কুমার সাহানির আরেক শিক্ষক ছিলেন দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী। ‘পুণে ফিল্ম ইন্সটিটিউট’-এর পিছনের পাহাড়ে হাঁটতে হাঁটতে কোশাম্বি কুমারকে দেখাতেন, পাথরের গায়ে খোদাই করা লিপি, পাথরের প্রাচীন ব্যবহার্য বস্তুর অবশেষ। মিথ অ্যান্ড রিয়ালিটি (১৯৬২) বইতে কোশাম্বী ঋগবেদ থেকে মহাভারত অবধি ঊর্বশী-পুরুরবা কাহিনির বিবর্তনের ইতিহাস শুনিয়েছেন। ওই মিথ যে কুমারের ছবিতে প্রবেশ করবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কুমার সাহানি (১৯৪০-২০২৪) কঠিন পন্থা বেছে নিয়েছিলেন, যে পথে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলতে হয়। ছবি করতে পারবেন কি না, ছবি আরম্ভ করে শেষ করতে পারবেন কি না, শেষ হলে তা মুক্তি পাবে কি না, সে প্রশ্ন তো ছিলই, রসগ্রাহী দর্শক অন্তত গ্রহণ করবেন কি না– সেই অনিশ্চয়তাও কখনও ওঁর পিছু ছাড়েনি। একা হয়ে যাবেন জেনেও বিপজ্জনক সংকল্প নিয়েছিলেন।মায়া দর্পণ-এর (১৯৭২) পরে দ্বিতীয় ছবিতরঙ্গ (১৯৮৪) শেষ করতে দশ বছর লেগেছিল। সিনেমাস্কোপ ফরম্যাটে তিন ঘণ্টার ছবি। প্রযোজক এনএফডিসি ঠিক করেছিল ছেঁটে-কেটে নেবে। ইকবাল মাসুদ, খালিদ মহম্মদ, অরুণা বাসুদেবের মতো ক্রিটিকরা এমন কাজ করতে বারণ করে এনএফডিসিকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। তাতে কিছু জরুরি কথা ছিল। ওঁরা বলেছিলেন, আর্ট ফিল্ম আর বাণিজ্যিক ছবির যে বিভাজন মাথায় রেখে নীতি নির্ধারণ করা হয়তরঙ্গ-কে সেই দৃষ্টি দিয়ে দেখলে বড় ভুল হবে। আর্ট ফিল্ম বাস্তববাদের খাতিরে শিল্পের যেসব ঐতিহ্য, যেসব সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে, ওঁদের মতে বাণিজ্যিক ছবিতে সেসব অপরিণত দশায় লুকিয়ে থাকতে পারে। কুমার সেই উপাদানগুলিকে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি, তাদের নবীকরণের চেষ্টা করেছেন।
তরঙ্গ-এ বম্বের তারকা আছে, প্লে-ব্যাক করা গান আছে, মাঝে মাঝে এক ধরনের নাটকীয়তা আছে যা মায়া দর্পণ দেখে ভাবা গিয়েছিল কুমার সাহানি সম্পূর্ণ বর্জন করতে চান। যে এপিক সিনেমার সন্ধান করছিলেন, ওঁর মতে, তার একটা কাজ পণ্যের আঙ্গিকের মধ্যে স্তরীভূত নানা সম্ভাবনাকে উদ্ধার করে তাদের নতুন বিন্যাসে এনে বসানো। পণ্যায়ণের বিরুদ্ধে ওঁর প্রবন্ধে, বক্তৃতায় বারবার তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন, কিন্তু ওঁর মনে হয়েছিল কমোডিটিকে ‘ফর্ম’ হিসেবে বোঝার ও ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মুশকিল হল, সেসব করতে গেলে আর্ট ফিল্মের পরিচিতিটুকু খোয়াতে