‘রোববার’ পেতে এখন খাটাখাটনি বিশেষ নেই, এই যে ফোনে, খুটখুট করে এই ভররাত্তিরে তোমাকে এই চিঠিখানি লিখছি, সেই ফোনে রোববার.ইন ইংরেজিতে লিখলেই শান্তি। যে কোনও সময়। আর কী চাই বলো?
দু’দণ্ড বনলতা,
সকলেই রবি নয়। কেউ কেউ রবি; রবি– মানে ‘রোববার’। আর; রোববার– মানেই তুমি। দু’-দণ্ডের শান্তি– নক্ষত্রের বিশুদ্ধতা– পবিত্র শিশির– সবুজ শাখার গন্ধ– অন্তরের অবসর– স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল– গভীরতর বিরতিদিন। পাতার মতো ক্ষয়ে; খসে যাওয়ার আগে উত্তরের বাতাসে, তোমার ঘ্রাণ মৃতসঞ্জীবনী।
এত এত কাল ধরে মানুষ ও মনীষী শুধুই উচ্ছৃঙ্খল কোলাহল করল এই ভেবে যে– তুমি কে! আর ওই দু’-দণ্ডের পরিভাষাহীন সময়ে কী ঘটেছিল! তোমার মুখখানা কেমন, আর পিছন থেকেই বা কীরকম লাগে তোমাকে! সত্যজিৎ রায় যে প্রচ্ছদ আঁকলেন, সেখানে তোমাকে দেখালেন একেবারে রাজকুমারী অমৃতা কৌর। আমার অপছন্দই হল। তারও আগে অবশ্য, শম্ভু সাহা– বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার, রবীন্দ্রনাথ; বিশ্বভারতী; শান্তিনিকেতনের ছবি তুলেছেন, তিনি এঁকেছিলেন তোমাকে পিছন থেকে;– একখানা খোঁপা লাগিয়ে। কেউ কেউ হৃদয় আকাঙ্ক্ষা তৃপ্তির বশে; তোমাকে সুচিত্রা সেনও ঠাওরে নিয়েছিল। পদবীর মিল বলে?
তুমি কীরকম দেখতে– তার চে’ বড় কথা, তুমি কী? তোমার অস্তিত্বখানা কীরকম? এই মহাপৃথিবীতে সকলেরই একটু শ্রান্তি লাগে। ক্লান্ত প্রাণের দরকার পড়ে শান্ত ছায়া। দরকার পড়ে অন্ধকারে জলপায়রার ডাক। শালবন থেকে হরিতকীবনে খেলুক এ জীবনের যত ইচ্ছের ঢেউ। নইলে কারই বা হাত দুটো ধরে ভুলে যাব পৃথিবীর ক্ষতি? কাকেই বা জিজ্ঞেস করব: ‘তোমার নক্ষত্র ছেড়ে কেন তুমি আমাদের মাঝখানে এই পৃথিবীতে চলে এলে?’
হাজার বছর ধরে এই আমার হাঁটা, এ কি বাংলা ভাষারও হাঁটা নয়? বনলতা, আমি তো একরকম বাংলা ভাষাই। তোমার কি মনে পড়ে না চর্যাপদের কথা? ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোঁহা’– এই নামেই তো প্রকাশিত হয়েছিল তা। অর্থাৎ, বাংলা ভাষার বয়স হাজার বছর, আর তোমার কাছে এসে নিভৃতি পেয়েছিল সেই ভাষা। মানে, একটা বিরতিদিনের কাছে। সত্যিকারের রোববারের কাছে।
এতদিন তোমাকে বলা হয়নি, আমার সুকতলা একেবারে ক্ষয়ে গিয়েছিল। এত হাঁটলে কারই বা জুতো অক্ষয় থাকে? কিন্তু মূল উদ্দেশ্য– ওই দারুচিনির দ্বীপে পৌঁছনো। যেখানে তুমি আছো, তুমি আমার নিজস্ব একখানা রোববার হয়ে আছ। যাকে পাওয়ার পর বিস্ময়ে; সমুদ্রের মতো ঢের ক্ষুধা নিয়ে জিজ্ঞেস করব– এতদিন কোথায় ছিলেন?
তোমাকে জানাই, এখন আমার নতুন কেনা জুতোর হাল কোনওভাবেই আর বিগড়োবে না। সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে, মালয় সাগর কিংবা বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগৎ– পথে পথে হাপিত্যেশ করার কিছু নেই। ‘রোববার’ পেতে এখন খাটাখাটনি বিশেষ নেই, এই যে ফোনে, খুটখুট করে এই ভররাত্তিরে তোমাকে এই চিঠিখানি লিখছি, সেই ফোনে রোববার.ইন ইংরেজিতে লিখলেই শান্তি। যে কোনও সময়। আর কী চাই বলো? দু’-দণ্ড শান্তি দেবে আলতো একটা ক্লিক। বহু শঙ্খচিলের মতো কলাম– দূরাভিসারী ঘাসফড়িংয়ের মতো সব ফিচার– দেয়ালি-পোকার মতো বিশ্লেষণ। সঙ্গে ছবি; কার্টুন; কমিকস! মাথার মধ্যে বোধ কাজ করে, এমন লেখাপত্তরও। পাণ্ডুলিপি ধূসর হওয়ার আগেই ডিজিটালে ছাপা হবে–উইপোকায় গিলে খাবে না, পোড়ানোও যাবে না– ভাবো!
জীবনের লেনদেনে যে শ্বাস নেওয়ার দরকার হয় রোজ; সেই সমুদ্র সফেনে– একটুখানি কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ রোববার.ইন।
আর একটা কথা লিখেই শেষ করছি। এখন মনে হচ্ছে; সে-কথাটাই বড় জরুরি। তুমি আমাকে শান্তি দিয়েছিলে বটে, কিন্তু তোমার শান্তি? তুমিও কি আমাকে পেয়ে শান্ত হতে পেরেছিলে? বনলতা সেনেরও আছে কি একজন জীবনানন্দ দাশ? ঘাসের ওপর শুয়ে জীবনের স্বাদ নিতে পেরেছিলে? অই আকাশের শীতে একা একা জেগে থাকোনি তো তুমি? পুকুরের কিনারে ঘুম-ভাঙা জলপিপির সঙ্গে দেখা হয়েছে তো তোমার?
আঁকাবাঁকা আঙুলের দ্রুত অন্ধকার দিয়ে এ প্রশ্ন করতে বড় দেরি হয়ে গেল বটে; আমি ক্ষমাপ্রার্থী– কিন্তু সুখবর এই যে, রোববার.ইন শুরু হল। এই আমাদের নতুন দারুচিনি দ্বীপ। মুখোমুখি বসিবার নতুন মহাপৃথিবী।
ইতি
জীবনানন্দ দাশ
সেই কালো ট্রাঙ্কের ভিতর পড়ে থাকা চিঠিখানি হাতে পেলেন সম্বিত বসু।