প্রথমে ফুলে ওঠে কুল, টসটসে হয় তারপর যত রোদ খায়, আস্তে আস্তে চুপসে আসে। এই কুল শুকানো হয় সংরক্ষণের জন্য, যা দিয়ে ‘সিরা’ হবে, সিরা– গুড় বা চিনি দিয়ে জ্বাল দেওয়া ঘন, গাঢ় এক খাদ্যবস্তু, যা আমরা বিকেল- সন্ধ্যায় বাটি বাটি করে খাই আর ‘এখানে’ যার পরিচয়– চাটনি। আমাদের অজ গাঁদেশে কোনও চাটনি নেই। আমাদের আছে ভর্তা। ভর্তা আমরা প্রথম পাতে খাই, মাঝপাতে খাই এবং শেষপাতে তো খাই-ই, ভর্তা খাই যখন তখন।
ভরা শীতে চারদিক যখন কুয়াশায় জলছবি, গাছে গাছে তখন ডাঁশা হয় কুল– আমরা যাকে ‘বড়ই’ বলি। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে লুঙ্গিকে চাদরের মতো করে গলায় একটা গিঁট বেঁধে নিয়ে পরে, তাতে একটা আলখাল্লার মতো দেখতে লাগে, শীত থেকে খানিকটা বাঁচে। সেই আলখাল্লা পরা ছেলেমেয়ের দল ভিড় জমায় নিজেদের বা পাড়ার কারও কুলগাছের তলায়। হিন্দুপাড়ায় সরস্বতী পাহারা দেন নানা আছিলায়। বাকি উঠোনে তখন বেরিয়ে এসেছে সব তক্তপোশ, তার উপর ঘরের সব কাঁথা, লেপ রোদের ওম নেয় আর বুড়োবুড়িরা সেই লেপকাঁথার উপর বসে রোদ পোয়ান হাতে ছড়ি নিয়ে। কুলগাছে একটা ঢিল পড়লেই ছড়ি উঁচিয়ে রে রে করে ওঠেন কিন্তু তক্তপোশে গরম লেপের ওম ছেড়ে নড়েন না। কচিদের দল সেসব শুনবে কেন! তারা খানিক এদিক-ওদিক যায়, অপেক্ষা করে, কখন বুড়োবুড়িরা একটু গা এলিয়ে দেবেন রোদে গরম হওয়া লেপকাঁথার উপর, ঝিমুনিতে যেই চোখ বুজবেন আর তক্ষুনি কচিকাচা সংঘ বিড়ালপায়ে ফিরে এসে আস্তে করে ঝাঁকি দেবে কুলগাছের নিচু ডাল ধরে। তাতে আলতো ঝাঁকি পড়ে গোটা গাছেই আর আধপাকা, ডাঁসা কুলেরা সব ঝরে টুপটাপ করে। এতক্ষণ যে গিঁটবাঁধা লুঙ্গি তাদের শীতবস্ত্র ছিল, সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে যায় ঝরে পড়া কুল রাখার কোঁচড়। দ্রুত পায়ে তারা কুল কুড়ায়, কোঁচোড় ভরে ওঠে টকমিষ্টি পাকা, আধপাকা, ডাঁসা সব কুলে। পাহারাদারের ঝিমুনি কাটতে কাটতে কুলচোরেরা যেমন চোরপায়ে এসেছিল, তেমনি করেই পালায়।
একটু বড়, যারা হয়তো স্কুলের শেষ ক্লাসে বা দশ মাইল দূরের কলেজে যায়, তারা একদিন ফিস্টি করে কুলের। দল বেঁধে তারা সেই সব বাড়িতে যায়, যাদের কুলগাছ আছে। এভাবে দল বেঁধে আসতে দেখলেই বাড়ির লোকে বুঝে যায়– আজ ফিস্টি হবে! বাড়ির মেয়েরা বেরিয়ে এসে যোগ দেয় দলে। গাছ ঝাঁকিয়ে কুল পাড়া হয় বাড়ি বাড়ি ঘুরে, বড় বড় গামলা সব ভরে ওঠে কুলে। এরপর অনুষঙ্গ। কারও ধনের খেতের ধনেগাছ, কারও খেতের কাঁচালঙ্কা, কারও গাছের আম্রমুকুল আর কারও বাড়ির নুন-মরিচ। বড় ঝাঁকায় করে কুল আর সমস্ত উপকরণ নিয়ে যায় সব পুকুরে। হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে গিঁট বেধে পুকুরে নামে