একুশ শতকে ঘটে চলা নিদর্শনগুলি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে ধর্ষণ বা যৌন-হেনস্তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অপরাধী বিরল মানুষ নয়। ঘটনা বিশেষে ধর্ষক এক বা একাধিক ব্যক্তি হতে পারে। কিন্তু ধর্ষণ সবক্ষেত্রেই সংগঠিত অপরাধ। কিন্তু ধর্ষণ আর ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখায়, সংগঠিত চেহারা লুকিয়ে রাখায় লাভ কার? লাভ তাদেরই যারা সমাজে লিঙ্গ-জাতি-শ্রেণি-ধর্ম ভিত্তিক বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে চায়, নিজেদের মসনদ সুরক্ষিত করতে। ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চোখ সরিয়ে দিতে চায় কাঠামোগত ব্যর্থতা থেকে।
আরজি করে কর্মরত ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যার পর কেটে গেছে ৬ মাস। রাত দখলের ৬ মাস প্রায় পার। রাস্তা থেকে ধীরে ধীরে মুছে গেছে জাস্টিসের লিখন। কিন্তু মোছেনি ধর্ষণ আর খুন। মোছেনি লিঙ্গভিত্তিক হিংসার দাপাদাপি। ইতিমধ্যে কলকাতার লোয়ার কোর্টে ঘটনাটির রায় বেরিয়েছে। চলছে রায় আর অপরাধী নির্ধারণের পুঙ্খানুপুঙ্খ কাঁটাছেড়া। অপরাধী একজন, না কি একাধিক? প্রশ্নটি ঘুরে-ফিরে আসছে মানুষের আলোচনায়।
রায়টিতে বিচারক বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় অপরাধী একমাত্র সঞ্জয় রায়। রায় এ-ও বলছে যে, বিভিন্নভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ঘটনা, বলছে আরজিকরের প্রশাসনিক গাফিলতির কথা। বলছে, যদি রায়টিকেই বিচার্য মনে করি, তবুও অপরাধী কি একক এক ব্যক্তি? আরজিকরের ধর্ষণ ও খুনের অপরাধী কি আরজিকর কর্তৃপক্ষ নয়? প্রশাসন নয়? রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো নয়?
………………………………………
সম্প্রতি কেরলের ১৮ বছরের একটি দলিত মেয়ে ৬৪ জন পুরুষকে তাঁর প্রতি যৌন-হেনস্তার অপরাধে অভিযুক্ত করেছেন। ৬৪ জন পুরুষের মধ্যে রয়েছে মেয়েটির প্রতিবেশী, খেলার প্রশিক্ষক, পারিবারিক বন্ধু ইত্যাদি। অভিযুক্তদের বয়স ১৭ থেকে ৪৭ বছরের মধ্যে। বিভিন্ন বয়সি এই পুরুষরা মেয়েটিকে ১৩ বছর বয়স থেকে নানা উপায় যৌন-হেনস্তা করেছে দীর্ঘ সময় জুড়ে।
………………………………………..
‘অপরাধী’ কখনওই একজন কি? প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণ-সহ লিঙ্গ-হিংসাজনিত যে কোনও ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্ধন জোগানো, হিংসার শিকার মানুষদের পাশে দাঁড়ানোয় অনীহা, প্রতিষ্ঠানের মান বাঁচানোর জন্য অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া, চুপ করিয়ে রাখার নরম-গরম হুমকি– এসব কি আমাদের অচেনা? অপরাধীকে আড়াল করাই কি দস্তুর নয়? বহুজাতিক সংস্থা হোক বা সরকারি কলেজ বা থিয়েটার গ্রুপ বা অন্দরমহল থেকে বন্ধুমহল– ছবিটা কি কোথাও বিশেষ আলাদা?
সম্প্রতি কেরলের ১৮ বছরের একটি দলিত মেয়ে ৬৪ জন পুরুষকে তাঁর প্রতি যৌন-হেনস্তার অপরাধে অভিযুক্ত করেছেন। ৬৪ জন পুরুষের মধ্যে রয়েছে মেয়েটির প্রতিবেশী, খেলার প্রশিক্ষক, পারিবারিক বন্ধু ইত্যাদি। অভিযুক্তদের বয়স ১৭ থেকে ৪৭ বছরের মধ্যে। বিভিন্ন বয়সি এই পুরুষরা মেয়েটিকে ১৩ বছর বয়স থেকে নানা উপায় যৌন-হেনস্তা করেছে দীর্ঘ সময় জুড়ে।
ফ্রান্সের জিসেল পেলিকো, যার ‘স্বামী’ ২০১৯ সালে একজন কিশোরীকে গণপরিসরে যৌন-হেনস্তা করার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তদন্তে সামনে আসে লুকিয়ে রাখা ভিডিও রেকর্ডিং। জানা যায়, ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে জিসেলের ‘স্বামী’ ৭১ জন পুরুষকে গোপন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানায় জিসেলকে ধর্ষণ করতে। এই ৯ বছরে জিসেলকে ড্রাগ দিয়ে বারবার অচৈতন্য অবস্থায় ধর্ষণ করা হয়, তারই বাড়িতে। জিসেল প্রথম জানতে পারে, তার সঙ্গে চলা দীর্ঘ অপরাধের কথা। সম্প্রতি জিসেলের স্বামী-সহ ৫১ জন ধর্ষক সাজা পেয়েছে।
