ভালোবাসার কোনও নির্দিষ্ট দিন নেই, মুহূর্ত নেই; লিঙ্গ নেই, লিঙ্গ ভেদও নেই। ভালোবাসায় কোনও অস্বাভাবিক নেই, বিকৃতি নেই। এই মর্মেই বড় হোক আমার অনেক অনেক হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলারা। আর সেইসব গল্পের মানবীরাও মানুষ থাকুন, ঈশ্বর না হয়ে। মানুষই মানুষের পাশে থাকে, হাত ধরে, সাহস জোগায়। সারি সারি একরঙা গোলাপের বাগানে, সাতরঙা একটা অন্য কুঁড়িও যত্নের আবেশে ঝলমল করুক রোদ্দুরে।
দোতলার পড়ার ঘরে জানলার বাইরে একটা নিমগাছ ছিল। কলকাতা শহরে তখনও হলুদ আলোরা মরে যায়নি; তার ফাঁকে ফাঁকে নিমগাছের পাতা ছুঁয়ে পড়ার টেবিলে নেমে আসত বসন্তকাল। চর্যাপদ, আকবরের রাজত্বকে ফাঁকি দিয়ে চিঠিরা বন্দি হত ড্রয়ারে। মস্তিষ্কের পাকদণ্ডিতে স্বপ্নের মধ্যে সমস্ত অবয়ব, সমস্ত মুখ তুমি হয়ে যেত।
তারা খসা আলো রঙের শাড়িতে দ্রুত আন্দোলন তুলে দৃঢ় হেঁটে আসতে তুমি। স্কুলে পড়াকালীন আমার সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য ছিল এটা– হাজারও হর্ন, ভেসে বেড়ানো আচারের গন্ধ, পেনসিলের খোঁচার মাঝখান ফুঁড়ে এসে দাঁড়াতে! আর রাস্তার ওপারে আমার স্কুল ফ্রক উড়ত হাওয়ায়। এখনও চোখ বন্ধ করে বাইপাসে ছোটা গাড়ির জানলা থেকে– এই দৃশ্য আমি অনায়াসে দেখতে পাই।
পেনের কালি মাখা হাতে ঘাম জমিয়ে চলে যাওয়া মানবী, আমাকে পলক ফেলতে দেয়নি দিনের পর দিন! আমের আচারের ঠোঙায় ডোবানো আঙুল, ক্যাম্বিসের ব্যাগের মধ্যে রাঙতায় মোড়া চকলেট, আর আধ ভাঙা ইরেজারে আমি তখন ক্লাস সেভেন। পাশ দিয়ে যখন হেসে বেড়িয়ে যেতে, তোমার গায়ের হাওয়া শরীর ছুঁয়ে যাওয়ার গন্ধের আবেশে মুগ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট আমি ভেবেছি, আমিও তো, এরকমই– একদম এরকমই হতে চাই। ফ্যালফ্যালে কিশোরী কেবল মুগ্ধ হয় আর নোটস নেয় মনে মনে!
