আমাদের বাড়ির পুজো বেশ আলাদা। আমার কাছে দুর্গাপুজো মানে, মহালয়ার পর বাড়ির চৌকাঠই শেষ সীমানা। যখন জানলাম যে, সবার বাড়িতে পুজো হয় না, তখনই শিখলাম বারোয়ারি পুজোর কথা। তবে সেখানেও একটু ফারাক আছে। বাড়ির পুজোর হালহকিকত জানাচ্ছেন অরিঞ্জয় বোস।
ঠাকুরদালান-এর গল্প বলতে গিয়ে প্রথমেই ‘জলসা’র কথা মনে এল। না, পুজোর মরশুমে গান-বাজনার জলসার কথা বলছি না। এ হল অমিতাভ বচ্চনের বাড়ি ‘জলসা’। কলকাতা শহরের প্রায় শ-দুয়েক বছরের পুরনো পুজোর গল্প শোনাতে আপনাদের যখন ঠাকুরদালানে ডেকে এনেছি, তখন হঠাৎ আরবসাগরের তীরের ঢেউ লাগল কেন! আসলে, অভিষেক বচ্চনের বলা একটা গল্পের সঙ্গে আমার পুজোর দিনের অনুভূতির বেশ বড়সড় মিল খুঁজে পেয়েছি। আমরা সবাই জানি, প্রতি রবিবার করে বিগ বি-র বাড়ির সামনে ভিড় জমান তাঁর ভক্তরা। বহুদিন হতে চলল, এ রীতির ধারাবাহিকতা আজও অটুট। তো, জুনিয়র বচ্চন ভাবতেন, সবার বাড়ির সামনেই বোধহয় উইক-এন্ডে এরকম ভিড় হয়। একদিন কোনও কারণে তিনি এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছেন। যথারীতি ক্যালেন্ডারের নিয়ম মেনে এসেছে রবিবার, কিন্তু বন্ধুটির বাড়ির সামনে ভিড়ের চিহ্নমাত্র নেই। কমবয়সি অভিষেক ভারি অবাক হয়েছিলেন সেই ঘটনায়! ভাবছিলেন, এত মানুষ- যাঁরা তাঁদের বাড়ির সামনে আসেন, তাঁরা আজ গেলেন কোথায়! কেনই বা তাঁর বন্ধুর বাড়ির সামনে একই রকম ভিড় জমছে না! যখন বড় হলেন, তখন বুঝলেন অমিতাভ বচ্চন নামের মহিমা! বুঝলেন, কেন শুধু ‘জলসা’তেই হয় জনসমাগম! আমারও দশা হয়েছিল ঠিক ওঁর মতোই। যখন প্রথম শুনলাম, সব বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় না, মনে মনে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মুখে বলিনি কাউকে, কিন্তু, নিজের কাছেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলাম যে, এমনটা আবার হয় নাকি? হয় যে, সে তো একটু বড় হয়ে তবে বুঝলাম।
সত্যি বলতে, বাঙালির পুজো তার ডিএনএ-তে। ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা পরম্পরা ইত্যাদি নানা ভাবেই এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে, আমার মনে হয়, বাঙালির সঙ্গে পুজোর যে যোগসূত্র, তার আসলে কোনও ব্যাখ্যাই মেলে না। বাঙালি আছে বলেই ঝলমলিয়ে আছে তার পুজোর দিনকাল, আবার পুজোর দিনকাল আছে বলেই যেন অস্তিত্বের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পায় বাঙালি। সেই পুজো যখন বাড়ির হয়, অর্থাৎ, যে-বাড়ি আসলে পুজোবাড়ি, তবে তাতে জুড়ে গেল অন্য মাত্রা। আর পাঁচজন বাঙালির পুজোর সঙ্গে তার কোনও মিলই নেই প্রায়। কী ভাবছেন? পুজোর পাঁচদিন একজন বাঙালির কাছে কতখানি স্বতন্ত্র আর হতে পারে! তাহলে দিল থামকে বইঠিয়ে জনাব, ঠাকুরদালানে বাঙালির পুজো যে কতখানি আলাদা হতে পারে, সে গল্পই শোনাব আগামী কয়েক পর্ব জুড়ে।
