শ্যাম বেনেগাল তার সমসাময়িক নবতরঙ্গের চলচ্চিত্রকারদের থেকে অনেক বেশি করে সরকারি কমিটি বা প্রতিষ্ঠান গঠনের কাজে যুক্ত ছিলেন এবং এটা স্বীকার করতেই হবে, তিনি কেবল ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করার জন্য এইসব করেননি। তার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বাঙ্গীন উন্নতির একটা প্রচেষ্টা ছিল। আর তাই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ, চলচ্চিত্র আন্দোলন এবং চলচ্চিত্রবিদ্যা– এই তিনটে ক্ষেত্রের মধ্যে চেয়েছিলেন একটা মিথস্ক্রিয়া চলতে থাকুক। তা হয়েছে কি হয়নি, সেটা ভাবনার পরিসর এটা নয়। কিন্তু অন্তত একজন চলচ্চিত্রকারকে আমি দেখেছিলাম, যাঁর মনের মধ্যে খুব পরিষ্কার ধারণা ছিল। এই তিনটে ক্ষেত্রকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করার ভাবনা ছিল, যাতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সম্ভব হয়।
শ্যাম বেনেগালের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ‘ভরত এক খোঁজ’-এর মাধ্যমে। তখন সদ্য যৌবনে আরও অনেক আকর্ষণ ছিল, তবুও শ্যাম বেনেগালের টেলি-ধারাবাহিক পছন্দ হয়ে গিয়েছিল নানা কারণে। প্রথমত, রোহন শেঠের চমৎকার অভিনয়, আর তার সঙ্গে নিবিষ্ট পরিচালন-শৈলী, শান্ত বর্ণনা-ঢং। পরিচালকের নাম জানার আগ্রহ থেকে পরিচয় হল শ্যাম বেনেগালের সঙ্গে।
আর দ্বিতীয় ঘটনাটা একেবারে সরাসরি– তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া। রাজধানী শহরে একটা অনুষ্ঠানে হাজির ছিলাম। শহরের প্রধান সংস্কৃতি কেন্দ্রে একদিন সকালে প্রাতরাশের সময় আমার নিমন্ত্রণকর্তা বৃদ্ধ চলচ্চিত্র সমালোচক জিজ্ঞেস করলেন, ‘বোস: দ্য ফরগটেন হিরো’ তোমার কেমন লেগেছে? বললাম, ভালো লাগেনি, উদ্দেশ্যহীন মনে হয়েছে কিছুটা। আসলে আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে এটা একটা ফাঁদ, যাতে আমি পা দিয়েছি। কারণ, পরের মুহূর্তেই বৃদ্ধ বন্ধুটি কিছুটা গলা তুলে আমাদের পিছনের টেবিলের বসে থাকা কারও একটা উদ্দেশে বললেন, ‘এই যে শোনো শ্যাম “বোস: দ্য ফরগটেন হিরো” এই ছেলেটির ভালো লাগেনি, ও চলচ্চিত্রবিদ্যার গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে।
ঘাড় ঘোরাতেই দেখি এক বৃদ্ধ হাসি হাসি মুখে এ কথা শুনে আমাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু এ কী! এ তো শ্যাম বেনেগাল স্বয়ং! আমাকে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ছবিটা ভালো লাগেনি তো? তোমার সঙ্গে একমত, ছবিটা আমারও ভালো লাগেনি।’ তাঁর রসিকতার বরাভয়ে আমার ভয়টা কেটে গেল। তিনি আমাদের টেবিলে একটা চেয়ার টেনে বসলেন, জিজ্ঞেস করলেন, চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগ কেমন চলছে? নতুন কী কী বিষয় সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? বললাম সংক্ষেপে। আর একটু সাহস সঞ্চয় করে জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা, এই যে আপনাদের সময় ১৯৭০ দশকে এত ফিল্মমেকার উঠে এসেছেন ফিল্ম স্কুল থেকে। যাঁরা কি না ভারতীয় সিনেমার মানচিত্রটাকে পাল্টে দিয়েছেন। আজকাল আর নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমার মতো এইরকম মুভমেন্ট ফিল্ম স্কুল থেকে শিক্ষা নেওয়া নতুন প্রজন্মের কাছে পাচ্ছি না কেন?’
…………………………………………….
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগ এবং এসআরএফটিআই-এর প্রতিষ্ঠা পর্বে তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি বললেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম চলচ্চিত্রবিদ্যা চর্চা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ পারস্পরিক আদান-প্রদানের উপর ভিত্তি করে চলুক। কারণ, যে দেশে চলচ্চিত্র সমালোচনা চলচ্চিত্র পাঠ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, সেখানে চলচ্চিত্র জগতের খুব বেশি উন্নতি হয় না। নতুন সৃষ্টির জন্য চারপাশে কি ঘটছে, বিশ্ব চলচ্চিত্র কোন পথে চলেছে এসব কিছু সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। তাই এই দুটোকে একসঙ্গে চলতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত সেটা শেষ পর্যন্ত হল না।’
…………………………………………….
