ছয়ের দশকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলাম। গান শিখব বলে। তখন শান্তিনিকেতনের আবহাওয়া অন্যরকম। বিভিন্ন কালচারের মিলিউ ছিল। আমাদের আশ্রম অদ্ভুত সুন্দর ছিল, আক্ষরিক অর্থেই ‘খোলামেলা’। লেখাপড়া, গান, ছবি আঁকা, প্রশ্ন সবই করা যেত। প্রশ্ন করা যেত। সেসময় সবাই সত্যিই শান্তিনিকেতন-প্রেমী ছিল। তারপর সত্তর ছুঁয়ে আশিতে একটা ট্রান্সফরমেশন হল। মিলিউ বদলে বদল এল, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গেই এল। আমাদের যাঁরা সিনিয়র ছিলেন, বড় ভালো ছিলেন।
আপনার কাছে ‘সংবাদ প্রতিদিন’ রোববার.ইন-এর প্রতিনিধি হয়ে এসেছি। আমি ওঁদের সাংবাদিক নই, বন্ধুমাত্র। যা নিয়ে আপনার বলতে ইচ্ছে করছে, আমরা তাই দিয়ে শুরু করি।
বলো দেখি কী নিয়ে আমরা কথা বলব? আমার সব কিছুই তো শান্তিনিকেতন। এই শান্তিনিকেতনে কবে এলাম, কেন এলাম, তাই দিয়ে শুরু করি?
করুন। আমি তো আশ্রমকন্যা নই, আমাদের আশ্রম চেনাতে কোথায় ফিরে যাবেন। ফিরে যাবেন কী আদৌ?
ছয়ের দশকে ফিরব। ছয়ের দশকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলাম। গান শিখব বলে। তখন শান্তিনিকেতনের আবহাওয়া অন্যরকম। বিভিন্ন কালচারের মিলিউ ছিল। আমাদের আশ্রম অদ্ভুত সুন্দর ছিল, আক্ষরিক অর্থেই ‘খোলামেলা’। লেখাপড়া, গান, ছবি আঁকা, প্রশ্ন– সবই করা যেত। প্রশ্ন করা যেত। সেসময় সবাই সত্যিই শান্তিনিকেতন-প্রেমী ছিল। তারপর সত্তর ছুঁয়ে আশিতে একটা ট্রান্সফরমেশন হল। মিলিউ বদলে বদল এল, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গেই এল। আমাদের যাঁরা সিনিয়র ছিলেন, বড় ভালো ছিলেন। সেই কৃষ্টিতে ধীরে ধীরে দেওয়াল উঠতে শুরু করল। বাইরে থেকে যাঁরা পরে এসেছেন, এসে শান্তিনিকেতনকে নিজেদের মতো করে ভালোবেসেছেন হয়তো, কিন্তু আমরা শান্তিনিকেতনকে শান্তিনিকেতনের মতো করে ভালোবেসেছি। পুরনো মানুষেরা চলে গিয়েছেন। কত কিছু নিয়ে চলে গেলেন সঙ্গে করে।
(এরই মধ্যে এক ছাত্রী এলেন একটি খাতা ফেরত দিতে। ভুল করে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে লজ্জিত। একগাল হাসি নিয়ে রিসিভ করলেন তাঁকে। ভুলে নিয়ে যাওয়ায় কোনও ক্ষতি হত না, তবে মনে করে ফেরত দিয়ে যাওয়ায় তাঁর যে কতখানি উপকার হয়েছে, মন খুলে সেই কথা ছাত্রীকে জানিয়ে ধন্যবাদ জানান)।
আপনি নাকি শান্তিদেব ঘোষকে একটা চিঠি লিখে শান্তিনিকেতন চলে এসেছিলেন গান শিখতে চান বলে। শান্তিদেব ঘোষকেই কেন বাছলেন? শান্তিনিকেতনকেই কেন বাছলেন?
