জীবনে সবারই একটা না একটা সময় আসে, যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয় মাথা তুলে। যা হয় হোক, মার ডুব। ঋতুদাকে কোনওমতে বললাম, আমি করব কাজটা, চন্দ্রিলকে ফোন করছি। ঋতুদার জানার কথা নয়, ঠিক কোন অবস্থানে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিন। কিন্তু চাকরির প্রস্তাবটা খুব সাহায্য করেছিল স্বপ্নের জানলাগুলো খুলতে।
৬.
চাকরির অফারটায় মাথার ভেতর ছায়াপথ ঢুকে গেল। জীবন চলছিল একভাবে, সরকারি-বেসরকারি রাস্তা খুঁড়ে, পয়সার দরকার খুব, ছন্নছাড়া বেহাল একটা উজবুক-যৌবন– জানি না কী গতি হবে বানানো গানগুলোর, কেউ আদৌ শুনবে কি না ওসব ছাইপাঁশ, এই তুমুল মধ্যবিত্ততার বাইরে বাঁচতে পারব কি কখনও, এই ম্যাদামারা বেঁচে থাকার বাইরে একবার… একবার যদি উঠে দাঁড়াতে পারতাম– ঋতুদার ফোনটা কোথাও যেন একটা জানলা খুলে দিল। জীবনে সবারই একটা না একটা সময় আসে, যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয় মাথা তুলে। যা হয় হোক, মার ডুব। ঋতুদাকে কোনওমতে বললাম, আমি করব কাজটা, চন্দ্রিলকে ফোন করছি। ঋতুদার জানার কথা নয়, ঠিক কোন অবস্থানে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিন। কিন্তু চাকরির প্রস্তাবটা খুব সাহায্য করেছিল স্বপ্নের জানলাগুলো খুলতে।
চন্দ্রিল প্রথমে নিমরাজি ছিল, পরে রাজি হয়ে গেল আমি জয়েন করছি শুনে। ২ নং ক্যামাক স্ট্রিটে ‘তারা বাংলা’র অফিস। আমাদের একই দিনে ইন্টারভিউ হল। বোর্ডে ছিলেন, সিইও বুদ্ধদেব গুহ, ভাইস প্রেসিডেন্ট অমিত চক্রবর্তী, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর অভিজিৎ দাশগুপ্ত আর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ঋতুপর্ণ ঘোষ। ক্যামাক স্ট্রিটের গাড়িবারান্দাওলা বাড়িটায় বড় একটা পার্কিং লট ছিল। চোখে পড়েছিল চার প্রধান মুখের গাড়ি পাশাপাশি পার্ক করা। তিনটে ফোর্ড আইকন, আর একটা হুন্ডাই অ্যাকসেন্ট। কানাঘুষো শুনলাম, সবাই নাকি তারা-য় চাকরি পেয়েই নতুন নতুন গাড়ি কিনেছে! কলকাতার বাজারে তখন সদ্য এসেছে মার্কিনি ফোর্ড কোম্পানি। ঋতুদা অবশ্য অ্যাকসেন্ট কিনেছিল। তারার অফিসে আলাপ হল রেশমি, কৌস্তুভী, অয়ন, দেবিকার সঙ্গে। ওরা একেবারে শুরু থেকেই ছিল। এত নতুন মুখের ভিড়ে মনে হল, একটা দুরন্ত কিছু হতে চলেছে চ্যানেলটা। আমাদের একটা গালভরা পোস্ট ছিল– ইন হাউস ডিরেক্টর। যাদের কাজ নতুন প্রোগ্রাম তৈরি করা। ‘তারা করছেটা কী’ যেমন চলার তেমনই চলবে, কিন্তু আরও নতুন প্রোগ্রামের আইডিয়া ভাবতে হবে। ফলে সকাল থেকে সন্ধে ঋতুদার বাড়ি আমরা মিটিং করতে শুরু করলাম। সেই প্রথম টের পেলাম, ঋতুদার ঠান্ডাপ্রীতি। এসিটা এমন কনকনে করে রাখত, টানা মিটিং করা দুঃসহ ছিল। ফলে সবার জন্যই গায়ের চাদরের বন্দোবস্ত ছিল। যে কোনও মিটিং যেমন হয়, কাজের কথা খানিক, বাকিটা হাবিজাবি। আনকোরা একটা দল, উৎসাহে টগবগ করছে, কিছু একটা ঘটিয়েই ছাড়বে সবাই। চন্দ্রিল একদিন ঋতুদাকে বলল, ‘তুমি আর সিনেমা করবে না?’
–কেন করব না?
–তাহলে তারায় জয়েন করলে যে?
–এত টাকা দিচ্ছে, জয়েন করে ফেললাম।
ঘরে সেসময় আমি আর চন্দ্রিল। দু’জনের চোখেই জিজ্ঞাসা, ‘কত দিচ্ছে?’
–তিন লাখ।
টাকার অঙ্কটা শুনে সেই যে আমাদের মুখ এমন হাঁ হল, চিকেন রোল খাওয়ার আগে আর বন্ধই হল না। কাগজের অফিসে কাজ করার সুবাদে জানতাম, বেশি মাইনে মানে পাঁচ অঙ্কের। ‘যুগান্তর’-এ আমার বস দীপঙ্কর চক্রবর্তী ১০ হাজার টাকা পেতেন, সেটাই বিরাট ব্যাপার ছিল। সেখানে তারা বাংলায় আমার বস পায় তিন লাখ! আগের শতকে এই আশ্চর্য অঙ্কটা ছিল রূপকথার মতো। এত টাকা ঋতুদার দরকারই বা কী– এই আলোচনা করতে করতে আমি আর চন্দ্রিল সস্তার বাস ধরে বাড়ি ফিরে এলাম।
তারা-তে প্রোডাকশন এগজিকিউটিভ হিসেবে যোগ দিল মেহেলিও। ফলে দারুণ একটা টিম তৈরি হয়ে গেল অফিসে। একসঙ্গে খেতে যাওয়া, পার্ক স্ট্রিটে অলি পাব, মোকাম্বো– যে টাকা আমরা হাতে পেতাম, বাজে খরচের জন্য অনেকটাই থাকত। ফলে একটু একটু করে কলকাতার সাহেবিয়ানা শিখছিলাম। তারা বাংলা আসার সময়টায় খুব ইন্টারেস্টিং। সেই সময় থেকে ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ফোন, বিদেশি ব্যাঙ্ক– এসবের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়। আমাদের স্যালারি অ্যাকাউন্ট ছিল এইচএসবিসি, সেই প্রথম আমার এটিএম কার্ড হাতে পাওয়া। প্রথম উইথড্রয়াল-এ নার্ভাস হয়ে এমন উল্টোপাল্টা করলাম, কার্ডটা গিলে নিল মেশিন।
নতুন ধরনের এক জীবনধারা তখন আসছে কলকাতায়। অফিস থেকে মিউজিক ওয়ার্ল্ড হাঁটাপথ। হেডফোনে, যতক্ষণ খুশি, ইচ্ছেমতো গান শোনা যায়। মাঝে মাঝে অফিস থেকে কেটে পড়ি ব্যান্ডের রিহার্সালে। মেহেলি একদিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কীসের রিহার্সাল?’,
–গানের। আমাদের একটা ব্যান্ড আছে।
–ও, তুই গানও গাস?
কী বলব ভেবে পেলাম না। সেসময় দু’-দুটো অ্যালবাম বেরিয়ে গিয়েছে চন্দ্রবিন্দু-র।
নতুন অনুষ্ঠান প্ল্যানিংয়ের আগে ঋতুদা আমাদের নিয়ে নানা জায়গা দৌড়তে শুরু করল। আমি আর চন্দ্রিল মেট্রো সিনেমার কাছে অপেক্ষা করতাম। সকাল ন’টা থেকে চরকিপাক খাওয়া হত বিভিন্ন লোকের অফিস কিংবা বাড়িতে। তারা-র অডিয়েন্স সার্ভে করছিল যারা, সেই শিলুদার অফিসে গেলাম। দিলখোলা মানুষটাকে সেই প্রথম দেখলাম। সেই অফিসেই আলাপ হল মধুমিতাদির সঙ্গে। পরে ‘আনন্দবাজার’ ব্র্যান্ডে, তারও পরে ‘সানন্দা’র সম্পাদিকা হবেন তিনি। কোনও দিন বিবি রায়, তো কোনও দিন সোহাগ সেন– এই চলছিল। একদিন ঋতুদা বলল, ‘ভদ্র জামাকাপড় পরে আসিস।’
–কেন?
–মুনদির বাড়ি যাব কাল?
–মুনদি?
–উফ্ফ, মুনমুন সেন! ‘অ্যাগনি আন্ট’ প্রোগ্রামটা ও-ই তো হোস্ট করবে!
মুনমুন সেনের প্রভাব আমাদের যৌবনে এতটাই ছিল, হঠাৎ করে নামটা শুনেই ছ্যাঁকা খেলাম।