তিনি একটা উত্তর দিয়েছিলেন। কথাটা আমি চিরকাল মনে রেখেছি। বলেছিলেন, ‘আসলে ইনোভেশন ছাড়া শিল্প হয় না। শিল্পীকে ইনোভেশন দিয়ে তার কন্সট্রেন্টগুলোকে ওভারকাম করতে হয়। আজকাল ফিল্ম স্কুলগুলো ওভার এভেলেবেলিটির সমস্যায় ভুগছে। ফলে তারা কন্সট্রেন্টগুলো বুঝতে পারছে না। সব পেয়ে যাচ্ছে, তাই ইনোভেশনের তাগিদটা অনুভব করছে না।’ বললেন, ‘ভাবো, সুব্রত মিত্র বা কে কে মহাজন যদি সবকিছু পেয়ে যেত তাহলে তাঁরা কি ইনোভেশন করতে পারতেন?’ অনেকক্ষণ ধরে কথা শুনলেন ধৈর্য ধরে, সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগ এবং এসআরএফটিআই-এর প্রতিষ্ঠা পর্বে তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি বললেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম চলচ্চিত্রবিদ্যা চর্চা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ পারস্পরিক আদান-প্রদানের উপর ভিত্তি করে চলুক। কারণ, যে দেশে চলচ্চিত্র সমালোচনা চলচ্চিত্র পাঠ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, সেখানে চলচ্চিত্র জগতের খুব বেশি উন্নতি হয় না। নতুন সৃষ্টির জন্য চারপাশে কি ঘটছে, বিশ্ব চলচ্চিত্র কোন পথে চলেছে এসব কিছু সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। তাই এই দুটোকে একসঙ্গে চলতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত সেটা শেষ পর্যন্ত হল না।’
কথাগুলো বলছি এই কারণে যে, শ্যাম বেনেগাল তার সমসাময়িক নবতরঙ্গের চলচ্চিত্রকারদের থেকে অনেক বেশি করে সরকারি কমিটি বা প্রতিষ্ঠান গঠনের কাজে যুক্ত ছিলেন এবং এটা স্বীকার করতেই হবে, তিনি কেবল ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করার জন্য এইসব করেননি। তার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বাঙ্গীন উন্নতির একটা প্রচেষ্টা ছিল। আর তাই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ, চলচ্চিত্র আন্দোলন এবং চলচ্চিত্রবিদ্যা– এই তিনটে ক্ষেত্রের মধ্যে চেয়েছিলেন একটা মিথস্ক্রিয়া চলতে থাকুক। তা হয়েছে কি হয়নি, সেটা ভাবনার পরিসর এটা নয়। কিন্তু অন্তত একজন চলচ্চিত্রকারকে আমি দেখেছিলাম, যাঁর মনের মধ্যে খুব পরিষ্কার ধারণা ছিল। এই তিনটে ক্ষেত্রকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করার ভাবনা ছিল, যাতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সম্ভব হয়।
তিনি কত বড় চলচ্চিত্রকার ছিলেন, সেকথা বুঝিয়ে বলা– এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। ইতিহাস আমাদের পরিষ্কার তথ্য দেয় যে, শ্যাম বেনেগাল ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান দিক্দর্শী ছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাস্তববাদে কঠোর বাস্তবকে উন্মোচনের যে ধারাটি তাঁর চলচ্চিত্রে যেমনভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তেমনভাবে আর কারও ছবিতে দেখা যায়নি। ‘অঙ্কুর’-এর মতো ছবি আজও আমাদের টানে তার কারণ, সে ছবির বাস্তববাদ পেলব, লিরিকাল নন্দনকানন নয়, বরং ঊষর একটা প্রস্তরময় ভূমি, যেখানে বেঁচে থাকার একটা কঠিন লড়াই চলছে। তাঁর ছবির গ্রাম সরষে ফুলের গন্ধে-মথিত দিগন্ত-বিস্তৃত নিসর্গ নয়। তাঁর ছবির বাস্তববাদে ঘাম-রক্তের কটু গন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর ছবির নিসর্গে শোষক আর শোষিতের মরণপণ যুদ্ধ দিগন্ত-ছোঁয়া আকাশের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। ফলে ‘অঙ্কুর’ ভারতীয় ছবির একটা আশ্চর্য মাইলস্টোন।