(খানিক হেসে) শান্তিনিকেতনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক পুরনো। আমার পিসতুতো দাদা আর তাঁর বন্ধু, বলরাজ সাহানি শান্তিনিকেতনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। পরে ওঁরা ইংল্যান্ড যান। যখন আমি স্কুল ফাইনালের কাছাকাছি এসেছি, আমার দাদারা আমার পিসতুতো দাদাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমায় নিয়ে কী করা যায়। আমি গাইতে চাইলাম। সাত বছর বয়সে পোলিও হয়েছিল, তাই কোনও উস্তাদের বাড়ি নিয়মিত থেকে তালিম নিতে পারিনি। আমার সেই দাদা এন সি সি এক অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তিনিই মাস্টারমশাইদের খোঁজ দিলেন। একটা জওয়াবি পোস্ট কার্ডে শান্তিদাকে চিঠি লিখলাম। হ্যাঁ, এক চিঠিতেই চলে এসেছিলাম। সঙ্গে দাদা এসেছিলেন। শান্তিদাকে সংগীতভবনের পিওন রামদা গিয়ে বললেন, ওঁর কাছে কেউ এসেছে। শুনেই বুঝেছিলেন, আমি এসেছি। বেরিয়ে এসেছিলেন তৎক্ষণাৎ। অপেক্ষা করতে হয়নি আমাকে। এসে আমার দাদাকে বললেন, ওর অ্যাডমিশনের জন্য আপনাকে দেড় দিন অপেক্ষা করতে হবে। অথচ আমি বলেই এসেছিলাম যে, অ্যাডমিশন নিয়ে দোলাচলে থাকলে আমার পক্ষে আসা খানিক কঠিন হবে, চলা-ফেরা তো আমার জন্য সহজ বিষয় নয়। তাও সুদূর লুধিয়ানা থেকে শান্তিনিকেতন! তবু শ্বাস চেপে অপেক্ষা করেছিলাম। প্রশিক্ষণের খিদে আমার এমনই। দেড় দিন পর গিয়ে দেখি, ওই দেড় দিন শান্তিদা নিয়েছিলেন সিঁড়িগুলোকে র্যাম্প করে দিতে, যাতে আমার চলাফেরার পথ মসৃণ হয়। যে-ক’টা অবস্ট্রাকশন ভেঙে র্যাম্প করা যেত, সেইগুলি সবই উনি র্যাম্প করে দিয়েছিলেন। তৃতীয় দিনে সব দাদাকে দেখিয়ে বললেন, এবার আপনি ভাইকে রেখে যান। আমি, আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব যে ঘরে থেকেছেন, সেই ঘরে– কদমতলা হোস্টেলে আমার ঠাঁই হল। ভাঙিদা খেতে দিতে আসতেন হোস্টেলে। চমৎকার ঠেকা দিতে জানতেন তবলায়। এমনই ছিল শান্তিনিকেতন। আর এই ছিল সেইদিনের মাস্টারমশাই আর ছাত্রের সম্পর্ক। আজ কী আর সেই দিন আছে?
নেই?
না, এখানে, সেখানে, কোনওখানেই নেই। সমস্তটাই কেবল কৃত্রিম নানাবিধ নিয়মে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রজন্ম গঠনের প্রতি দায় থাকলে স্নেহশীল হওয়া প্রয়োজন। স্নেহ কই? ক্ষেত্র বিশেষে স্নেহকে কী ‘স্নেহ’ বলা যায়? আগেকার মাস্টারমশাইরা সকল ছাত্রছাত্রীর মন বুঝতে পারতেন, সেই মনকে সম্মান করতেন, তাই তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে, তাঁদের প্রশ্ন করতে, তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত হতেও কখনও ভাবতে হয়নি। সম্মান বিষয়টাই তো এমন, পারস্পরিক তাকে হতেই হবে। আমি তোমাকে সম্মান না করলে তুমি আমাকে সম্মান করবে কেন? কিন্তু যে কথা বলছিলাম, শান্তিনিকেতনে এসে কী কী হল। আস্তে আস্তে পরিচিতি হল, বন্ধু হল। যখন বন্ধু হচ্ছে, তখনই প্রথম বাংলা শুনছি মন দিয়ে। ইংরেজি আর হিন্দিতে কথা বলে কাজে চালাই, শান্তিদা আমার কাছে পাঞ্জাবি গান শোনেন মাঝে মাঝেই। টপ্পা বিশেষত। মোহরদিকেও (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) ডেকে শোনালেন একদিন।
এসবের মধ্যে আছি, এরই মধ্যে সহপাঠী শুচিস্মিতা বাংলা শিখতে বলল একদিন, যাতে কথোপকথন আরও সহজ হতে পারে, সহজ পাঠ কিনে দিল। ক, খ, গ, ঘ মুখস্থ করলাম দিন সাত ধরে। বছর খানেক কঠিন অধ্যবসায়ের পর প্রথম বাংলা বই, ‘চাঁদের পাহাড়’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রিয় লেখক। বাংলাকে আজ মাতৃভাষাই তো মনে হয়। আমার লাইব্রেরির বেশিরভাগই তো বাংলা বই। পাঞ্জাবিও আছে। অন্যান্য ভাষাও আছে।
ভাষা প্রসঙ্গে আবার আসছি, কিন্তু ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়েছেন যে, দেখেছেন কি? সিনেমা হয়েছে তো। কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় পরিচালনা করেছেন, অভিনয় করেছেন দেব।
না, দেখিনি। সিনেমা হয়েছে? জানিই না দেখো।
পাঞ্জাবি ভাষাচর্চা এখনও বজায় রেখেছেন?
একদম। এখনও পড়ি। রবীন্দ্রনাথের অনেক পাঞ্জাবি অনুবাদও আমার কাছে আছে। ক্লাস নাইনে প্রথম ‘গোরা’ পড়েছি, তাও তো পাঞ্জাবি অনুবাদেই। একবার রবীন্দ্রসংগীত পাঞ্জাবিতে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম, আট-দশটা গান। কোথায় যেন তালে মিলছিল না, তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার মনের মধ্যেই রয়ে গেছে। তাল আমি জানি না, তা তো নয়। তবু যখন কাজটা হাতে নিয়েছিলাম, তখন মেলাতে পারিনি। এ তো আর মজার কথা নয়, অনুবাদ অসম্ভব সময়সাপেক্ষ অনুশীলন। কঠিন অনুশীলন। দেখি, হয়তো আবার কখনও বসব কাজটা নিয়ে, বা বসব না। হিন্দিতে অনেক গান আমি নিজেই ট্রান্সলেট করে গাই।
আপনি অনেকবার বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের গানে ভাবের গুরুত্ব অপরিসীম। অনুবাদ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যখন একটি রবীন্দ্রসংগীত যাচ্ছে, ভাবে কোনও আঘাত হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন কি?
অনুভবের আগে আসে গানের অর্থ। মিনিং। রিয়ালিসশন থাকতে হবে। হিন্দির ১০ শতাংশ ট্রান্সলেশনে সেই মিনিং-টা আছে। অনুবাদ তো ভাষার প্রতি নির্ভর করে না, অনুবাদ নির্ভর করে অনুবাদকের প্রতি, তাঁর অনুভূতি এবং আত্মার প্রতি। যিনি অনুবাদ করছেন তাঁর মধ্যে যদি উপলব্ধি থাকে, তাঁর অনুবাদেও থাকবে। থাকবে না, তোমার কী মনে হয়? এই প্রসঙ্গেই বলি দেখো, রবীন্দ্রনাথ তো এত গান লিখেছেন, অনেক ফরমায়েশি গানও লিখেছেন। আশ্রমে সবাই বলেছে, কাল এই অনুষ্ঠানে দু’টি গান লিখে দিন, পরশু ওই অনুষ্ঠানে তিনটে। তাই হয়তো স্বাভাবিক। সব গানে কি আত্মা একইভাবে প্রকাশ পাওয়ার পরিসর পেয়েছে? পাঠক হিসেবে, গায়ক হিসেবে, শিল্পী হিসেবে আমার মনে হয়েছে, পায়নি। আমি ভুলও হতে পারি। যে গানগুলোয় পায়নি বলে আমার মনে হয়েছে, সেই সব গান আমি গাইতে পারি না। আশির কাছাকাছি রবীন্দ্রসংগীত আমি গেয়েছি, যেগুলোর মানে আমি উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণ সফল হয়েছি বলে আমার মনে হয়েছে। বাকিগুলো গাইতে চেষ্টা করিনি, পারিনি। অতএব, অর্থই হল আসল কথা। তা ভাষায় আসুক, সুরে আসুক, সুরের ভাষায় আসুক, বা ভাষার সুরে।
………………………………………………..