হয়। সংখ্যালঘু দর্শকের কাছেও অপরিচিত হয়ে যেতে হয়। তরঙ্গ একই সঙ্গে এক ব্যবসায়ী পরিবারের ভিতরকার সংঘাতের নাটক– তাতে ষড়যন্ত্র, যৌনতা, অপরাধ সবরকমের উপাদানই রয়েছে। অন্যদিকে আবার সাত ও আটের দশকের ভারতে পুঁজি-শ্রম দ্বন্দ্বের খতিয়ান রয়েছে। এসবের পিছনে পিছনে চলেছে এক ‘চিরকালীন’ কাহিনি– নারীসত্তার ব্যাপ্তি ও ট্র্যাজেডি। শেষ দৃশ্যে যখন ভোরের আধো আলোয় জানকী (স্মিতা পাটিল) আর রাহুল (আমোল পালেকর) সেতুর উপরে দুই পৌরাণিক চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, কাব্যের ভাষায় কথা বলে, তখন বোঝা যায় আরও প্রাচীন কোনও আখ্যান এতক্ষণ তলায় তলায় বয়ে চলেছিল।
এসব শুনে কুমারের শিক্ষক ঋত্বিক ঘটকের কথা মনে পড়ে যাবে। তরঙ্গ-এর জানকীর মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা-র (১৯৬০) নীতার ছায়া রয়েছে। জানকী মৃত শ্রমিকের স্ত্রী, শিল্পপতি রাহুলের বাড়িতে কাজ করতে আসে। রাহুলের সন্তানকে লালন করে, রাহুলের শারীরিক ক্ষুধা মেটায়, তার অপরাধের মধ্যেও জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, সে স্বামীর সঙ্গী শ্রমিকদের আশ্রয়। দালাল ইউনিয়নের নেতাকে সে চিনিয়ে দেয়, কিন্তু শ্রমিকদের মারের হাত থেকে সেই নেতাকে বাঁচাতেও হয় তাকে। মার খেয়ে সেই লোকটা যখন পড়ে থাকে নেপথ্যে জানকীর প্রতি এক শ্রমিকের উক্তি: ‘এও তোমার বোঝা জানকী, তোমাকেই বহন করতে হবে।’ রাহুল সব কেড়ে নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়। শ্রমিক বস্তিতে ফিরে গিয়ে দাঙ্গাবাজদের হাতে জানকী খুন হয়ে যায়। নীতাকে নিয়ে কলোনির বংশী মুদির উক্তি: ‘শান্ত মেয়ে, ওর কি এত দুঃখ সাজে’ মনে রেখেই যেন কুমার এই গল্প সাজিয়েছেন। কলোনির উঠোন পেরিয়ে উমারূপী নীতার হিমালয়ের বুকে ফিরে যাওয়ার মতোই জ্বলন্ত বস্তি থেকে উঠে এসে ভোরবেলার খোলা সেতুর ওপরে ঊর্বশীর ভূমিকায় জানকীর আবির্ভাব। রাহুল সেখানে পুরুরবা।
ঋত্বিক ছবির অর্থবিন্যাসের সঙ্গে রিচুয়ালের মিল নিয়ে লিখেছিলেন। ওঁর মতে, প্রাথমিক স্তরে একটা টানা গল্প হয়তো থাকে। একটু গভীর স্তরে প্রবেশ করলে দেখা যায় রাজনৈতিক সামাজিক দ্যোতনা। আরও গভীরে প্রবেশ করে যার মন সে দর্শনগত সংকেত খুঁজে পায়। আর তার পরের স্তরে যে যায় সে ‘অজ্ঞেয় কিছু একটার দোরগোড়ায় গিয়ে উপস্থিত’ হয়। এক সাধারণ ত্রিকোণ সম্পর্কের উপর স্তরে স্তরে সাজানো কোমল গান্ধার (১৯৬১) বিষয়ে লিখেছিলেন, ‘এ ছবির দর্শকের কাছে একটি এপিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রার্থনীয়’। ওঁর ছাত্র যে এই রীতি অনেকটা অনুসরণ করেছেন সন্দেহ নেই। কিন্তু কুমারের ছবি একেবারে অন্য স্বাদের। এক বিখ্যাত লেখায় কুমার বলেছিলেন, ঋত্বিকের উত্তরাধিকার বহন করবার অর্থ তাঁর মতো করে ছবি করা নয়, বরং সব ঐতিহ্যের মতোই সেই উত্তরাধিকারকে ভেঙে-চুরে নেওয়া।
