Robbar

শ্যাম শুধু সিনেমা তৈরি করেননি, ভারতের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের পর্দায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 23, 2024 9:30 pm
  • Updated:December 23, 2024 9:57 pm  

আমার প্রতি ভরপুর স্নেহ ছিল আমার অসমবয়সি বন্ধু শ্যাম বেনেগালের। আমার প্রথম ছবি ‘মা ভূমি’র সময় একটা ক্যামেরা ইউনিট পাঠানোয় শ্যাম এবং এস. সুখদেব– সাহায্য করেছিলেন দু’জনেই। আমি আর শ্যাম একসঙ্গে ছিলাম বহু কমিটিতেই। ফিল্মস ভিশনের কমিটি, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কমিটি, সেন্সর কমিটি– সে কারণেই আমরা বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, মিটিং করেছি। একটা হৃদ্যতা ছিল, আলোচনাও হত বহু বিষয়ে। গল্পগাছায় বুঝতে পারতাম তাঁর বোধ ছিল প্রখর, অত্যন্ত ভালো পড়ুয়া, এবং প্রচুর ইউরোপিয়ান সিনেমা দেখেছেন। এবং এমনভাবেই দেখেছেন যে সেসব সিনেমার রেফারেন্স মনে অটুট থাকত। আমার কোনও ছবি দেখে বলে দিতে পারতেন, কোন দৃশ্যে বুনুয়েলের ছাপ, আর কোন দৃশ্যে চ্যাপলিন।

গৌতম ঘোষ

শ্যাম চলে গেলেন। শ্যাম বেনেগাল। আমার অসমবয়সি বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। ডাকতাম ‘শ্যাম’ বলেই, ঠিক ‘শ্যাম’ না, ‘শাম’। এই মুহূর্তে ভিড় করে আসছে একসঙ্গে কাটানো, হইহল্লা, সিনেমা-খাবার-থিয়েটার নিয়ে হাজারো আড্ডার স্মৃতি। জানতাম, শ্যামের শরীর খারাপ। একটা সময় মেসেজ করলে উত্তর পেতাম। সেই উত্তর দেওয়া বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। নানা মানুষের কাছে খবর পাচ্ছিলাম, শ্যাম বেশ অসুস্থ। এক সময় খবর পেতাম, শরীর খারাপ সত্ত্বেও তিনি অসম্ভব শৃঙ্খলাপরায়ণ। নিয়ম করে অফিস যাওয়ায় কোনও ঘাটতি ছিল না। লাঞ্চের সময় বাড়ি ফিরে, সামান্য খেয়ে, আবারও অফিসে যেতেন।

আমার সঙ্গে শ্যাম বেনেগালের আলাপ ১৯৭৩ সালে। তখন বোম্বেতে বিজ্ঞাপনের ছবি করতে গিয়েছি। কিছু তথ্যচিত্র নির্মাণ করাও শুরু করেছি। আমার আরেক প্রিয় অসমবয়সি বন্ধু ছিল বিখ্যাত তথ্যচিত্র নির্মাতা এস. সুখদেব। ওঁর সঙ্গে আমি কাজ করেছি। ডকুমেন্টরি, অ্যাড ফিল্ম শ্যুট করেছি ওঁর সঙ্গে। সুখদেবই আমার সঙ্গে শ্যামের আলাপ করে দিয়েছিলেন।

মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল ও সত্যজিৎ রায়

’৭৪ সালে শ্যাম বেনেগালের প্রথম ছবি ‘অঙ্কুর’ আত্মপ্রকাশ করল। এবং আত্মপ্রকাশ করা মাত্রই, একটা হইচই রব। কী যেন ‘নতুন’ এসে পড়েছে ভারতীয় ছবিতে। প্রায় এরকমটা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে, ’৬৯ সালে– যখন মৃণাল সেন ‘ভুবন সোম’ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। শুধু বাংলা বা বোম্বে নয়, দক্ষিণ ভারতেও তা সাড়া ফেলে দিয়েছিল। মনে আছে, ‘অঙ্কুর’ রিলিজের পরপরই, কলকাতায় দেখেছিলাম সেই ছবি। অনেক উত্তেজিত দর্শকদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন।

‘অঙ্কুর’-এর সঙ্গে আমার আরেকটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। ‘অঙ্কুর’ যাঁর জীবনকে নিয়ে তৈরি করা, তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল আমার প্রথম ছবি ‘মা ভূমি’ করতে গিয়ে। তাঁর নাম সূর্য্যম রেড্ডি– শ্যাম বেনেগালের ছোটবেলার বন্ধু। শ্যাম ছেলেবেলায় থাকতেন সেকেন্দ্রাবাদের আলোয়ালে। সেখানকারই বন্ধু এই স্যূর্যম রেড্ডি। সূ্যর্যম বলেছিল, ‘দেখেছ, শ্যাম একটা ছবি করল আমাকে নিয়ে, আমার জীবনের যা যা বাজে ঘটনা, সবই আমার বন্ধু দেখিয়ে দিয়েছে।’

On Shyam Benegal's birthday, a flashback to his 1975 classic Nishant
‘নিশান্ত’ (১৯৭৫) সিনেমার একটি দৃশ্যে শাবানা আজমি

একের পর এক দুরন্ত সব ছবি উপহার দিতে থাকলেন শ্যাম। ‘নিশান্ত’ (১৯৭৫), ‘মন্থন’ (১৯৭৬) আরও কত। শ্যাম শুধু সিনেমা তৈরি করেনি, ভারতের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের পর্দায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন, মোহন আগাসে, ওম পুরী। স্মিতা পাতিল যদিও আগে বড় পর্দায় হাজির হয়েছেন, কিন্তু স্মিতাকে মানুষ প্রথমবার লক্ষ্যণীয়ভাবে চিনেছে শ্যামের ছবির মধ্য দিয়েই। এই পর্বটা শ্যাম বেনেগালের ছবি-করিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।