তেরো বছরের কিশোরীর ঘুম অমন চমকে ভাঙে খুব কম। মনে পড়ে, তৎকালীন এক বান্ধবীকে এই চমকটা ভাগ করে নেওয়ার তাগিদে বোঝানোর চেষ্টা করতে হয়েছিল বহুল। আমি তখন প্রেম-যৌনতা-আকর্ষণ, বা তার একটিও ডাকনাম জানি না। আমাদের তখন বুক ক্রিকেট, পেন ফাইটিং, আর খাতার শেষ পাতায় ‘FLAMES’ খেলা।
এরপর একদিন আইসক্রিমের কাঠি ভাঙা বিকেলবেলার কমলারং চিরে, রুল টানা পাতায় নামল নুরজাহান হয়ে; এক আনাড়ি প্রেমপত্র! গলে গেল তোমার দরজার ফাঁক দিয়ে।
চিঠি পেয়ে হেসেছিলে ভয় পাওয়া আমাকে দেখে। সাহস বাড়ে, আমিও সেখানে সেখানে যেখানে তুমি। তেরো বছর বয়সে এমন এক গর্তে ঢুকলাম যার মাথা বা শেষ কোনওটাই চেনা নয়। শুধু স্কুল ফেরত বিকেলবেলারা বন্ধকি হয়ে গেল একবার চোখে দেখার কাছে। দস্যিপনার শৈশব নতজানু হয়ে রইল কয়েক ফোটা এলোমেলো ছিটকে পড়া বর্ণমালার টানে।
ঠিক এই অবধি বলা যায়; তারপর সবটাই সীতার রেখা পার। এই গল্পে রাবণ নেই কোনও, শুধু এক ভিনরাজ্যে তোমার পাড়ি দেওয়া আছে। আমি যখন এলোপাথাড়ি হাওয়া মোরগের সঙ্গ হুঁশ-ধাপ্পা খেলায় মশগুল; তখনই একদিন তোমার সীমন্তে সূর্য ওঠে। চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে, ফার্স্ট বেল থেকে পাতলা সঞ্চয়িতার আড়ালে উঠে আস সিঁদুর নিয়ে।
কিন্তু শিশুরা কেন ভুল করে আগুনে হাত দিয়ে ফেলে? পুড়ে যাওয়ার মানে জানে না তাই! কাজেই তোমার কপালের ওপর জেগে থাকা গৃহস্তের লাল সূর্য সত্ত্বেও, আলোর পরীরা তখনও চোখের সামনে জমিয়ে রেখেছে ধোঁয়ার আউটলাইনে তোমাকেই।
যে ভালোবাসার কথা ভাগ করে নেওয়ার লোক নেই, তার কবিতার খড়কুটো এঁকে ছুড়ে দিয়েছি ধুলোর আয়নায়, কলমে নিশপিশে চিঠিদের দুধ-কলা দিয়ে পুষেছি বুকপকেটে, আরও ভেতরে নরম আদরে ক্রমশও বেড়েছে অসুখ। তুমি অটোতে উঠে চলে যাওয়ার মুহূর্তে হাতে গুঁজে দিয়েছি চিরকুট, চিঠি– ব্যাগের পকেটে চালান করে মৃদু হেসে বলে গেছ, ‘এবার বাড়ি যাও।’
তারপর একদিন এসে দাঁড়ালে দরজায়। দু’হাত জোড় করে আমার মায়ের কাছে জানালে আমি সমানে ডিঙিয়ে গেছি সীমানা… সমানে ভেঙেছি আসবাব বাসন, সমানে তছনছ করে গেছি সাজানো পসরা তোমার সংসারের। আর আমি দেখি, শূন্য থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে কেমন অনাবিল মিথ্যে বলে যায় ঈশ্বর। তার ভাষা কেমন অতি পরিচিত সুবিধেবাদীর মতো ঠেকে; চিনতে পারছি না তোমায়।
নব্বইয়ের বাঙালি-মধ্যবিত্ত বাড়ির শিশুদের বেড়ে ওঠাটা খুব একটা অন্যরকম নয়। সেই সময়ের বাবা-মায়েরা সমকামকে বিকৃতি হিসেবেই দেখতেন; এবং তাকে অন্যভাবে দেখার জন্য যা যা প্রশ্ন সামনে আসা দরকার তার সুযোগও ছিল কম। ফলে, তারা নেহাতই নির্দোষ। কিন্তু বিস্ময় হতচকিত আমার মা সেদিন প্রশ্ন করেছিল তোমায়– জানতে চেয়েছিল তুমি ৭ বছর আগে কেন নালিশ করোনি এভাবে? মায়ের ওপর আমার অনেক অভিমান, অনেক রাগ; কিন্তু আমার প্রথম পাড় ভাঙা বন্যায়, আমার সেদিনের ওই অকস্মাৎ মহাযুদ্ধে আমার বিজয়ের সেনাপতি– আমার মা!
বিভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পর, মনে পড়ছিল এক সূর্যাস্তের আলোয় তোমার হাত ধরে বড় রাস্তা পেরিয়ে গেছিলাম আমরা। স্পর্শের মানও জানত না তখন কিশোরী আঙুুল!
অথচ দিনের পর দিন, তোমার হাসিরা সাড়া দিয়ে গেছে প্রেমে, চিঠিরা উড়েছে সম্বৎসর, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তোমার কাছে এসে। মেট্রো স্টেশনের লাল ঘড়িতে চোখ রেখে বলেছিলে ‘আর এসব করো না তুমি, এমনিতেই আমার প্রচুর দুর্নাম।’ তবু থামতে শেখাওনি আমায়। এভাবে পালিয়ে, হাঁফিয়ে, পড়ে, দৌড়ে, বাঁচি যখন; তুমি তখন কোথাও নেই। হয়তো বা রঙিন পেনের কালিতে ছেলের খাতায় পড়া লিখে দিচ্ছ, অথবা রাতের খাওয়ার টেবিলে ডালের বাটি সাজাচ্ছ সকলের জন্য। অথচ একটা এলোমেলো কিশোরীর রামধনু রঙের ডানায় ভয়াল উড়ান; সেখানে তাকে সারাদিন সামনে পেয়েও তোমার দায় ছিল না কোনও! তুমি নাকি বুঝতেই পারোনি এটা এমন প্রেম, এমন ভালোবাসা? অথচ মায়ের সামনে অবলীলায় বলেছিলে– ‘এমন ভালবাসা দুটি ছেলে-মেয়ের মধ্যে দেখা যায় কেবল।’
সেদিন আমার মুখে ভাষা ছিল না, বোধ ছিল না ভেতরের তোলপাড়ের। কিন্তু তুমি জানতে, সব জেনেও সেদিন তোমার মনে হয়নি একবার ডেকে কথা বলি। নরম হৃৎপিণ্ড নিয়ে উড়তে থাকা দুঃসাহসী মেয়েটার মায়ের সঙ্গেও সেদিন কথা বলা উচিত মনে হয়নি তোমার। অথচ বোর্ডে এসে কী সহজে ভাব সম্প্রসারণ লিখে যেতে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’
সেদিন ‘হারালাম’ বলতে তুমি আমার বাড়ি এসেছিলে, এবং হারিয়েও গেছিলে। কিন্তু যে মায়াদানব বুকের কোটর ভেঙে ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক পর্যন্ত আয়ত্ত করে নিয়েছে তা থেকে মুক্তি দুঃসাধ্য। এই পথটা বড় দুর্গম। বুঝেছিলাম নিজের ভেতরের ভাঙচুরের আওয়াজ কী প্রচণ্ড হতে পারে। আজও আমি নিজের থেকে খুব সহজে আলগা করে বাইরে রেখে দেখতে পারি ওই বোকা, অবুঝ সত্তাটাকে… ছটফটিয়ে গেছিল বোকা মেয়েটা, প্রেমে নয়, প্রেম হারানোর যন্ত্রণায় নয়– হেরে যাওয়ার জন্য, অবিশ্বাসের সঙ্গে প্রথমবার সংঘাতে একা হয়ে যাওয়ার জন্য। যে আমার সমস্ত ব্যাকুল চিঠির আশ্রয়, প্রথম কাজল পড়া শিখলাম যার সামনে– অভিভাবক হিসেবে তার একটা দায় ছিল। দায় ছিল আরেকটু নিজে জানার, প্রয়োজনে কথা বলার, মাথায় হাত রেখে বা শাসন করে। দায় ছিল বন্ধু হয়ে ওঠার, সাহস জোগানোর।
যে জানেই না এটা প্রেম, যার কোনও পরিচয়ই নেই অন্যরকম যৌনতার সঙ্গে, যে মানুষকে ঈশ্বর বলে জেনেছিল– তাকে যুদ্ধের সামনে দাঁড় করিয়ে পালিয়ে যাওয়া কেবলই অসম শক্তির আস্ফালন। তার হাতের লেখা নকল করা আমি, তার বর্ণমালার প্রতিটা ভাঁজকে প্রাণপণে আয়ত্ত করতে চাওয়া আমি সেদিন বড্ড ছোট; তাই তাঁর দায় ছিল আরেকটু নরম দেওয়ার, বিভ্রান্ত না করার।
সময় ছাড়া আরও অনেক কিছু লেগেছিল সেই খাদ ভেঙে উঠে আসতে। ততদিনে জেনে গেছি আমার প্রেম অন্যপথে আসে; কিন্তু সেদিনের তার লজ্জার করজোড় বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল সে প্রেম বিকৃতি, সে প্রেম অসুস্থ। অনেকটা সময় এরপর দম বন্ধ করে, নিজের অসুস্থতাকে সম্বল করে একদিন সানন্দার একটা প্রতিবেদন থেকে পৃষ্ঠা ছিঁড়ে রাখলাম সেই চিঠির ড্রয়ারে, সেখানে স্যাফোর ফোন নম্বর দেওয়া ছিল। যে সাহসে তোমার হাতে গুঁজে দিয়েছিলাম প্রেমপত্র, সেই সাহস সম্বল করে এসে দাঁড়ালাম প্রাইড মার্চে। দেখলাম আমার মতন হাজার হাজার ‘অস্বাভাবিক’, ‘বিকৃত’ মানুষ; আর তাদের মাথার ওপর বসন্তের হাওয়ায় উড়ছে রামধনু।
তাই আজ যখন আমার সাথীদের সঙ্গে স্লোগানে-মিছিলে মুখর হাঁটি, আর দুই হাতে তোলা বিজয়ীর পোস্টারে “Sorry, Can’t hide this pride”– সেদিনের তোমার প্রতিটা কথার উত্তর আমাকে পাক দিয়ে দিয়ে ঝলমল হাসে আর ওড়ে|
আসলে তুমি জানতে সবটাই, তোমার মতো সবাই সবটাই জানে– মানতে চায় না। ফ্রক পরে স্কুলে যায় কোরকের মতো ছেলে-মেয়েরা। তাদের যাঁরা সারাদিন পড়ান, চোখে রাখেন, বড় করেন, খাতা দেখেন– তাঁদের অনেক বেশি মায়ার অভ্যেস করতে হয়। যে কিশোরটি ফুটবল নয়, বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে আবৃত্তি ক্লাসের খোলা দরজার দিকে– তাকে কবিতার আকাশ পেড়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হয়। যে মেয়েটি কেবলই P.T ক্লাসের দিন হইহই করে দাপিয়ে বেড়ায় স্কুল, কারণ ওই একটাই দিন তার T-shirt Tracks পরার, তার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলতে হয়, ‘তোমার ইচ্ছে হলে, ছেলেদের ইউনিফর্ম পরে স্কুলে এসো।’ যে ছেলেটির মেয়েলি কণ্ঠের জন্য তার অন্য বন্ধুরা তাকে ‘লেডিজ’ বলে ডাকে– সেই বন্ধুদের ডেকে বলতে হয় ‘লেডিজ’ হওয়া অসম্মানের নয়। কোমর একটু বেশি দুলিয়ে যে ছেলেটি স্টাফ রুমে চক আনতে আসে, তাকে দেখে ব্যঙ্গের হাসি চাপা অভিভাবকসুলভ নয়।
ভালোবাসার কোনও নির্দিষ্ট দিন নেই, মুহূর্ত নেই; লিঙ্গ নেই, লিঙ্গ ভেদও নেই। ভালোবাসায় কোনও অস্বাভাবিক নেই, বিকৃতি নেই। এই মর্মেই বড় হোক আমার অনেক অনেক হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলারা। আর সেইসব গল্পের মানবীরাও মানুষ থাকুন, ঈশ্বর না হয়ে। মানুষই মানুষের পাশে থাকে, হাত ধরে, সাহস জোগায়। সারি সারি একরঙা গোলাপের বাগানে, সাতরঙা একটা অন্য কুঁড়িও যত্নের আবেশে ঝলমল করুক রোদ্দুরে। তারও কপালে জল পরুক ঠান্ডা, সার আসুক সেরা, পৃথিবীর প্রতিটি ‘সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’
প্রীতীশদা বলতেন, আমি এই ‘লাভ’ (love) শব্দটাকে একেবারে পছন্দ করি না। আই লাইক ‘হেট’ অর ‘রেসপেক্ট’– এখন বুঝি, এটা বজায় রাখার জন্যই প্রীতীশদার এত পাগলামি! ‘এক্সট্রিমিস্ট’ যাকে বলে আর কী! ওঁর বিশ্বাস, পৃথিবী কালকেই শেষ হয়ে যাবে, যা করার আজকেই করতে হবে এবং তা হবে জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ।