অমৃতা তখন আকাশবাণীতে যেতেন প্রতিদিন সকালে। ইমরোজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন অমৃতা প্রতিদিন বাস ধরে আকাশবাণী যান। তাঁর ক্রমশ ইচ্ছে হল তিনি একটি স্কুটার কিনবেন এবং অমৃতাকে প্রতিদিন সকালে আকাশবাণীতে ছাড়তে যাবেন। ছ’মাস তিনি একটু একটু করে টাকা জমিয়ে স্কুটার কিনলেন। শোনা যায়, সেই স্কুটারের পিছনে বসে অমৃতা ইমরোজের কাঁধে হাত রাখতেন। তারপর তিনি আঙুল দিয়ে ইমরোজের পিঠে কবিতা লিখতেন। যে কবিতা শুধু তাঁরাই পড়তেন।
উত্তুরে হাওয়া বইছে অবিরাম। বসন্তের প্রাকলগ্নে ঝিমঝিম করছে স্মৃতিসারি। বুড়ো ছাদ থেকে আবার একটা দুপুর মিলিয়ে যাচ্ছে তেপান্তরে। যে পাড়ে রেখে এসেছি বসন্তের বায়না। যে সীমানায় ফেলে এসেছি খুচরো প্রেম। পাতা ঝরা মরশুম আবার নিয়ে এসেছে ভালোবাসার দিনরাত্রি, ভালো-থাকার প্রতিদিন। ভালোবাসা থাকলে প্রতিদিনই নতুন, প্রতিদিনই এক একটা পর্ব। যে পর্ব জুড়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার। সঙ্গে হাঁটার প্রতিজ্ঞা। যে সম্পর্ক কোনও বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের বেড়াজালকে বুড়ো আঙুল দেখায়। সঙ্গে থাকার জন্য যে বিয়ে করতে হবে, এমনটা নয়। চাইলে কোনও নিয়ম ছাড়াই দিব্যি জড়িয়ে থাকা যায় সারাটা জীবন। শুধু এক জীবন কেন, জীবনের পরেও তাঁকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায় অন্য একটা জীবন। অমৃতা এবং ইমরোজ সেই গল্পেরই নায়ক নায়িকা। যেটা গল্প হলেও সত্যি। চল্লিশটা বছর একসঙ্গে থাকা, তাও আবার বিয়ে না করে। যে সময়ের কথা হচ্ছে, সময়টা ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার কিছু বছরের পরের কথা। এক কবি সাহিত্যক এবং এক কবি চিত্রকরের জীবনের কাহিনি। যাপনের গল্প। প্রতিশ্রুতি রাখার গল্প।
অমৃতা প্রীতমের জন্ম ১৯১৯ সালের অবিভক্ত পাঞ্জাবে। ছোট থেকেই সাহিত্যের প্রতি তাঁর অমোঘ টান। তাঁর বাবা কবিতা লিখতেন। তাই হয়তো রক্তেই ছিল কবিতা লেখার বীজ। পাঞ্জাবি সাহিত্য তথা ভারতের সাহিত্যের মানচিত্রে অমৃতা প্রীতম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তবে তাঁর আসল নাম অমৃত কৌর, তাঁর বিয়ের পরে তিনি অমৃতা প্রীতম নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং সেই নামেই অধিকাংশ কালজয়ী কাজ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করেন প্রীতম সিং-কে। কিন্তু নিয়মমাফিক তাঁদের সম্পর্ক চলেনি। শোনা যায়, নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা তাঁদের সাজানো সংসারে ভাঙন ধরাচ্ছিল। আসলে অমৃতা প্রীতম জীবনে নিজের শর্তে বাঁচতে চেয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাই করেছেন। তবুও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অমৃতা