জন্ম ইস্তক দেখে আসছি বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। এই পুজো আমার বাড়ির কয়েক প্রজন্ম ধরেই তা দেখে আসছে। বাড়ির পুজো আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতিরই অঙ্গ। সুতরাং, আমি আর বুঝব কী করে যে, অন্য বাড়িতে পুজো হয় না! পুজোয় বেড়াতে যাওয়া? আমাদের জন্য নট অ্যাপ্লিকেবল। পুজোয় বিরিয়ানি খাওয়া? প্রশ্নই ওঠে না! আমিষের ছোঁয়াই নেই চার দেওয়ালের মধ্যে, তায় আবার বিরিয়ানি! রাত জেগে ঠাকুর দেখা? বলে কী! পরদিন ভোর ভোর আবার পুজো আছে না! অর্থাৎ আর-পাঁচজন বাঙালির পুজো বলতে ঠিক যা যা বোঝায়, আমার পুজো চিরকাল তা থেকে আলাদা। তাও একেবারে ছোটবেলায় এসব প্রসঙ্গই আমার মাথায় আসত না। কেননা ওই যে আমি জানতাম, সব বাড়িতেই পুজো হয়। একটু যখন বড় হলাম, বন্ধুদের মুখে পুজোর প্ল্যান-প্রোগ্রামের কথা শুনতে শুরু করলাম, তখন বুঝলাম যে, বাকিদের থেকে আমার পুজোর দিনযাপন পৃথক।
তাতে মনখারাপ! নাহ্, বিন্দুমাত্র নয়। পুজোয় বাকিদের রুটিন থেকে আমার নির্ঘণ্ট আলাদা হয় বলে বিন্দুমাত্র বিষাদের ছায়া পড়েনি মনে। বরং বিশ্বাস করুন, এমন আনন্দময় প্রসন্ন দিন বছরে খুব কমই আসে। শরৎ যেন তার অরুণ আলোর অঞ্জলি দিয়ে ধুয়ে দেয় আমার মন। আলোর বেণু বেজে ওঠে অন্তরের গহনে। সত্যি বলতে, বাকিদের পুজো তো পাঁচ দিনের। আমার পুজো তার থেকে ঢের বেশি দিনের। মহালয়ার ভোরে বীরেন ভদ্রের মন্দ্র কণ্ঠস্বরে ঘুম ভাঙলে বাঙালির ঘ্রাণে ভেসে আসে শিউলির সুবাস। আর আমি সে-সুবাস পেতে থাকি তারও বহুদিন আগে থেকে। যখন বাড়িতে শুরু হয়ে যায় পুজো নিয়ে আলোচনা। এবার কী হবে, কীভাবে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ছোট থেকেই সেই আলোচনার ভিতর যেন অন্যরকম তৃপ্তির আস্বাদ পাই। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। আর যখনই তা শুরু হয়, তখন থেকেই আমার পুজোর সূচনা। মনের মধ্যে বেজে ওঠে ঢাকের বাদ্যি! বাইরের কেউ শুনতে পান না, পুজোর সে-আমেজ একান্তই আমার, নিজস্ব সম্পদ। ঠাকুরদালানের গল্পে তা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব।