একটাই জিনিস বুকে বড় বাজে। কত ছাত্রী যে এসে বলে, ‘গুরুজি, আমার বিয়ে, তাই সংগীত শিক্ষা থেকে, সংগীত চর্চা থেকে আমি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিরতি নিলাম।’ তারপর আর তারা গানে ফেরে না। অথচ, গানই ওদের চালিকাশক্তি। অনেকেই হয়তো এই বিরতি স্বেচ্ছায় নেয় না, নিতে বাধ্য হয়। অথচ, সংগীত আর সংসার তো পরস্পরবিরোধী নয়। বেছে নিতে হচ্ছে এখনও। ওরা ভালো থাক। আমাদের সমাজে আজও… যাক গে!
………………………………………………..
সেসব গান গাইতে পারেননি, না গাইতে চাননি?
(হেসে গড়িয়ে পড়ে) রবীন্দ্রনাথের গান আমি গাইতে ‘চাইনি’ বলাটা অতি সাহস হয়ে যাবে না? এ কথা কি আমি বলতে পারি? পারিনি। ধরে নিয়েছি, এ আমারই ব্যর্থতা। ‘তবে কী ম্লানমুখে ফিরিবো সখা।’ এ গুরুদেবের অন্তরের গান (গেয়ে শোনালেন)… আমার মনে হয় না, এই গান ওঁকে কেউ লিখতে বলেছিলেন। কারও ক্যাপাসিটি হবে, কারও হিম্মত হবে এই গান লিখতে বলার? (আবার হাসি, পরের দু’লাইনও)। আমার মনে এমন যে গানগুলো এসেছে, আমি তাই শুনিয়েছি। অনুষ্ঠানে অনেকেই আজও বলেন ‘এই গানটা করুন, ওই গানটা করুন’। আমি স্পষ্টই বলি, এই গান আমি জানি না, আমি অন্য গান শোনাচ্ছি।
গাইতে চাননি বলা আপনার অতি সাহস হয়ে গেলে, গাইতে পারেননি লেখা আমার অতি সাহস হয়ে যাবে না কি?
(অট্টহাসি) বলো, নেক্সট কোয়েশচন।
আপনার দীর্ঘদিনের সফর সংগীতভবনের সঙ্গে। ছাত্র হিসেবে, অধ্যাপক হিসেবে। এমন যত স্মৃতি আছে, যা মুছে ফেলতে চাইবেন না কখনও, তার মধ্যে একটি রোববারকে বলুন?
মোহরদি একবার ছাত্রাবস্থায় আমায় দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন। শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের জন্য একটি গান বেছে নিয়ে সকলকে অনেক দিন ধরে শেখাচ্ছিলেন। আমি সেই ব্যাচের চাইতে জুনিয়র ছিলাম। আসা যাওয়ার পথে বার দুই সেই গান শুনে মোহরদিকে শোনালাম। খুব আপ্লুত হয়েছিলেন। ‘অবাঙালি হয়েও তুমি একেবারেই মোহন…’ গানটা এখনও খুব গেয়ে উঠি, আর ব্রহ্মমুহূর্তে মনে পড়ছে না!
আমরা কথা বলি, মনে পড়লেই বলে দিচ্ছি। আসলে তখন তো আমি ছাত্র। উনি সকলের প্রণম্য মোহরদি। আমার এত প্রশংসা করেছিলেন, এ কী আমার ভোলার, বলো? পরে রেডিওতেও গাইয়েছিলেন গানটা।
এই মোহরদিরই তো সহকর্মী হলেন কিছুদিনের মধ্যেই। সেই জীবনের কোনও স্মৃতি?