কারও প্রতি কোনও অভিযোগ করেননি। শুধু নিজের কাজটা করে গিয়েছেন। অমৃতা প্রীতমের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অমৃত লেহরান’! প্রসঙ্গত এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬। তারপর একে একে তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি পাঞ্জাবি সাহিত্যে আলোড়ন ফেলে দেয়। ‘সুনেহারা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান। প্রসঙ্গত তিনিই প্রথম মহিলা কবি, যিনি প্রথম সাহিত্য অ্যাকাডেমি পেয়েছিলেন। এছাড়াও তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস ‘পিঞ্জর’ অবলম্বনে তৈরি হয় সিনেমা। তাঁর রচিত উপন্যাস ‘যাত্রী’ বিশেষভাবে সমাদৃত। ‘কালা গুলাব’ নামক তাঁর আত্মজীবনমূলক উপন্যাসও এখনও সাহিত্য জগতে আলোচনার বিষয়। কিন্তু তাঁর কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনটাও একটা হলদেটে উপন্যাস। তাঁর সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ সিংহ, ওরফে ইমরোজের প্রথম দেখা হয় ১৯৫৭ সালে। ইন্দ্রজিৎ সিংহ একজন কবি এবং চিত্রকর। তবে যখন তাঁদের প্রথম দেখা হয়েছিল ততদিনে অমৃতা একজন সফল সাহিত্যিক। অন্যদিকে ইমরোজ তখনও তাঁর পেশায় সাফল্য পাননি। ইমরোজ অমৃতার চেয়ে বয়সে সাত বছরের ছোট। দিল্লিতেই একটি অনুষ্ঠানে তাঁদের প্রথম দেখা। তারপর অমৃতার সাহিত্য অ্যাকাডেমি পাওয়া কাব্যগ্রন্থ ‘সুনেহারা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি প্রচ্ছদ আঁকেন। সেই তাঁদের শুরু। ওই যে তখন তাঁরা একে অন্যের ভরসা হয়ে উঠলেন, সেই ভরসা অটুট ছিল আজীবন। হয়তো জীবনের পরেও তাঁরা একে অন্যের হাতে হাত রেখে এগিয়ে গিয়েছে।
অমৃতা প্রীতমের সঙ্গে কোনও দিন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি তিনি। তাঁরা একসঙ্গে চল্লিশ বছরের বেশি সময় একসঙ্গে কাটিয়েছেন। এটা যে যুগের ঘটনা, সেই সময় বিয়ে না করে একসঙ্গে থাকাটা একটা যুদ্ধের সমান। তবুও তাঁরা পরোয়া করেননি। আজকাল একসঙ্গে থাকতে গেলে ইউসিসি-র নিয়মের আওতায় নিজেদের নথিভুক্ত করতে হয়। যদিও এখন লিভইন একটা আভিজাত্যের বিষয়। সমাজমাধ্যমে একত্রবাসের ছবি শেয়ার করে বাহবা কুড়নোর ফন্দি। কিন্তু সেই যাপন কোথায়? যেখানে কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই! যেখানে একে অন্যের ছেড়ে যাওয়ার ভয় নেই, যেখানে নেই কোনও বিশেষ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছে! সেই ভালোবাসার গল্প লিখে গিয়েছেন অমৃতা এবং ইমরোজ।
