আরসালানের বিরিয়ানি আর ডমিনোর পিৎসার মতো কবে যেন খুন জখম আর হাইলাইট করা চুলের বউদিরা এসে বেদখল করে দিল জননী, জন্মভূমি, মাসিমা, পিসিমা, বড় বউ, ছোট বউ, জাতীয় সমস্ত ঘরোয়া বিষয়কে। কোথাও ‘ঘরোয়া’ কিছু নেই।
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
কিলার সিরিয়ালকুল তখনও আসেনি। কথায় কথায় পিস্তল তাক করা, সুপারি কিলার লেলিয়ে দেওয়া লেলিহান অগ্নিশিখা গাউন পরিহিতা, বেবাক ফলস আইল্যাশ পরা ননদের দল তখনও পৃথিবীতে বেমিল। কারণ তখনও জীবন ‘ঘরোয়া’, বাঙালিও বিশ্বায়িত না। মনমোহন সিংহ, উদারীকরণ, বে ওয়াচ, বাহাত্তর চ্যানেল তখনও হালকা পায়ে ঢুকছে। পুরোটা অধিগ্রহণ করে ফেলেনি। তখনও ‘ল্যকমে’ ও ‘নিভিয়া’ শব্দগুলো গুটিগুটি আসছে, আর ২০ বছর পরের ‘সিচুয়েশনশিপ’ বা ‘লিভ-ইন’ টাইপ শব্দগুলোর মতোই, জলভাত হয়নি। কালার প্যালেটের সঙ্গে মিলিয়ে স্কিনটোনের শেডকার্ড আসারও আগে, আমাদের নোংরা নোংরা পাড়ায়, সরু সরু গলিতে মুখোমুখি তেলচিটে কালি-ভুষো তারজালি লাগানো ছোট জানালাওয়ালা রান্নাঘরে সন্ধেবেলাও মাছের ঝোল রান্না হত। কাঁচা নর্দমার দুর্গন্ধের সঙ্গে মাতালের হাতের জুইঁমালা নয়, গেরস্থ পাড়ায় ছ্যাঁক ছোঁক ফোড়নের গন্ধই মদির করে রাখত স্যাঁতলা পড়া নিবিড় অন্ধকারকে…। আর তার সঙ্গে সঙ্গে বিনবিনিয়ে মশার গান আর ‘জন্মভূমি’ সিরিয়ালের গান বেজে ওঠা, প্রায় একই ডেসিবেলে। সুদূর কোন পথের শেষে একটি বাড়ির একটি টিভি থেকেই আসত বলে বোধহয়, ভলিউম কম। ‘খাসখবর’-এর মৌতাত সবে জমে উঠেছে, কিন্তু তারও ভলিউম কম। ব্রেকিং নিউজ-এর চিল চিৎকার আর উঁচু তারে বাঁধা কণ্ঠে, হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথা বলা নিউজ অ্যাঙ্কররা তখনও বেমিল।
টিভি দূরে দূরে, প্রতি ঘরে যেহেতু নেই, তাই পাড়া ভেঙে পড়ত ওই এক এক ঘরেই। ঝুপুস হয়ে শাড়ি ছড়িয়ে বসত পাড়ার বিবিধ বউ-ঝিরা, বসত অজস্র ক্যালর ব্যালর বাচ্চাকাচ্চা। ছন্দা সেনের খবর পড়া আর চৈতালী দাশগুপ্ত, শাশ্বতী গুহঠাকুরতার অ্যাঙ্করিং পুরনো হয়ে এলেও দিনগত অভ্যেসের মতো তখনও দূরদর্শনই ‘বঙ্গজীবনের অঙ্গ’ হয়ে বোরোলিন ল্যাপটানি লেপ্টে আছে। পঙ্কজ সাহার পয়লা বৈশাখ ‘গ্যাদারেশন’ নব্য সেলিব্রিটিমুখর ও ভীষণ বাঙালি। রাবীন্দ্রিকও। তার ঠিক পরে পরেই এসেছিল এইসব সিরিয়াল কিলার। জননী জন্মভূমিশ্চ।
জন্মভূমি-তে মিতা চ্যাটার্জির পিসিমা দিয়ে ‘হিট অ্যান্ড রান’ শুরু। কেস জমে ক্ষীর! ‘রেনবো প্রোডাকশন’-এর হাত ধরে, ‘সময়ের সমুদ্রে মিশে যায়, ইট কাঠ পাথরের পাঁজরে ইতিহাস ফিসফিস কথা কয়, দিন বদলায়, রং বদলায়, মন তবু খোঁজে জন্মভূমি। জন্মভূমি জন্মভূমি’ রোজ, প্রতি কর্মদিবসান্তের মুড়ি-তেল-বাদাম খাওয়া আপিস ফেরতা জনগণের দিনগত পাপক্ষয়।
১৯৯৭ থেকে দু’হাজার– এই সময়কাল জুড়ে ইন্দর সেনের পরিচালনায় রূপা গাঙ্গুলি থেকে আরও অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীতে জমজমাট এই সিরিয়াল ছিল প্রকৃতই ‘ঘরোয়া’।
‘ঘরোয়া’ শব্দের অভিঘাত আমরা আশাপূর্ণা দেবীর গল্প থেকে জেনেছিলাম। তারপর এসেছিল আশির মাঝামাঝি থেকে ‘ছোট বউ’, ‘বড় বউ’, ‘মেজ বউ’ সিরিজের ছায়াছবি। অঞ্জন চৌধুরীর সাফল্য বাহান্ন সপ্তাহের সিরিয়াল অবধি বয়ে এল।
তখন কবিতাতেও কেমন যেন ঘরের বাতাস জড়িয়ে থাকত। চৈতালী চট্টোপাধ্যায় ‘নলীন সরকার স্ট্রিট’ কবিতায় লিখতেন,
সম্ভাবনার মেঘ বিকেল হলেই উড়ে আসে
তুমি ঘরে ঢুকে জুতো মোজা– খোলো। ডাকো,
‘কী ব্যাপার, ফোন দাওনি আজ?’
বৃষ্টি আসন্নপ্রায়, তার আগেই
রামলাল মিষ্টান্নভাণ্ডার থেকে আমি
ক্ষীরের চপ ও কিছু দানাদার
বুদ্ধি করে আনিয়ে রেখেছি।
খুকুদি সাবান কাচছে,
সন্ধের শাঁখ বাজছে সবে,
এ-সময় ঘেন্নাপিত্তিগুলি খেয়াল পড়ে না–
কে-কাকে মিস্ট্রেস ভাবল, তা -ও!
সমস্ত শরীর থমথমে।…’
কিন্তু তার দশ বছরের মধ্যেই বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে গেল ঘরোয়া যাপন।
আমরাও অনেক বেশি বেশি করে সিরিয়ালের মতো হয়ে উঠলাম।
২০০৫। রাঁচির ফাঁকা ফাঁকা একটি পাড়ায়, গাছপালা ঘেরা নিরিবিলি কলোনির ভেতরে আমরা তখন থাকি। সন্ধে হলেই চরাচর ঢেকে যায় অন্ধকারে, বাংলোর চারিপাশে ছোট বাগান ও লন ভরে ওঠে কুয়াশাচ্ছন্নতায়। ঘরের মধ্যে আমরা পরিবারের শুধুমাত্র মহিলা সদস্য– শাশুড়িমা, আমি, মেয়ে ও কাজের মেয়েটি, দরজা-জানালা এঁটে বসে থাকি টিভি চালিয়ে। সন্ধ্যা নামার পর কোনও ক্রিয়াকর্ম নেই। বাজার-হাট যাওয়া হয় না। সিনেমা-থিয়েটারও নেই। সুতরাং পালানোর পথ টিভি। আমার মনে আছে, সন্ধেবেলা রোজ নিয়ম করে ‘রোজগেরে গিন্নি’ আর ‘এক আকাশের নীচে’ দেখা হত। জি বাংলা আর ইটিভি– দুটোই পাওয়া যেত আমাদের কেবল-এ। সে সময়ে, ‘এক আকাশের নীচে’ থেকে শুরু করে আরও অনেক টিভি সিরিয়ালের ভেতরে অনেক অনেক নারীচরিত্রের লড়াই-আবেগ-সক্ষমতা-অক্ষমতার মিডিয়াচর্চিত নতুন ট্রেন্ড দেখছিলাম, সচেতনে বুঝে নিতে চাইছিলাম আমার পরিপার্শ্বের মেয়েদের কথা। দেবলীনা, কনীনিকা, সমতা, চৈতি ঘোষালদের মুখ দিয়ে যাদের আঁকা হয়, সেই সব বিবাহিতা, ডিজাইনার তাঁতের শাড়ি পরিহিতা, জীবনের নানা ঝড়ঝঞ্ঝায় বিক্ষুব্ধ, অতি বাস্তব কিন্তু অবাস্তব স্টিরিওটাইপ সব মহিলাচরিত্রের ভিড়ে, টিভি-নারীদের ভিড়ে আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম একটা চেনা প্যাটার্ন। জীবনের সাফল্য আর অসাফল্যর নিরিখগুলো যারা দ্রুত পালটে যাচ্ছে। যারা বেশি বেশি করে আত্মকেন্দ্রিক ও আত্মসচেতন। স্বামী বা সন্তানকে বাদ দিয়েও যাদের কামনার বস্তু হয়ে উঠছে অন্য অনেক কিছু। আর সমাজ তাদের সেই অনুমোদনও কোথায় যেন দিয়ে দিচ্ছে, নিজের জন্য বাঁচো, নিজেকে সুখ দাও, নিজের মতো করে আনন্দ পাও। আবার, চেহারা বা ফ্যাশনেও যারা ক্রমশ একই ছাঁচের হয়ে উঠতে চাইছে। একই রকম জামাকাপড় পরতে চাইছে, একই রকম করে চুল কাটতে চাইছে। একই রকম করে চুলে ক্লিপ আটকাচ্ছে।
……………………..
হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম, আমি নিজে যে রকম চুলের ক্লিপ আগে লাগাতাম সেইরকম আর লাগাচ্ছি না। আমার চুলে উঠে এসেছে পুরনো ধাঁচের ক্লিপের বদলে বাজারে নতুন বেরনো এমন একটা ক্লাচ– দাঁতনখ বের করা, কাঁটা কাঁটা একরকমের ক্লিপ, যা ছোট করে কাটা চুলের অবাধ্য গোছাকে যে কোনও মুহূর্তে হাত দিয়ে মুচড়ে পিছনে নিয়ে গিয়ে গুটিয়ে একটা খোঁপার মতো করে তাতে লাগিয়ে ফেলা যায় মুহূর্তের মধ্যে, আয়না-চিরুনি কিছুই লাগে না। এই যে চটজলদি সমাধানের মতো জীবনের গতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টানো চুল-ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাটি– এটা কোথায় থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল আমাদের মেয়েজীবনে।
……………………..
হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম, আমি নিজে যেরকম চুলের ক্লিপ আগে লাগাতাম, সেইরকম আর লাগাচ্ছি না। আমার চুলে উঠে এসেছে পুরনো ধাঁচের ক্লিপের বদলে বাজারে নতুন বেরনো এমন একটা ক্লাচ– দাঁতনখ বের করা, কাঁটা কাঁটা একরকমের ক্লিপ, যা ছোট করে কাটা চুলের অবাধ্য গোছাকে যে কোনও মুহূর্তে হাত দিয়ে মুচড়ে পিছনে নিয়ে গিয়ে গুটিয়ে একটা খোঁপার মতো করে তাতে লাগিয়ে ফেলা যায় মুহূর্তের মধ্যে, আয়না-চিরুনি কিছুই লাগে না। এই যে চটজলদি সমাধানের মতো জীবনের গতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টানো চুল-ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাটি– এটা কোথায় থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল আমাদের মেয়েজীবনে। আমাদের চাকরি, পরিবার, স্বামী সন্তান ম্যানেজ করার সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে চুল ম্যানেজ করার সমস্যাও তো একটা ব্যাপার। সেই একটা অন্তত সমস্যা খুব সহজেই সমাধান করে দিচ্ছিল ওই উঁচু চূড়ো করে চুল বাঁধার ক্লিপ বা ক্লাচ। যা বাঁধতে গেলে প্রথমত চুলটাকে ঘাড় অবধি হতে হয়, বেশ খানিকটা ছোট, আর চুলে শ্যাম্পু করাও বাধ্যতামূলক।
তো নিজের কিছু কিছু অভ্যাস এইভাবে পাল্টাতে দেখেছি ঈষৎ অন্যমনস্কভাবেই। হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম– ওইসব সিরিয়ালের নায়িকাও একই রকম ক্লাচ ব্যবহার করে। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হল যেন আমার! তারপর দেখি, হিন্দি ছবির নতুন নতুন হিরোইন, সেই সময়ের প্রীতি জিন্টা বা মল্লিকা শেরাওয়াতরাও ওই রকম ক্লাচ দিয়ে চুল বাঁধে। শেষ পেরেক আমার কফিনে পড়ল, যখন দেখলাম ‘স্টার মুভিজ’-এর কোন এক হলিউডি ছবিতে অ্যাঞ্জেলিনা জোলিও কথা বলতে বলতে নিজের লঘু বাদামি-সোনালি চুলের গুচ্ছ হাত দিয়ে পিছনে মুড়িয়ে ঠিক সেই ভঙ্গিতেই ক্লাচ আটকাল, যেমনটা ইদানীং আমি করি।
কেঁপে গেলাম! স্তম্ভিত হয়ে বুঝতে পারলাম, আমার প্রতিটি জেশ্চার, শরীরের প্রতিটি ভঙ্গিমা, প্রতিটি অভ্যাস আসলে কোনও না কোনও সূত্র থেকে কপি করা। সিনেমা, সিরিয়াল থেকে কপি করা।
কে বেশি করে কার নকল, আমি আর আজ জানি না। ইতিমধ্যেই তো, ঝড় বইতে শুরু করল উন্নয়নের। ৩৪ বছর হঠাৎ ফুস করে নিভে গিয়ে নতুন দিন এল। সময়ের পদপাত পাড়ার ক্লাব ঘর থেকে দুমদাম করে শোনা যেতে লাগল। উৎসবমুখর হল বাঙালি। লিট্টি উৎসব থেকে পৌষ পার্বণ। অন্যদিকে রাস্তা বন্ধ করে এক মাসের দুর্গোৎসব।
অজস্র বাংলা চ্যানেলে অজস্র সিরিয়াল এল, তার বিজ্ঞাপনের বড় বড় কাট আউটে চোখ রাখলে মনে হয়, সব সিরিয়ালই কেমন খুব ‘নারীকেন্দ্রিক’ হয়ে উঠল। অন্যদিকে নারী উৎপীড়নও লাফ দিয়ে বাড়ল।
আর ওটিটি তো এই সেদিনের গল্প!
এখন একটি করে নির্ভয়াকেস হয় আর একটি করে ওটিটি সিরিজ তৈরি হয়। কোথাও ‘ঘরোয়া’ কিছু নেই। আজকাল আবার সবই নাকি খুব ‘পলিটিক্যাল’। ব্যোমকেশের গল্প ওটিটিতে দেওয়ার সময় তাতেও সমসাময়িক পলিটিক্সের ওপর টিপ্পনি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তার ওপর আবার একটু সাবলটার্ন সিরিজ হলে তো কথাই নেই। সেখানে গালাগালির যে বন্যাটা বয়, তাতে ভাষার ডিকনস্ট্রাকশন হয়ে বটে তবে সেটাকে আর ‘ঘরোয়া’ বলে কোনওমতেই দাবি করা যায় না।
আহা, বড় মিস করি সেইসব মাছের ঝোলের ছ্যাঁকছ্যাকাঁনি দিন। আরসালানের বিরিয়ানি আর ডমিনোর পিৎজার মতো কবে যেন খুন জখম আর হাইলাইট করা চুলের বউদিরা এসে বেদখল করে দিল জননী, জন্মভূমি, মাসিমা, পিসিমা, বড় বউ, ছোট বউ, জাতীয় সমস্ত ঘরোয়া বিষয়কে।
১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।