আরে, সে কথা আর বলো না। সংগীতভবনের পাঠ গুটিয়ে ঠিকই করে ফেলেছি, এসআরএ যাব। কথাবার্তাও হয়ে গেছে। মোহরদির চোখ ছল-ছল। বাধ সাধলেন। আমি আর রণধীর রায়– আমার বন্ধু, আমাদের বললেন, ‘তোমরা আমাদের কৃতি ছাত্র, তোমরা সংগীতভবনের সন্তান। তোমরা এখানে চাকরির দরখাস্তটুকু অন্তত দাও। থাকার চেষ্টাটাই করবে না?’ তারপরই টুকুদা পার্ট টাইম ক্লাস নেওয়ার চিঠি পেলেন। কিছু পোস্ট ফাঁকা হতে আমিও আবেদন করলাম। অলোক চ্যাটার্জী আগে জয়েন করলেন, তারই পরপর আমি আর টুকুদা। একদিনে। ১৯৭৮, ৫ নভেম্বর। কত খুশি হয়েছিলেন মোহরদি। তারপর থেকে এখানেই। শান্তিনিকেতন ছাড়া আর কিছু ভাবিনি কখনও। অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে আর কই পারলাম শান্তিনিকেতনের জন্য যা করতে চাই… সেই পরিসর আর পেলাম না। কত ভালো ভালো ছাত্রছাত্রী পেয়েছি, ভাবতেই পারি না। মোট ১৪ জন গবেষণাও করেছে, একজনের বিষয় ছিল, ‘ব্লাড সার্কুলেশন ডিউরিং মিউজিক।’ সকলেই মনোযোগী, আগ্রহী, এবং অনেক খাটনি করতে পারে। এমন ছাত্রছাত্রীদের পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
একটাই জিনিস বুকে বড় বাজে। কত ছাত্রী যে এসে বলে, ‘গুরুজি, আমার বিয়ে, তাই সংগীত শিক্ষা থেকে, সংগীত চর্চা থেকে আমি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিরতি নিলাম।’ তারপর আর তারা গানে ফেরে না। অথচ, গানই ওদের চালিকাশক্তি। অনেকেই হয়তো এই বিরতি স্বেচ্ছায় নেয় না, নিতে বাধ্য হয়। অথচ, সংগীত আর সংসার তো পরস্পরবিরোধী নয়। বেছে নিতে হচ্ছে এখনও। ওরা ভালো থাক। আমাদের সমাজে আজও… যাক গে!
নীলিমা সেনের মতো শিল্পীকেও তো পেয়েছেন মাস্টারমশাই এবং সহকর্মী হিসেবে…
বাচ্চুদি (দীর্ঘশ্বাস)… বাচ্চুদি আমার নিজের দিদিই ছিলেন। ওঁর সঙ্গে গানের বাইরে, কাজের বাইরেও একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কত গেছি, কত থেকেছি, কত শিখেছি আমরা ওঁর কাছে। আরেকটা আশ্চর্য আকর্ষণ ছিল ওই বাড়ি যাওয়ার। এক বাঙাল ভদ্রমহিলা ওঁর বাড়িতে রান্না করতেন। কী সুস্বাদু একটা মাছের ঝোল রাঁধতেন, আজও ভুলতে পারিনি। বাঙালদের রান্না একটু বেশি ভালো। তুমি বাঙাল কি?
আপনার শাস্ত্রীয় সংগীতের যে গুরুরা, এবার তাদের কথা শুনব।
উস্তাদজি (ভি ভি ওয়াজলওয়ার), যোশীদা (ধ্রুবতারা যোশী), নিমাইদা আমায় হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন। বাজনাতেও মন দিতাম, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আমাদের বিভাগে। আমার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তো এইখানেই। ঘরানায় ক্লাসিফাই করা উচিত হবে না। যদিও আগরা ঘরানার অনেকটাই আমি পেয়েছি । আমিও তো শাস্ত্রীয় সংগীতই শেখালাম। জীবনের ধ্রুবতারাও মানি ওঁদের। ওঁদের আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়েছি, ওঁদেরই তালিম আমি নিজের মতো করে দিতে চেষ্টা করেছি নিজের ছাত্রছাত্রীদের।
আপনার শ্রোতারা অনেকেই আপনার বেড়ে ওঠার গল্প জানে না, কিন্তু জানতে চায়। আপনি ছোটবেলায় গানকে কেমন করে পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন কি?
নিশ্চয়ই। গানের বাড়িতেই তো বড় হলাম। তাই তো গানকে ভালোবাসলাম। মা পাঞ্জাবি লোকসংগীত গাইতেন। বাবা ছিলেন উস্তাদ কালে খাঁর সাগরেদ। একবার ব্যান্ড পার্টিকে জোর করে রাগরাগিণী শিখিয়েছিলেন (হেসে ওঠেন)। ছোট থেকেই গানকে আপন করে পেয়েছি, ঘরে যেমন পেয়েছি, বাইরেও পেয়েছি। গানকে আমি সবকিছুর মধ্যে পেয়েছি, নিজের মনের মধ্যে পেয়েছি। ওহ, মোহরদি যেই গানটা শেখাচ্ছিলেন, মনে পড়ে গেছে। ‘আমারও বাগানে এত ফুল।’ কী চেতনা সেই গানের! কী চেতনা!
চেতনা নিয়ে আপনাকে জিজ্ঞেস করব এক্ষুনি, তার আগে একটা প্রশ্ন করব আগের প্রশ্নের সূত্র ধরে। আপনি যেমন গানের বাড়িতে বড় হলেন, দুই পুত্রকেও তো গানের বাড়িতেই বড় করলেন। তালিম নিজেই দিলেন? দু’জনেই তো সংগীতজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র।
হ্যাঁ, তালিম প্রথমে আমি দিলাম। গানই ছিল আমার বড় ছেলে বিক্রমের সব। এমনি গান নয়, বুঝে গান। অনুভব করে গান। আমার কাছে শিখেছে, উলহাস কাশালকরের কাছে শিখেছে। ও আমার সঙ্গে অনুষ্ঠানে যেত। আমাকে নিয়ে যেত, যাতায়াত তো আমার কাছে একটা বাধা। আমার বড় ছেলের মতো তানপুরা কেউ বাধঁতে পারত না… যাক গে। আবির, আমার ছোট ছেলে। ওর সমস্ত মনোনিবেশ যন্ত্রের প্রতি। বাজনাকে ও নিজেরই অঙ্গ করে ফেলেছে, প্রথমে আমার কাছে গান শিখেছিল, ছোট ছিল। একটু বড় হওয়া ও অশেষদার ছাত্র। এখানে সকলের অধ্যাপক, সকলের উস্তাদ, অনেক বড় উস্তাদ। আমার পুত্রবধূ দূর্বাও সংগীতের মানুষ। সংগীতশিল্পী। গানের বাড়ি গানেরই বাড়ি আছে। তাই তো বাড়ির নাম ‘শাহানা’।
আচ্ছা, আজকাল যে শিল্পীদের শোনেন, শুনতে পান, কেমন লাগে তাদের গান? চেতনা থাকে সকলের গানে?
কেউ কেউ বড় ভালো গায়। কারও গানে চেতনা থাকে, কারও থাকে না। কেউ কেউ পারফর্ম করে। কেউ কেউ গান গায়। গানই গায়। খ্যাতির সঙ্গে চেতনার সম্পর্ক যে সব ক্ষেত্রেই থাকছে, তা তো নয়। তাতে আমার দুঃখ নেই, আমি আশাহত নই। অনেক শিল্পীর মধ্যেই চেতনার নির্যাস পাই, অনেক নবীনদের মধ্যে চেতনাবোধ পাই… মনে মনে ভাবি, তাদের শিক্ষার যেন সম্পূর্ণ হয়। সংগীতকে তারা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, সংগীত তাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে আরও দূরে।
আর্টফর্ম প্র্যাকটিস করতে গেলে তবে কি বলছেন, চেতনা বাদ দিলে বিপদ?