তা বলছিলাম যে, আমাদের বাড়ির পুজো বেশ আলাদা। আমার কাছে দুর্গাপুজো মানে, মহালয়ার পর বাড়ির চৌকাঠই শেষ সীমানা। যাই হোক, যখন জানলাম যে, সবার বাড়িতে পুজো হয় না, তখনই শিখলাম বারোয়ারি পুজোর কথা। অর্থাৎ বারো জনে মিলে পুজোর আয়োজন। তবে সেখানেও একটু ফারাক আছে। যাঁরা সর্বজনীন পুজো আয়োজন করেন, তাঁদেরও অবিশ্যি কম ধকল পোয়াতে হয় না! তাঁদের পুজোও অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। তবে সেখানেও একটা কমিটি থাকে। দায়িত্ব ভাগাভাগির ব্যাপার থাকে। বাঙালির দুর্গাপুজো যত বদলেছে, তত সেই সব পুজোর মধ্যে ঢুকে পড়েছে প্রতিযোগিতা। অতএব নজর কাড়ার একটা বাসনা থাকে। কিন্তু বাড়ির পুজো তো তা নয়। সে তো এক অপূর্ব আনন্দমেলা। বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত সব খুঁটিনাটি দেখে নিতে হয় নিজেকেই। প্রত্যেক বাড়ির পুজোর মতো আমার বাড়ির পুজোতেও নির্দিষ্ট কিছু রীতি-নীতি-প্রথা আছে। তা যাতে মান্য হয়, সেদিকে নজর দিতে হয়। অর্থাৎ নজরকাড়া হওয়ার লোভ নেই, কিন্তু পান থেকে চুন নজরছাড়া হওয়ার জো নেই। এই যে অক্লান্ত পরিশ্রম, দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া, তার ভিতরই যেন ঘন হয়ে ওঠে আনন্দের ভিয়েন। মনে হয় না পরিশ্রম করছি। বরং মনে হয়, এই পরিশ্রমের জন্যই তো উন্মুখচিত্তে অপেক্ষায় থাকি বছরের বাকি দিনগুলো। ঠাকুরদালান আমাকে শিখিয়েছে দায়িত্বশীল হতে। নিজের শিকড়ের যত্ন নিতে। ঠাকুরদালান-ই আমাকে শিখিয়েছে সংস্কৃতি শুধু ড্রয়িংরুমের সাজানো শৌখিনতা নয়, বরং তা যাপনেরই আখরমালা।
শুনেছি, পুজোর পাঁচদিন নাকি শহরের রেস্তোরাঁগুলোর বাইরে লম্বা লাইন পড়ে। আমি আজ অব্দি তা চাক্ষুষ করিনি, শুধু তার গল্প শুনেছি। পুজোর সময় আমাদের সংবাদপত্রের অফিসে ইভেন্টও হয়। ঠিক ইভেন্টের দিন আমি কোনও দিনই থাকতে পারি না। এ-ও শুনেছি যে, পুজোর সময় শহর নাকি একইসঙ্গে জমজমাট আর জ্যামজমাট। আমি দেখিনি সেই কলকাতা। আমার পুজোর শহর যেন এসে মেশে আমার শান্ত ঠাকুরদালানে। যেখানে অধিষ্ঠাত্রী মাতৃমূর্তি ঝলমল করে ওঠেন তাঁর সকল ঐশ্বর্য নিয়ে। আমি সেই অপূর্ব আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। অক্ষরে সে-আলোর আখ্যান প্রকাশ করা যায় না। তবে সমস্ত জাঁকজমক, ভিড়ভাট্টা, উদযাপন পেরিয়ে এই একান্ত যাপনের যে নিজস্ব এক বিভা আছে, আমি তা উপলব্ধি করি। উপলব্ধি করি সেই আলোই যেন ছড়িয়ে আছে ভুবনজুড়ে। শুধু দেখার চোখ নয়, সে-আলোর সন্ধান পেতে গেলে চাই অনুভবের মন।
ঠাকুরদালান-ই যেন আমাকে ফিরিয়ে এনেছে অপার অনুভবের সেই কিনারে। জীবনকে করে তুলেছে সত্যিকারের আলোর পথযাত্রী।
তত্ত্ববিদ, মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার কাজ নিয়েছে মস্কো রেডিয়োতে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ‘মির’ বা ’প্রগতি’তে অনুবাদক হয়েছে, কেউ বা সাংবাদিকতায় পি.এইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করে সংবাদপত্রের দফতর খুলে তার অন্তরালে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে।