দুই ব্যক্তিকে হেস্টিংসের সঙ্গে যুক্ত করা দরকার। সেই হিসেবেই মূর্তি নির্মাতা হেস্টিংসের এক পাশে রাখলেন একজন হিন্দু পণ্ডিতকে আর অন্য পাশে রাখলেন একজন মৌলবিকে। পণ্ডিতের এক হাত থুতনিতে রেখেছেন আর অন্য হাত রেখেছেন কোমরে।
এই পণ্ডিত হলেন জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন। হেস্টিংস তাঁকে নিজে ‘পণ্ডিত’ হিসেবে সম্বোধন করতেন। প্রাচীন মানুষেরা বলেন, জগন্নাথ গৌরাঙ্গ ছিলেন না, কিন্তু উজ্জ্বল শ্যামবর্ণে বিলক্ষণ প্রিয়দর্শন ছিলেন। তাহার কলেবর আয়ত এবং বাহু দীর্ঘ, মস্তক বৃহৎ, নাসিকা উন্নত, ললাট পরিষ্কার এবং প্রশস্ত ছিল। ঠিক এমনটাই বর্ণনা করা হয় ইংরেজ শিল্পীকেও। সেই হিসেবে পণ্ডিতের চেহারা গড়ে ওঠে। দেখে মনে হয়, প্রশান্ত বদন এবং বিনীত বচন এক পণ্ডিত। যিনি গভীর ভাবনার পথিক। কিন্তু বড়ই একরোখা।
একবার বর্ধমানরাজ ত্রিলোকচন্দ্র তাঁর সভায় পণ্ডিতকে জিজ্ঞাসা করলেন আসার পথে কী কী দেখেছেন? পণ্ডিত হেসে বলেন, ‘বিস্তারে বলব নাকি সংক্ষেপে?’ রাজা তাঁকে বিস্তারে বলতে বললেন। জগন্নাথ ত্রিবেণী থেকে বর্ধমান পর্যন্ত সন্নিহিত গাছপালা, জলাশয়, সেতু, উদ্যান, দেবালয় যেখানে যা আছে, সব বর্ণনা করলেন। এই সময় দু’জন পণ্ডিত আদেশ অনুসারে সেসব লিপিবদ্ধ করছিলেন। রাজা পরে গুপ্তচর মারফত সমস্ত বর্ণনা মিলিয়ে দেখে পাণ্ডুয়া পরগনার হেদুয়া পোঁতা গ্রাম তাঁকে নিষ্কর লিখে দিয়েছিলেন। এমন শ্রুতিধর ছিলেন জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন।
হেস্টিংস থেকে শুরু করে বহু ইংরেজ রাজপুরুষ তাঁকে তলব করে নয়, নিজেরা সরাসরি তাঁর গ্রাম সুবাদের বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসতেন। বাংলায় ডাকাতের রমরমা হওয়াতে স্যর উইলিয়াম জোন্স জগন্নাথ তর্ক পঞ্চাননের বাড়িতে নিজের খরচে বন্দুকধারী প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন। শোভাবাজারের রাজা, নদীয়ার রাজা, ওয়ারেন হেস্টিংস, স্যর জন শোর তাঁকে পণ্ডিত হিসেবে মান্যতা দিতেন। এমন মান্যতার কারণেই হেস্টিংসের মূর্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন। এই সংযুক্তি-ব্যতীত হেস্টিংস যে প্রাচ্য অনুরাগী, তা বোঝানো যেত না। অন্য দিকে ইংরেজ ভাস্করের হাতে ত্রিবেণীর টোলের পণ্ডিত যুক্ত হলেন হেস্টিংসের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেই।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
তথ্যসূত্র:
সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবলচন্দ্র মিত্র সংকলিত, জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, জীবন বৃত্ত, উমাচরণ ভট্টাচার্য
তথ্যঋণ: বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
…পড়ুন ভাবমূর্তি…
পর্ব ১। শাসককে দেবতা বানানোর অভিপ্রায়েই কলকাতায় পথে-প্রান্তরে ইংরেজরা বসিয়েছিল মূর্তি
পর্ব ২। হেস্টিংসের মূর্তি আসলে অত্যাচারীরই নতুন ভাবমূর্তি
পর্ব ৩। বঙ্গভঙ্গের ছায়া মুছতে অঙ্গমূর্তির পরিকল্পনা করেছিলেন লর্ড কার্জন