আর্টফর্ম প্র্যাকটিস করতে গেলে অনেক কিছু জয় করতে হবে। যেমন, ভয়। সুর, তাল, লয়, ভাষা, ভাষার অর্থ জয় করলে তবেই ভাব আসবে। ‘সাওয়ানকে বাদলো’ গানটা শুনেছ? সুর, তাল, লয়, ভাষা, ভাষার অর্থ, সবটাই আত্মস্থ না করতে পারলে সেই গানের ভাব ধরবে কেমন করে? যদি মনের মধ্যে ‘ভয়’ থাকে– এখানে সুর কম লাগতে পারে, কি ওখানে তাল কেটে যেতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবলে, সেই ভয়টাই গানে মূল হয়ে উঠবে, করুণাটি যাবে হারিয়ে। মন দিয়ে গাইতে চাইলে শিখতে হবে, যাতে ভয় তোমায় গ্রাস না করে। তালিম, রেওয়াজ, এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমি এখনও গাওয়ার আগে ছোটদের বলি সুর, তাল, মাত্রাজ্ঞান তৈরি করতে। চেষ্টা করি ওদের শেখানোর, যে গানে শব্দ আছে, তা যেন আগে বুঝে, অনায়াসে আবৃত্তি করতে পারে। তাতে জড়তা কাটে বলে আমি মনে করি। শিক্ষায় ফাঁক যেন না থাকে। তবে তো চেতনাবোধ আসবে।
আমাদের প্রজন্মে গান শেখায় কোনও ফাঁক থেকে যাচ্ছে বলে আপনার মনে হচ্ছে?
ইয়েস। আগেই যে বললাম, অনুভবের ফাঁক দেখি। অনুভব জোর করে আসে না। জোর করলে তা মেলোড্রামা হয়ে যায়। বাড়তি। শান্তিদা খুব অপছন্দ করতেন। মনে ভাব না থাকলে কী আর গলায় ভাব আসবে…
সাতই পৌষের উপাসনা, খ্রিস্টোৎসবের মন্দির বললে আমাদের অনেকের, অনাশ্রমিকদেরও আপনার কথা মনে আসে আগে…
(থামিয়ে দিয়ে) তাই? হ্যাঁ। ছয়ের দশক থেকেই তো সাতই পৌষ, খ্রিস্টোৎসবের মন্দিরে কত গেয়েছি। মাস্টারমশাই হওয়ার পরে অনুষ্ঠান পরিচালনাও করেছি। কত স্মৃতি। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশই ছিল এই সবটা, হেমন্ত আসতে না আসতে অপেক্ষা শুরু হত। আমি তো গান ছাড়িনি, নিয়মিত অনুষ্ঠানে গাইতে যেতে হয়, না গেলে শ্রোতারা অভিমান করবেন, আমার শ্রোতাদেরও আমি অন্তর থেকে ভালোবাসি, তাদের নিরাশ করব কেন? কিন্তু বিশ্বভারতী আমায় আর গাইতে(ও) তো বলে না। শেষ বোধহয় ২০১৯ সালে একটা ফোন পেয়ে গিয়েছিলাম বিশ্বভারতী থেকে, ‘বিমল আনন্দে জাগো’ গেয়েছিলাম। সেই একবারই। আর কখনও ওরা আমায় ডাকেনি। সে যাক।
বিশ্বভারতী আবার যদি ডাকে?
আর কী সেই পরিবেশ আছে? সর্বোপরি, আমার কি আর সেই মুড আছে?
উপাসনায় সংগীত পরিবেশনা নিয়ে কথা বলছিলাম। সেই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন না করলেই নয়। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? সংগীতে ঈশ্বরচেতনা?
দেখো, আমি বিশ্বাস করি সুরে ঈশ্বর আছেন। শুদ্ধস্বর। আর কোথাও নেই। কলরবে ঈশ্বর নেই, বিভাজনে ঈশ্বর নেই। যা শুদ্ধ, তাতেই আনন্দ, তাতেই ঈশ্বর।
এই প্রজন্মে আমরা যারা গান শিখছি, তাদের আপনি কী উপদেশ দেবেন?
তাড়া করো না, সাধনা করো। সাধনায় তাড়া চলে না। নো শর্টকাট টু সাকসেস। সাকসেস বলতে তুমি কী বুঝবে, তা যদিও তোমার ওপরেই নির্ভর করবে। রেওয়াজ করো, বাবা। ভালো গান হবে। হবেই। শোনার, রেওয়াজের কোনও বিকল্প নেই। বিকল্প খুঁজো না।
শেষ প্রশ্ন। আপনি দীর্ঘদিনের, সকলের প্রিয় শিল্পী এবং অধ্যাপক। আপনাকে শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী বলে একদল শ্রোতা, একদল আবার বলে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। কোনটা বললে আপনি বেশি খুশি হন?
সংগীত শিল্পী। জাস্ট টু ওয়ার্ডস। নো ক্যাটেগোরাইসেশন।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………