কয়েকজন, ঝাঁকা ধরে ঝাঁকিয়ে ধোয়া হয় সব, পুকুর থেকে উঠে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে জল ঝরিয়ে এবার পালা ঢেঁকিতে ফেলে ভর্তা বানানোর। ঢেঁকিতে পাড় পড়ে, টক, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা আর আমের মুকুলের মিশ্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পাড়া জুড়ে। জনে জনে ভর্তা চেখে দেখে নুন-ঝাল ঠিক আছে কি না। এবার ভর্তা ওঠে বড় গামলায় আর একজন কাঁধে করে সেই গামলা নিয়ে এগোয় পাড়ার দিকে। প্রতি ঘর থেকে ছেলেবুড়ো বেরিয়ে এসেছে ছোট ছোট বাটি হাতে, ছেলের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে এক খাবলা করে ভর্তা ঢেলে বাড়িয়ে দেওয়া বাটিতে কেউ বা আবার আর একটু চেয়ে নেয়।
খেয়েথুয়ে গাছে যেটুকু কুল বাঁচে, সেসব একদিন সব পেড়ে শুকানো হয় উঠোনে চাটাই পেতে। টুকটুকে লাল হয় কুল রোদ পেয়ে। প্রথমে ফুলে ওঠে কুল, টসটসে হয় তারপর যত রোদ খায়, আস্তে আস্তে চুপসে আসে। এই কুল শুকানো হয় সংরক্ষণের জন্য, যা দিয়ে ‘সিরা’ হবে, সিরা– গুড় বা চিনি দিয়ে জ্বাল দেওয়া ঘন, গাঢ় এক খাদ্যবস্তু, যা আমরা বিকেল- সন্ধ্যায় বাটি বাটি করে খাই আর ‘এখানে’ যার পরিচয়– চাটনি।
আমাদের অজ গাঁদেশে কোনও চাটনি নেই। আমাদের আছে ভর্তা। ভর্তা আমরা প্রথম পাতে খাই, মাঝপাতে খাই এবং শেষপাতে তো খাই-ই, ভর্তা খাই যখন তখন। সকালে-দুপুরে-বিকেলে, এমনকী, রাতেও। ভাতের সঙ্গে ভর্তা, ভাত ছাড়া ভর্তা। ভর্তা এমনকী, রুটির সঙ্গে এবং পিঠার সঙ্গেও। ভর্তা দিয়ে আমরা পিঠে বানাই, ভর্তা দিয়ে মেখে খাই ভাপা এবং চিতই পিঠা। এখন শীতকাল বলে কুলের কথাটাই আগে মনে পড়ল। কুলের ভর্তা, আম, জাম, পেয়ারা, ডেওয়া, টম্যাটো, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, শুকনো লঙ্কা, লেবইর এবং যাবতীয় সবজির খোসা এবং শাঁসের ভর্তা। এবং শুঁটকির ভর্তা। চাটনি তো বিদেশি। ইউরোপীয়ান বণিকেরা মাসের পর মাস জাহাজে করে যে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে জাহাজে চাপতেন, হরেক শুঁটকি, স্বাদ ফেরানোর নিমপাতা গুঁড়ো আর হরেকরকম্বা আচার। সে সময়ের লেখা নানা কুকবুকে এদেরই ভিড়। এরা এলেন চাটনি অবতারে। তবে আমাদের গ্রাম বাংলায় যেসব অঞ্চলে উপনিবেশের জাহাজ এসে ভেড়েনি তারা অবশ্য মরশুমি তেঁতুল, মেস্টা, কতবেলের ভর্তায় মনের সুখে আত্মনিবেদন করে প্রজন্মের পরে প্রজন্ম কাটিয়ে যেতে লাগল।
…………………………………………
কুলের যে সিরা আমরা খাই, তাতে একটু রস রাখা হয়, সেই রস অমৃতসম। গাঢ় মিষ্টি রসবতী সব কুল যখন শেষ হয়ে যায়, তখন আঙুলে করে চেটে চেটে আমরা খাই সিরার রস। এই সিরা-কে চাটনি রূপে বানানো হয় রস শুকিয়ে দিয়ে, পরিবেশন করা হয় মাংসের ভুনা খিচুড়ি, পোলাওয়ের সঙ্গে। কেবল যে কুলের সিরা হয় তা ভাবলে আমাদের বৈচিত্রকে খাটো করা হবে।