অমৃতা তখন আকাশবাণীতে যেতেন প্রতিদিন সকালে। ইমরোজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন অমৃতা প্রতিদিন বাস ধরে আকাশবাণী যান। তাঁর ক্রমশ ইচ্ছে হল তিনি একটি স্কুটার কিনবেন এবং অমৃতাকে প্রতিদিন সকালে আকাশবাণীতে ছাড়তে যাবেন। ছ’মাস তিনি একটু একটু করে টাকা জমিয়ে স্কুটার কিনলেন। শোনা যায়, সেই স্কুটারের পিছনে বসে অমৃতা ইমরোজের কাঁধে হাত রাখতেন। তারপর তিনি আঙুল দিয়ে ইমরোজের পিঠে কবিতা লিখতেন। যে কবিতা শুধু তাঁরাই পড়তেন। তবে শোনা যায়, অমৃতা তাঁর বিয়ের বেশ কিছু বছরের মধ্যে সাহির লুধিয়ানভির প্রেমে পড়েন এবং তাঁকেই নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে মনে করেন। শুধু তাই নয়, সাহিরকে ছাড়া তিনি আর কোনও পুরুষকে নিজের জীবনে প্রেমের জায়গা দিতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দেন তিনি। তবুও ইমরোজ অমৃতাকে ছেড়ে যাননি। তাঁর পাশে থেকেছেন। তাঁর ভরসা হয়ে রয়ে গিয়েছেন। অমৃতা যখন মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে কবিতা লিখতে উঠতেন, তখন তাঁর জন্য চা বানিয়ে দিতেন ইমরোজ। তিনি সাহিরের জন্য কবিতা লিখেছেন, তবুও ইমরোজ একটুও রাগ করেননি। উপরন্তু তাঁকে উৎসাহিত করেছেন।
ইমরোজ সবসময় অমৃতাকে ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করেছেন। ব্যক্তিগত চিঠি হোক কিংবা কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার জন্য, সবসময় তিনি অমৃতাকে ‘ম্যাডাম’ বলেই ডাকতেন। ওদের দু’জনকে যাঁরা চিনতেন, তাঁরা বলতেন যে ওঁদের যাপন ছিল অনেকটা রূপকথার মতো। অমৃতা লিখতেন এবং ইমরোজ আঁকতেন। তাঁদের বাড়ির দেওয়ালে কবিতা এবং ছবির মেলবন্ধন ফুটে উঠত। ইমরোজ তাঁদের বাড়ির দেওয়ালের প্রতিটা ইটে অমৃতার নাম লিখে রেখেছিলেন। ওদের জীবনটা নিয়ে জানতে গিয়ে বারবার দেখা যায়, একটা সম্পর্ক কতটা সহজ হতে পারে। লেখিকা উমা ত্রিলোক তাঁর বইতে লিখেছিলেন যে, অমৃতা প্রথম তলায় থাকতেন। নীচ থেকে একতলার যাওয়ার সিঁড়িতে ইমরোজের আঁকা প্রচুর ছবি তিনি দেখিছিলেন। প্রতিটা ছবি ছিল অমৃতার কোনও না কোনও কবিতার প্রতিচ্ছবি। একটা যাপন কতটা সুন্দর হতে পারে, কতটা মোলায়েম হতে পারে– সেটা এই দু’জনকে জানলে বোঝা যায়। সিচুয়েশনশিপের নতুন প্রজন্মে হয়তো অমৃতা ইমরোজ ফ্যাকাসে। যে সমাজে ‘বেঞ্চিং’-এর কনসেপ্ট চালু হয়েছে, সেই সমাজ একে অন্যের পাশে থাকা কি বুঝবে, বুঝবে ভালোবাসলে সময় থমকে যায়, মৃতে প্রাণ আসে?
…………………………………..
অমৃতা আর ইমরোজের ভালোবাসায় কোনও লোকদেখানো আভিজাত্য নেই। বিশেষ কোনও দেখা হওয়ার দিন নেই। আসলে প্রতিটা দিনই ভালবাসার জন্য উৎসর্গ করেছেন ওঁরা। অমৃতা নারীর ক্ষমতায়ান নিয়ে বারবার সরব হয়েছে। তাঁর লেখনী থেকে পথের সংগ্রাম– সবেই সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে। তবুও সেই যুগে ইমরোজ কিন্তু একবারেও জন্যও অমৃতাকে পিছনের সারিতে না রেখে বারবার এগিয়ে দিয়েছে।
………………………………….