জার্মানিতে একটি তদন্তে একাধিক টেলিগ্রাম গ্রুপের কথোপকথনের তথ্য বাইরে এসছে যে গ্রুপগুলির সদস্য প্রায় ৭০ হাজারের বেশি পুরুষ। বিভিন্ন দেশের নাগরিক এই গ্রুপের সদস্যরা। এদের চর্চার বিষয় ছিল মেয়েদের অচৈতন্য করে ধর্ষণ করার নানা উপায় আলোচনা করা। এহেন পুরুষেরা এই গ্রুপগুলিতে ভাগ করে নিয়েছে নিজেদের কৃত যৌন-হিংসার বিভিন্ন ভিডিও– যেমন সাফল্যের খবর ভাগ করা হয় পরিচিত সমমনস্ক মানুষদের সঙ্গে। আলোচনা করেছে এই অপরাধগুলি করে পার পাওয়ার বিবিধ পথও।
প্রতিটি ঘটনাই চরম বাস্তব। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটা অপরাধের সংগঠিত ধরন, অপরাধীদের পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্যে সামঞ্জস্য দেখলে চমকে উঠতে হয়। এতগুলি মানুষ যারা হয়তো একে-অন্যের পরিচিতও নয়, তবু নারীর শরীরের ওপর হিংসার মধ্যে নিজের ক্ষমতা কায়েমের অমোঘ টানে এরা একত্রিত হয়, বারবার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়। এদের একসূত্রে বাঁধে ধর্ষণ-সংস্কৃতি। রাষ্ট্র, পরিবার, মিডিয়া, আইন ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্র– সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আর পরিসরে চাষ হয় ধর্ষণ-সংস্কৃতির, যা ধর্ষণকে সহজ ও স্বাভাবিক করে তোলে, মেয়েদের, প্রান্তিক লিঙ্গ যৌন পরিচয়ের মানুষদের ওপর শোষণকে অদৃশ্য করে রাখতে সাহায্য করে। এর উদাহরণ ভূরি ভূরি।
আমাদের চোখের সামনেই মুসলিম মেয়েদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিলামে চড়ানো হয়। তাদের শরীরের ওপর ক্ষমতা কায়েমের জন্য হিন্দুত্ববাদী পুরুষরা ঠিক করে সুল্লি বুল্লি ডিল। কেউ ওয়েবসাইট বানায়, কেউ হিংসার ভাষাকে শব্দে ও ছবিতে সাজায়। পরিকল্পিত ও সংগঠিতভাবে আমন্ত্রণ জানায় যৌন-হিংসার। মণিপুরে মহিলাদের গণ-ধর্ষণ ও নগ্ন প্যারাড করানোয় সঙ্গত দেয় পুলিশ ও প্রশাসন। সমকামী হওয়ার ‘দোষ’ কাটাতে পরিবারের সদস্যরা সংগঠিত করে ধর্ষণ। ভারতের রাষ্ট্র আর আইনি ব্যবস্থা আজও বিয়ের অধিকার হিসেবে ধর্ষণকে ছাড় দেয়। বছরের পর বছর বয়েজ লকার রুমে স্কুল-কলেজের সহপাঠীনিদের ব্যক্তিগত ছবি সংগ্রহ করে অভিজাত পুরুষরা। গণ-ধর্ষণ করার উপায় নিয়ে চলে মশকরা। ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী যুব আইকন ইউটিবার-সমর রায়না থেকে ক্যারি মিনাতি ওরফে অজয় নাগর যাদের ইউটিউব চ্যানেলে চূড়ান্ত নারী-বিদ্বেষী পিতৃতান্ত্রিক বার্তায় ভর্তি ভিডিও মনোরঞ্জনের নামে প্রত্যেক দিন গড়ে ২-৩ কোটি মানুষ দেখেন। ‘কবীর সিং’ থেকে ‘অ্যানিম্যাল’-এর মতো ভারতীয় চলচিত্র ৩০০-৭০০ কোটি টাকা লাভ করে বক্স অফিসে। মেয়েদের শারীরিক মানসিক নিগ্রহ করা হোক বা আদর্শ পুরুষ হিসাবে হিংস্র অনুভূতিহীন পুরুষত্বের দৃশ্যে হাততালিতে ফেটে পড়ে প্রেক্ষাগৃহ।
একুশ শতকে ঘটে চলা নিদর্শনগুলি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে ধর্ষণ বা যৌন-হেনস্তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অপরাধী বিরল মানুষ নয়। ঘটনা বিশেষে ধর্ষক এক বা একাধিক ব্যক্তি হতে পারে। কিন্তু ধর্ষণ সবক্ষেত্রেই সংগঠিত অপরাধ। কিন্তু ধর্ষণ আর ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখায়, সংগঠিত চেহারা লুকিয়ে রাখায় লাভ কার? লাভ তাদেরই যারা সমাজে লিঙ্গ-জাতি-শ্রেণি-ধর্ম ভিত্তিক বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে চায়, নিজেদের মসনদ সুরক্ষিত করতে। ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চোখ সরিয়ে দিতে চায় কাঠামোগত ব্যর্থতা থেকে। প্রশ্ন হল, আমরা কি সমাজ জুড়ে চলা ধর্ষণ-সংস্কৃতির সংগঠিত চক্রগুলি শনাক্ত করার আলোচনায় আগ্রহী? আমরা কি সংগঠিত অপরাধের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ায় আগ্রহী?