দীর্ঘদিন ছবি করেছেন শ্যাম। ছবির বিষয়ও বহু বিচিত্র। আমাদের বাংলায় যেমন তপন সিন্‌হা, বৈচিত্রের দিক থেকে অনেকটা সেইরকম। নিজে ছিলেন কোঙ্কানি, বড় হয়েছেন হায়দরাবাদে, ছবি করেছেন বোম্বেতে– বেশিরভাগ হিন্দিতে, একটা সম্ভবত ইংরেজিতেও। অনেক বিখ্যাত মানুষকে নিয়েও ছবি করেছেন তিনি। মহাত্মা গান্ধি, সুভাষচন্দ্র বোস, বঙ্গবন্ধু, আরও বেশ কিছু।

ফিচারে আসার আগে অনেক ডকুমেন্টারি করেছিলেন। ফিচার করার পরেও ডকুমেন্টারির প্রতি ওঁর ঝোঁক কমেছিল বলে মনে হয় না। ‘ব্লেজ অ্যাডভার্টাইজিং’-এর সঙ্গে যুক্ত থেকে করেছিলেন বিজ্ঞাপনের ছবিও।

আমার প্রতি ভরপুর স্নেহ ছিল আমার এই অসমবয়সি বন্ধুটির। আমার প্রথম ছবির সময় একটা ক্যামেরা ইউনিট পাঠানোয় শ্যাম এবং সুখদেব– সাহায্য করেছিলেন দু’জনেই। আমি আর শ্যাম একসঙ্গে ছিলাম বহু কমিটিতেই। ফিল্মস ভিশনের কমিটি, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কমিটি, সেন্সর কমিটি– সে কারণেই আমরা বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, মিটিং করেছি। একটা হৃদ্যতা ছিল, আলোচনাও হত বহু বিষয়ে। গল্পগাছায় বুঝতে পারতাম তাঁর বোধ ছিল প্রখর, অত্যন্ত ভালো পড়ুয়া, এবং প্রচুর ইউরোপিয়ান সিনেমা দেখেছেন। এবং এমনভাবেই দেখেছেন যে সেসব সিনেমার রেফারেন্স মনে অটুট থাকত। আমার কোনও ছবি দেখে বলে দিতে পারতেন, কোন দৃশ্যে বুনুয়েলের ছাপ, আর কোন দৃশ্যে চ্যাপলিন।

শ্যাম শুধু কড়া বুদ্ধিজীবী নন, তাঁর সেন্স অফ হিউমারও ছিল চমৎকার। আমার দ্বিতীয় ছবি ‘দখল’ যখন শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে ‘রাষ্ট্রপতি পুরস্কার’ পায়, তখন শ্যাম আমাকে মজা করে বলেছিলেন, ‘তুমি তো সবাইকে হারিয়ে দিলে, হ্যাঁ?’ বলা বাহুল্য, বহু নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালকদের ছবিই ছিল পুরস্কারের বিচার তালিকায়।

খেতে ভালোবাসতেন খুব। এমনকী, ঘোর বাঙালিদের মতো তৃপ্তি করে মাছ-ভাত খেতেও দেখেছি। বেঙ্গালুরুতে একবার, বললেন, ‘চলো, এই দোকানে দারুণ ধোসা পাওয়া যায়’– এই বলে ঢুকে পড়লেন সেখানে। অথচ, শ্যামের বাড়ির খাওয়াদাওয়া ছিল এক্কেবারে সাহেবি। ফলে শুধু সিনেমা নয়, খাবারের দিক থেকেও শ্যাম বৈচিত্রপূর্ণ।

50 years of Shyam Benegal - Hindustan Times
শুটিংয়ের মেজাজে শ্যাম বেনেগাল

শ্যাম বেনেগাল উন্নতমানের ছবি তৈরি করে গিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন দর্শকদের সঙ্গে তাঁর ছবির যেন কথাবার্তা হয়, দর্শককে বোঝানো যায়, নাড়া দেওয়া যায়। সিনেমার ভাষাকে মর্যাদা দিয়েই সেই শিল্পিত চেষ্টা। অভিনেতাদের দিয়ে যেভাবে অভিনয় করিয়েছেন, তা দেখার মতো, শেখার মতো। নতুনদের প্রচুর সুযোগ দিয়েছেন– এনএসডি-র, পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছেলেমেয়েদের বিশেষ করে। সেই অভিনেতারা প্রত্যেকেই পরবর্তীকালে নাম করেছেন।

শ্যামের সঙ্গে বাংলারও একটা সম্পর্ক ছিল। বাংলা সাহিত্য পছন্দ তো ছিলই, সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের ছবি দেখতেন, শ্রদ্ধা করতেন তাঁদের সিনেমাবোধকে। বাকি বাঙালি পরিচালকদেরও শ্রদ্ধা করতেন যথেষ্টই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে শ্যাম ‘আরোহণ’ নামের একটি ছবি করেছিল। বর্গা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই সিনেমা, এখন
অনেকটাই বিস্মৃত। খাস কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল মজবুত, কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসেছেন বহুবার। সত্যজিৎ রায় মেমোরিয়াল লেকচারও দিয়েছেন।

অনেক কিছু দিয়ে গিয়েছেন শ্যাম। তাঁর ছবিগুলো যাতে সংরক্ষিত হয়, এই কামনা করি। বিদায় আমার অসমবয়সি বন্ধু।