শিক্ষকদের কথা বলতে ভালোবাসতেন। ওঁর আরেক শিক্ষক ছিলেন দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী। ‘পুণে ফিল্ম ইন্সটিটিউট’-এর পিছনের পাহাড়ে হাঁটতে হাঁটতে কোশাম্বি কুমারকে দেখাতেন, পাথরের গায়ে খোদাই করা লিপি, পাথরের প্রাচীন ব্যবহার্য বস্তুর অবশেষ। মিথ অ্যান্ড রিয়ালিটি (১৯৬২) বইতে কোশাম্বী ঋগবেদ থেকে মহাভারত অবধি ঊর্বশী-পুরুরবা কাহিনির বিবর্তনের ইতিহাস শুনিয়েছেন। ওই মিথ যে কুমারের ছবিতে প্রবেশ করবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু যে শিক্ষকের প্রভাব কুমার ও তাঁর সতীর্থ মণি কলের ছবিতে একেবারে প্রত্যক্ষ, সরাসরি ওঁদের ছবি থেকে পড়ে নেওয়া যায়, তিনি রবের ব্রেসঁ। কুমার তাঁকে আ জেন্টল উওম্যান (১৯৬৯) ছবিতে অ্যাসিস্ট করেছিলেন। কুমার ও মণির ছবির যে পরিচিত নীরব, মিনিমালিস্ট স্টাইল, ধীর গতি, নিরাবেগ অভিনয় (কুমারের ভাষায়, ‘এক্সপ্রেশনিজম’ বর্জিত অভিনয়), শারীরিক মুদ্রা অসম্পূর্ণ রাখবার কৌশল, দুটি শটের বা দুই দৃশ্যের মাঝে সংযোগ শিথিল করে দেওয়ার রীতি– সেইসবই ব্রেসঁর ছবিকে মনে পড়িয়ে দেয়। কুমার অবশ্য অভিনয়ে কখনও কখনও ‘স্বাভাবিকতা’র মিশেল এনেছেন। উদাহরণ, তরঙ্গ বাকসবা-র (১৯৯১) অভিনয়।
রবের ব্রেসঁর ছবিতে যে কৃচ্ছ্রতার চিহ্ন, শিল্পনিষ্ঠা, আপোসহীন উৎকর্ষ সন্ধান দেখি, তা কুমার বা মণি কলের কাজে আর চিন্তায় স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। এইভাবে ছবি করলে শুধু বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাই নয়, ছবি করতে অনেকটা ধৈর্য্য ও প্রচুর সময় লাগে। কাজেই ব্রেসঁর মতোই এঁরা খুব অল্প কাজ করে যেতে পেরেছেন। কুমার সাহানির পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির সংখ্যা পাঁচ। যে তিনটের কথা উল্লেখ করেছি তা ছাড়া রয়েছে খেয়াল গাথা (১৯৮৯) আর চার অধ্যায় (১৯৯৭)। ২২ বছরে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যে শিক্ষকের প্রভাব কুমার ও তাঁর সতীর্থ মণি কলের ছবিতে একেবারে প্রত্যক্ষ, সরাসরি ওঁদের ছবি থেকে পড়ে নেওয়া যায়, তিনি রবের ব্রেসঁ। কুমার তাঁকে আ জেন্টল উওম্যান (১৯৬৯) ছবিতে অ্যাসিস্ট করেছিলেন। কুমার ও মণির ছবির যে পরিচিত নীরব, মিনিমালিস্ট স্টাইল, ধীর গতি, নিরাবেগ অভিনয় (কুমারের ভাষায়, ‘এক্সপ্রেশনিজম’ বর্জিত অভিনয়), শারীরিক মুদ্রা অসম্পূর্ণ রাখবার কৌশল, দুটি শটের বা দুই দৃশ্যের মাঝে সংযোগ শিথিল করে দেওয়ার রীতি– সেইসবই ব্রেসঁর ছবিকে মনে পড়িয়ে দেয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সংখ্যালঘু রসিকজনের কাছেও অচেনা বা দুর্জ্ঞেয় থেকে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়েছিল।তরঙ্গ ছবির সম্পাদনায় রঙিন রাশ ফুটেজ ব্যবহার করেছিলেন। ওরকম কাজ কেউ করতেন না। রঙিন ছবির সম্পাদনা হতো সাদা-কালো রাশ-এ, না-হলে খরচ বেড়ে যেত। কিন্তু কুমার শুধু গল্পের যুক্তি মেনে সম্পাদনা করতেন না, রঙের সূত্র ধরেও শটের সঙ্গে শটের সংযোগ খুঁজতেন। মনোযোগী দর্শক রঙের বিন্যাস চিনতে পারে, কিন্তু এইভাবে রঙের সংযোগ-সূত্র ধরে ছবির সঙ্গে এগোনোর অভ্যাস আমাদের কারোরই বিশেষ নেই। আর রঙের চরিত্র নিয়ে কুমার যা করবার চেষ্টা করেছেন তাকে চিনে নেওয়া তো আরওই কঠিন। ওঁর প্রায় সব ছবিতে যিনি ক্যামেরার দায়িত্বে ছিলেন, সেই কে. কে. মহাজনকে মায়া দর্পণ করবার সময়ে বলেছিলেন এমনভাবে আলো ও ফিল্টার ব্যবহার করতে যাতে নীল রং অনেকটা মুছে যায়, এবং রং স্যাচুরেটেড না হয়। ইস্টম্যান কোডাক যে ফিল্মের স্টক তৈরি করতো দুনিয়া জুড়ে তার আদর্শ ব্যবহাররীতি প্রতিষ্ঠিত ছিল। রং স্যাচুরেট করা হবে, সেটাই ছিল নিয়ম। কুমারের মনে হয়েছিল, পশ্চিমি দেশের রোদ আর রঙের সজ্জার কথা মাথায় রেখে ওই আদর্শ চালু করা হয়েছে। আমাদের দেশের রোদের আলো, উষ্ণতা, আমাদের জীবনে রঙের প্রকাশ অন্যরকম। তার প্রতি সুবিচার করতে গিয়ে কে. কে. ও কুমার রঙের চরিত্র যেভাবে বদলে দিলেন, তা দর্শকের আদৌ চোখে পড়বে কি না, বা অসুন্দর ঠেকবে কি না তাই নিয়ে কুমার নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কে. কে. জানিয়েছেন, কীভাবে ল্যাবরেটরিতে বসে থেকে ওঁকে টেকনিশিয়ানদের বহু কষ্টে বোঝাতে হত, ওঁর নেগেটিভ কীভাবে প্রসেস করতে হবে। এখন ডিজিটাল যুগে ফিল্ম স্টক আর ল্যাবরেটরির কোনও ভূমিকা নেই, কালার কারেকশন করতে গিয়ে সফটওয়্যারের দৌলতে অনেক কম পরিশ্রমে ইমেজকে ইচ্ছেমতো বদলানো যায়। কিন্তু রং ব্যবহারের আদর্শ বদলানো যায়নি। সব ছবিকেই কীভাবে হলিউডি চেহারা দেওয়া যায় সেটাই বেশির ভাগ ছবি-করিয়ের অভীষ্ট।