বসন্তের প্রাকলগ্নে মনে হয় বারবার ছুটে যাই, জড়িয়ে ধরি যাকে রেখে এসেছি সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। আমাদের কথা বলার সময়টাও বড্ড আজব ছিল। আমার দেশে তখন সকাল ওর দেশে তখন রাত। দেবী বারান্দায় হাইড্রেনজিয়া রাখত। এলোচুল উড়িয়ে দাঁড়াত বহুতল বিলাসী ফ্ল্যাটের বারান্দায়। আমি চাইলেও ওকে ছুঁতে পারতাম না। আমি বলতাম জীবনে সলমন, শাহরুখ খানের মতো প্রেমিক নয় বরং ইমরোজের মতো প্রেমিক হতে পারলেই খুশি হব। তুমি হাসতে আর বলতে দেখা হলে ওদের গল্প শুনিও।
প্রেমে একে অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে ছাড় দেওয়াটা জরুরি। জড়িয়ে থাকার পাশাপাশি দূরত্বও জরুরি। নয়তো কোনও দিন অমৃতা এবং ইমরোজের জীবন এতটা উজ্জ্বল হত না। শোনা যায়, তাঁরা একই বাড়িতে থেকেও একে অন্যকে চিঠি লিখতেন। এইরকম ভালবাসার জন্যই তো বসন্ত আসে বারবার।
অমৃতা আর ইমরোজের ভালোবাসায় কোনও লোকদেখানো আভিজাত্য নেই। বিশেষ কোনও দেখা হওয়ার দিন নেই। আসলে প্রতিটা দিনই ভালবাসার জন্য উৎসর্গ করেছেন ওঁরা। অমৃতা নারীর ক্ষমতায়ান নিয়ে বারবার সরব হয়েছে। তাঁর লেখনী থেকে পথের সংগ্রাম– সবেই সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে। তবুও সেই যুগে ইমরোজ কিন্তু একবারেও জন্যও অমৃতাকে পিছনের সারিতে না রেখে বারবার এগিয়ে দিয়েছে। তিনি শুধু পাশে থেকেছেন। অমৃতা পাঁচ বছরের জন্য রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। প্রসঙ্গত রাজ্যসভার সদস্যদের মধ্যে ১২ জনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে পারেন। এই ১২ জন রাজনৈতিক কেউ না। তাঁরা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা তাঁদের নিজেদের কৃতিত্বতে। কেউ লেখালখি, কেউ ক্রীড়া, আবার কেউ সামাজিক কাজে। তেমনই ভাবে অমৃতা রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন। শোনা যায় সেই সময়ও ইমরোজ তাঁকে সাহস জুগিয়েছিলেন। তাঁদের যাপন কালজয়ী। শেষ জীবনে অমৃতা অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘদিন। অমৃতা ইমরোজের জন্য লিখেছিলেন, ‘ম্যায় তেনু ফির মিলাঙ্গি, কিথে… কিস তরাহ…পতা নাহি… পর তেনু জরুর মিলাঙ্গি!’ ২০০৫ সালে অমৃতার মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে ছিলেন ইমরোজ। অমৃতার মৃত্যুর পরে তিনি বলতেন,’উয়ো ইয়েহিঁ হ্যায়, ঘর পর হি হ্যায়, কহিন নহি গয়ি’। দীর্ঘদিন ধরেই বয়সজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন ইমরোজ। শেষদিকে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। সেই অবস্থাতেও অমৃতার মৃত্যু নিয়ে কেউ কথা বললে বিরক্ত হতেন। বলতেন,’অমৃতা এখানেই আছে।’ অমৃতার জন্মদিন কখনও ভোলেননি ইমরোজ। প্রতি বছর পালন করতেন নিজের মতো করে। ২০২৩ সালে মারা গিয়েছেন ইমরোজ। কিন্তু আজও দিল্লির হাউজ খসে রয়ে গিয়েছে ওঁদের স্মৃতি। ওঁরা দু’জনে এখনও পথ হেঁটে যাচ্ছে চুপিসারে। একে অন্যের ভিতরে রয়ে গিয়েছেন বিনা দ্বিধায়। ঝরা পাতার মরশুম এসেছে। রোদে ভিজেছে চারপাশ। পলাশ, কৃষ্ণচূড়া ঝরে ঝরে পড়েছে। ছেঁড়া পালক উড়ে গিয়েছে অবসরে। শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্যই তো বেঁচে থাকা। উত্তুরে হাওয়া বইছে অবিরাম। বসন্তের প্রাকলগ্নে ঝিমঝিম করছে স্মৃতিসারি। বুড়ো ছাদ থেকে আবার একটা দুপুর মিলিয়ে যাচ্ছে তেপান্তরে।