এটা ভেবে দেখার যে, ভারতীয় নবতরঙ্গের সবচেয়ে রাগী তিনটি ছবি, মৃণাল সেনের ‘ওকা উরি কথা’ শ্যাম বেনেগালের ‘অঙ্কুর’ এবং গৌতম ঘোষের ‘মাভূমি’ তেলেঙ্গানার গ্রাম-সমাজ নিয়ে তৈরি। হয়তো (শ্যাম বেনেগালের নিজের রাজ্য) তেলেঙ্গানার মাটি প্রান্তিক কৃষকের ঘামে ভেজা। শুধু তাই নয়, সে মাটি কৃষকের রক্ত শোষণ করেছে। তাই হয়তো ‘অঙ্কুর’, ‘মাভূমি’ আর ‘ওকা উড়ি কথা’ তেলেঙ্গানার লড়াইয়ের আঘ্রাণ ধরতে চায়। জমি-জমিদার-কৃষক-রাষ্ট্র– বারবার এই জটিল আবর্তের কথক হিসেবে আমরা শ্যাম বেনেগালকে দেখি। সামন্ততন্ত্রের অবশেষ তাঁর ‘অঙ্কুর’, ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’ ছবিতে যেভাবে দাঁত-নখ বের করে শেষ আঘাত আনার চেষ্টা করে, তা আমাদের সমাজ-ইতিহাসের দলিল হয়ে ওঠে। ‘অঙ্কুর-নিশান্ত’ তাই আমাদের কাছে এমন এক অর্থ বহন করে, যা চলচ্চিত্রের থেকেও বেশি।
পরবর্তীকালে ‘মন্থন’ তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আবার কৃষক, গ্রাম, যৌথতা, সামন্ততান্ত্রিক-মানসিকতার সংকীর্ণতা সব মিলে একটা কোঅপারেটিভ নির্মাণের গল্প। একটা গল্পের মধ্যে সমাজের বিভিন্ন অংশের টানাপোড়েন আর সংঘাত ভারতের কোনও চলচ্চিত্রকার যদি সবচেয়ে তীব্রভাবে দেখিয়ে থাকতে পারেন তবে তিনি নিঃসন্দেহে শ্যাম বেনেগাল। আসলে ‘অঙ্কুর’, ‘নিশান্ত’ এবং ‘মন্থন’ কেবল শিল্পের দিক থেকে নয়, জনপ্রিয়তার দিক থেকেও তাঁকে ভারতীয় ছবির অন্যতম জরুরি পরিচালকের আসন দেয়।
পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়ের ওপর তাঁর তথ্যচিত্র একটি প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে সত্তর এবং আশির দশকে নির্মিত তাঁর ছবিগুলির যে শান দেওয়া ছুরির মতো তীব্র সংঘাতময় বাস্তববাদ, তার থেকে তিনি কিছুটা সরে আসেন পরের দিকে। ‘দ্য মেকিং অফ দ্য মহাত্মা’, ‘সরদারি বেগম’, ‘সুরজ কা সাতমা ঘোড়া’, এই ছবিগুলো আমাদের আর শ্যাম বেনেগালের প্রথম সারির কাজ মনে হয়নি। তার কারণ এটা নয় যে, এই ছবিগুলো মানের দিক থেকে দ্বিতীয় স্তরের, কারণ এটাই যে আমরা একটা ক্ষুরধার বাস্তববাদের রূপায়ণকারী বলে শ্যাম বেনেগালকে চিনে নিয়েছিলাম। সেটাই ভারতীয় ছবিতে তাঁর প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তবু তাঁর শেষ দিকে নির্মিত ‘ওয়েলকাম টু সজ্জনপুর’ ভারী মায়াময় ছবি। আসলে যে পথে তিনি সত্তর বা আশির দশকে করতেন, ৯০-এর দশক থেকে যখন ভারতীয় নবতরঙ্গের সূর্য অস্তগামী তখন অন্য চলচ্চিত্রকারদের মতো তাকেও সে পথ একটু বদল করতে হল। এই বদল করা পথে তিনি কতটা ছন্দ ছিলেন, সে-বিষয়ে আমি কিছুটা সন্দিহান। কিন্তু তবু বলব তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার খবর পেয়ে ‘অঙ্কুর’, ‘নিশান্ত’-এর মতো মনের কোণে ‘ওয়েলকাম টু সজ্জনপুর’-এর বিভিন্ন দৃশ্যও উঁকি মেরে যাচ্ছে। বোধহয় এই ছবিটা তাঁর প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র গ্রামীণ ভারত (আর সে সমাজের ভিতর বাহিরের সংঘাত ও দ্বন্দ্ব) ছেড়ে বিদায় নেবার মুহূর্তে একটা বিদায় সম্ভাষণ। আর কেউ আমাদের সজ্জনপুর গ্রামে, যে গ্রাম উইলিয়াম ফকনারের উপন্যাসের গ্রামের মতো কল্পিত কিন্তু অলীক নয়, সেখানে স্বাগত জানাবে না। শ্যাম বেনেগাল বিদায় নিয়েছেন।
.………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………