তরঙ্গ-এর এক স্মরণীয় দৃশ্যে শ্রমিকদের ঝুপড়ির ভিতরে জানকীকে রেখে জানলা দিয়ে রেললাইনে ট্রেনের আনাগোনা ধরেছিলেন কে. কে.। অপরিসর ঝুপড়ির মধ্যে সিনেমাস্কোপের প্রসারিত ফ্রেমে ক্যামেরা নাড়াচাড়া করা কঠিন ছিল, কিন্তু কুমার চেয়েছিলেন ক্যামেরা ট্র্যাক করে একবার ডান থেকে বামে, একবার বাম থেকে ডানদিকে যাবে। বাইরের এক্সপোজার ঠিক রাখতে গিয়ে জানকী কিছুটা অন্ধকারে পড়ে গিয়েছিল। মূল চরিত্রের উপর কম আলো ফেলবার নিয়ম নেই। কিন্তু শুধু সেই নিয়ম নয়, আলোর স্বাভাবিক উৎস মাথায় রেখে যেভাবে লাইট করা হতো, তাকেও মেনে চলতে চাইতেন না পরিচালক। ওটা ওঁর কাছে ছিল রিয়ালিটি সম্বন্ধে রিয়ালিজমের এক ভ্রান্ত ধারণা।
রিয়ালিজম বা বাস্তববাদের বিরুদ্ধে আরেক অস্ত্র ছিল চরিত্র এবং অ্যাকশনের ক্রমপরিণতি আর ঘটনা-পরম্পরার যুক্তিকে ব্যাহত করা। এই কাজটা নানাভাবে করা যায়। করা হয়েছেও। কুমার বা মণি কল যে ভারতীয় নিউ ওয়েভের শরিক তার সূচনা হয়েছিল মৃণাল সেনের ভুবন সোম (১৯৬৯) ছবিতে। সেই ছবিতেও পরিচিত বাস্তববাদী রীতি অনুসরণ করা হয়নি। কিন্তু কুমাররা একেবারে অপরিচিত এক পন্থা অবলম্বন করলেন। এর একটা সূত্র লুকিয়ে আছে ফোরগ্রাউন্ড-ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্ক যে পারস্পেকটিভ রচনা করে, উপস্থাপনের র্যাশনালিটি যার উপরে দাঁড়িয়ে থাকে, তার লঙ্ঘনে। মুখ্য চরিত্রকে আন্ডার-এক্সপোজ করে পিছনের রেললাইন পর্যাপ্ত আলোতে দেখানো সেই লঙ্ঘনের একটা পদ্ধতি। মণি কল একে বলতেন ‘কনভারজেন্স’ বিরোধিতা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: কবিতার মতো করেই সিনেমাকে পড়তে বলেছেন কুমার সাহানি
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরেকটা পদ্ধতি এঁরা বেছে নিয়েছিলেন, যার সঙ্গে দর্শক হিসেবে বোঝাপড়া করা আরও কঠিন। দুজনেই মার্গ সঙ্গীত শিক্ষা করেছিলেন। মণি জিয়া মহিউদ্দিন ডাগরের শিষ্য ছিলেন; ধ্রুপদ (১৯৮৩) নামে ছবি করেছেন। কুমার অন্নপূর্ণা দেবী সহ একাধিক গুরুর কাছে হিন্দুস্তানি সঙ্গীতে শিক্ষা নেন; খেয়াল গাথা ছবি করেছেন। কুমার চেয়েছিলেন খেয়াল-গায়নে যেভাবে স্বর আর শ্রুতির বিস্তার ঘটে সেই নিয়মে আখ্যানের বিস্তার ঘটাবেন। কারণ, ওঁর মতে যেসব শিল্পকলা সময়ে ভর করে চলে তাদের মধ্যে খেয়াল সবচেয়ে উন্নত আঙ্গিক। ওটা ওঁর কাছে ছিল গল্প-বলার চালু ব্যাকরণ ভেঙে বেরোবার উপায়। প্রচলিত ব্যকরণ চরিত্রের, ক্রিয়ার এমন কিছু সর্বসম্মত আইন মেনে গল্প সাজায় যেখানে অপ্রত্যাশিত উপলব্ধির, নতুন সংযোগ-সাধনের, দৃশ্যের মধ্যান্তরে চিন্তার কোনও সুযোগ থাকে না। সেইরকম সংযোগ না ঘটালে তরঙ্গ-এর জানকীর ঝুপড়িতে ক্যামেরা ডাইনে বামে সরতে সরতে হঠাৎ বাইরে সন্ধ্যা নেমে আসত না। বাইরে অন্ধকার দেখা গেলে পর বুঝি ক্যামেরার প্রদক্ষিণ এক ধরনের সময়ের আবর্তনের সংকেত বহন করছিল। চিন্তার সূত্র বিস্তার করা না গেলে জানকীর কাহিনি এক সন্ধিক্ষণে ঊর্বশী-পুরুরবার গল্পে প্রবেশ করতে পারত না। মায়া দর্পণ-এর কথা মনে পড়বে, যেখানে ছবির শেষদিকে আমরা চরিত্রদের ছেড়ে হঠাৎ এক দীর্ঘ ছৌ নাচের দৃশ্যে ঢুকে পড়ি।