…………………………………………
কুলের যে সিরা আমরা খাই, তাতে একটু রস রাখা হয়, সেই রস অমৃতসম। গাঢ় মিষ্টি রসবতী সব কুল যখন শেষ হয়ে যায়, তখন আঙুলে করে চেটে চেটে আমরা খাই সিরার রস। এই সিরা-কে চাটনি রূপে বানানো হয় রস শুকিয়ে দিয়ে, পরিবেশন করা হয় মাংসের ভুনা খিচুড়ি, পোলাওয়ের সঙ্গে। কেবল যে কুলের সিরা হয় তা ভাবলে আমাদের বৈচিত্রকে খাটো করা হবে। তবে বানানোর তরিকা সব আলাদা। স্থান মাহাত্ম্য কিছুটা। বর্ষায় সিলেটের উঁচু-নিচু টিলার ঢালে আনারসের বাগান যখন উপচে পড়ে ছোট ছোট দেখতে রসে টইটুম্বুর মিষ্টি আনারসে, যার নাম– জলডুগ, সিরা হয় সেই আনারসের। পাকা মিষ্টি আনারস কাটা হয় ছোট ছোট টুকরোয়, জ্বাল দেওয়া হয় এন্তার চিনি দিয়ে, তৈরি হয় সোনালি রঙের তরল অমৃতের ধারা, যার মধ্যে ভাসে খণ্ড খণ্ড আনারস– আনারসের সিরা। পাতলা সিরা খাওয়া হয় বাটি করে আর জ্বাল দিয়ে দিয়ে গাড় রসের যে সিরা তৈরি হয়, তাকে আপনারা বলেন– চাটনি। তারাপদ রায়ের আনারসের চাটনি হবে নাকি হবে না-র দ্বিধা আমাদের নেই। কাচের বোয়াম ধুয়ে মুছে, রোদে শুকিয়ে তাতে রাখা হয় আনারসের সিরা, খাওয়া হয় পোলাও-মাংস, বিরিয়ানি, তেহ্রির সঙ্গে।
এভাবেই সিরা হয় করমচা, লেবইরের। দুটোই অত্যন্ত টক ফল, এমনি খেতে গেলে মাথার চুল পড়ে যায় সে এত টক। এই অতীব টক ফলেরও রেহাই নেই পাড়ার ছেলেপুলেদের হাত থেকে। তারা লেবইর, করমচার ভর্তা বানিয়ে খায় যেমনটি হয় কুল– বড়ইয়ের ভর্তা। ভর্তার পিকনিক যে কেবল শীতকালীন অধিবেশন তেমনটা নয়। বাংলার বেশুমার টক ফলের যত্ন আমরা নিজ হাতে করে থাকি বছরভর। ঋতুবৈচিত্রের মতো টকের সমস্ত বৈচিত্রে আমরা নিবেদিত চিত্ত। এসব পিকনিকে আমাদের কাছাকাছি আসা ও সুখ-দুঃখ বিনিময়ের জানালা । অম্লমধুর গুঞ্জনে টকস্য টক ফলের নানা অবতারের মধ্যে আমরা জীবন নির্বাপিত করি। কোন গাছের আম পাকতে দেওয়া হবে আর কে সবুজ অবতারেই নিকেশ হবে সেইসব জ্ঞান আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। আমাদের বাড়িঘরের পাশে চালতা, আমড়া, বিলম্বু, জলপাই, কামরাঙ্গার নতুন গাছ উঠলে যত্নআত্তি করি সাধ্যমতো। এসব ফল কাঁচা ও পাকা অবস্থায় খাই আমরা, বেশি পাকলে পাখিরা ভিড় করে আসে আমাদের উঠোনে। আমরা সিরা দিই এইসব অতি টক ফলের। সিরা তৈরি করি বা বানাই কথাটাকে আমরা বলি– সিরা দেওয়া, ‘সিরা দিই’। এইসব সিরাও হয় সোনালি রঙের, চিনির গাঢ় রসে ভাসা টুপটুপে মিষ্টি। লেবইর, করমচা বা এই ধরনের টক ফলের মিষ্টি সিরা খাওয়া হয় অবশ্য পোলাও, বিরিয়ানির সঙ্গে মেখে।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………