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যে বন্ধনে সাধারণত সিচুয়েশন বেঁধে রাখা হয়, স্বাভাবিকভাবেই তা শিথিল হয়ে যায় কুমারের ছবিতে। এর একটা লক্ষণ, প্রায় কখনওই দুই চরিত্রের সংলাপে দুই দিক থেকে অদল বদল করে শট-রিভার্স শট, নেওয়া হয় না। যেসব কারণে ওঁর ছবিতে আবেগের প্রকাশ ব্যাহত হয় তার মধ্যে এও একটা। বিকল্প প্রকাশ সন্ধান করতে গিয়ে মাঝে মাঝে স্মরণীয় কিছু মুহূর্ত সৃষ্টি করেছেন কুমার। কসবা ছবি থেকে এমন একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। ব্যবসায়ী মণিরামের গৃহবধূ, ছবির প্রধান নারী চরিত্র তেজো সন্তানহীন। আরেক বধূ শান্ত, প্রায় নির্বাক নন্দিনী। তার শিশুপুত্রের নামে মণিরাম সম্পত্তি লিখে দেওয়ার পরে তেজো উন্মত্ত ক্রোধে সেই শিশুর উপর গরম জল ঢেলে তাকে মেরে ফেলে। নেপথ্যে নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শুনি, ক্যামেরা নিচ থেকে ওপরে একটা বাড়িকে দেখতে থাকে। যে বাড়িতে ঘটনাটা ঘটল এ সেই বাড়ি নয়, জানলায় বসে আছে যারা তারাও আমাদের অপরিচিত। আমরা টের পাই, ছবি জুড়ে যে স্থাপত্য দর্শন চলেছে এ তারই অসময়োচিত আবির্ভাব। তীব্র মানসিক প্রতিক্রিয়া শব্দে থাকে, দৃশ্যে বিযুক্তি ঘটে যায়। দর্শকের মন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
এর একটু পরে নন্দিনী জড়ানো কাপড় বাচ্চার মতো করে কোলে নিয়ে একা একা ট্রাকে চড়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। ট্রাক ড্রাইভার আর তার হেল্পারের সঙ্গে রাতের রাস্তায় যেতে যেতে সংসার নিয়ে, মনুষ্য জীবন নিয়ে, দুঃখ নিয়ে নন্দিনীর কথা হয়। মৃত্যুর পরে আত্মা কতদিন পৃথিবীতে থাকে? এতক্ষণ চুপ করে থাকা হেল্পার ছেলেটা বলে, ১৩ দিন। সে কী করে জানল? ড্রাইভার বলে, গত মাসেই ওর মা মারা গেছে। সেইজন্যেই ছেলেটা এত চুপচাপ। আমরা এতক্ষণে ছেলেটির মুখ দেখি। বেদনায় ম্লান দুই চোখ। নন্দিনী তার দিকে তাকায়, মুখ ফেরায়।
আবার ঘুরে সোজা ক্যামেরার দিকে, আমাদের দিকে তাকায়। একটু পরে মুখ ঘুরিয়ে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এদের সংলাপ চলে কণ্ঠস্বরের আবেগ এড়িয়ে, একটানা সুরে। আসলে এক থেকে অন্য সত্তায় আবেগের হাতবদল হয়। শিশুহারা নন্দিনীর দুঃখ মাতৃহীন অচেনা লোকের মুখে প্রতিধ্বনিত হয়।