কানাডা জি-৭ ও ন্যাটো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তবুও আমেরিকা বা ব্রিটেন প্রকাশ্যে কানাডার পক্ষে সওয়াল করতে না নামায় স্পষ্ট ভারতের এই কড়া অবস্থান কতটা প্রয়োজনীয় ছিল। এখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম দাবি করছে, জি-২০ সম্মেলনে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নাকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। গোয়েন্দা তথ্যের কথাও নাকি জানিয়েছিলেন। যদিও দু’দেশের যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি জায়গা পায়নি।
দিল্লির থেকে অটোয়ার দূরত্ব কত? অধিকাংশ ভারতবাসী আন্দাজেও এর উত্তর দিতে পারবেন না। পাকিস্তান আর চিন– এই দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে সংঘাতে আমরা অভ্যস্ত। সীমান্তে খিটিমিটি সবসময় লেগেই রয়েছে। কিন্তু কানাডার মতো এত দূরের একটি দেশের সঙ্গে যে লড়াইয়ের একটা ফ্রন্ট খুলে যাবে, তা অনুমেয় ছিল না। পরিস্থিতি যা, তাতে অটোয়া যদি লাহোর বা করাচির দূরত্বে থাকত, তাহলে ইতিমধ্যেই দু’পক্ষের মধ্যে কয়েকদফা শেলিং হয়ে যেত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা বলছেন, জাস্টিন ট্রুডোর দেশকে ভারত যে ভাষায় জবাব দিয়েছে, তা কখনও চিরশত্রু পাকিস্তানকেও বলতে হয়নি। পাকিস্তান যে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ ঘাঁটি, তা ভারত হামেশাই বলে থাকে। বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী কানাডার ক্ষেত্রে আরও একটি বিশেষণ যোগ করে জানিয়েছেন, ট্রুডোর দেশ জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদ ও সংগঠিত অপরাধের নিরাপদ ঘাঁটি হয়ে উঠেছে।
খলিস্তানি সন্ত্রাসবাদের আঁতুড় যে সুদূর কানাডাই, সেকথা বললে অত্যুক্তি হয় না। জাস্টিন ট্রুডোর বাবা পিয়ারকে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, চার পুলিশকর্মীকে খুন করে কানাডায় পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি তালবিন্দর সিং পারমারকে ভারতের হাতে তুলে দিতে। কানাডা রাজি হয়নি। সেই তালবিন্দরই কণিষ্ক বিমান বিস্ফোরণের মূল চক্রী হয়ে ওঠে। ১৯৮৫ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের উপর যখন পেটভর্তি যাত্রী নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার জাম্বো জেট কণিষ্ক বিস্ফোরণে উড়ে যায়, তখনও পর্যন্ত বিশ্ব এতবড় সন্ত্রাসবাদী হামলা দেখেনি।
যে হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাস্টিন ট্রুডোর এত মাথাব্যথা, তাকে তো ভারতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ ২০২০ সালেই জঙ্গি ঘোষণা করে ‘ইউএপিএ’ ধারায় মামলা করেছে। ‘খলিস্তানি টাইগার ফোর্স’-এর প্রধান হরদীপ ১৯৯৭ সাল থেকে কানাডায় বসে প্রকাশ্যে ভারত বিরোধী কার্যকলাপ চালাচ্ছিল। কানাডাকে দেওয়া এনআইএ-এর ডসিয়ারে রয়েছে ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর প্রধান গুরপতওয়ান্ট সিং পান্নুনের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের কথা। পান্নুন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের টাকায় কানাডায় বসে নিয়মিত কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার ছক কষে। চণ্ডিগড়ে পান্নুনের প্রাসাদোপম বাড়ি কয়েকদিন আগে এনআইএ বাজেয়াপ্ত করেছে। ট্রুডোর সরকার ভারতের দেওয়া ডসিয়ের পেয়েও এই খলিস্তানপন্থী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে না স্রেফ ভোটের অঙ্কে। অটোয়া, টরন্টো, ভ্যানক্যুভারের রাস্তায় ভারত ভাঙার স্লোগান দিয়ে পান্নুনরা মিছিল করে চলেছে, অথচ বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ট্রুডোর লিবারেল পার্টি ভারতের বারংবার অনুরোধের পরেও কোনও ব্যবস্থা নেয় না। অটোয়ার মসনদ বাঁচাতে নাকি ট্রুডোর কাছে পান্নুনের সমর্থন জরুরি।
এ মাসের গোড়ায় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি এসে ট্রুডো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ করার ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন। সম্মেলনের নৈশভোজে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। হোটেলের প্রেসিডেন্সি স্যুটে থাকতে অস্বীকার করেছিলেন। তবুও ভারত আশঙ্কা করেনি যে তিনি দেশে ফিরে এক সপ্তাহের মধ্যে কানাডার সংসদে এত বড় বোমাটি ফাটাবেন। ভ্যানক্যুভারের গুরুদ্বারের সামনে ১৯ জুন রাতে খুন হয়েছে হরদীপ সিং নিজ্জর। মুখোশধারী দুই দুষ্কৃতী তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। ঠিক তিনমাস বাদে ১৮ সেপ্টেম্বর কানাডার হাউজ অফ কমন্সে ট্রুডো অভিযোগ করলেন, তাঁদের তদন্তকারী সংস্থা বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ করছে যে, হরদীপের হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় এজেন্সির হাত রয়েছে। শুধু তাই নয়, ট্রুডো সরকার একইসঙ্গে ‘র’-এর কর্তা তকমা দিয়ে বহিষ্কার করল ভারতীয় হাই কমিশনের এক প্রবীণ কূটনীতিককে। কূটনীতির ক্ষেত্রে এটি হল একটি চরম পদক্ষেপ। ভারতের প্রত্যুত্তরও তাই চরম হয়েছে।
কানাডা জি-৭ ও ন্যাটো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তবুও আমেরিকা বা ব্রিটেন প্রকাশ্যে কানাডার পক্ষে সওয়াল করতে না নামায় স্পষ্ট ভারতের এই কড়া অবস্থান কতটা প্রয়োজনীয় ছিল। এখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম দাবি করছে, জি-২০ সম্মেলনে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নাকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। গোয়েন্দা তথ্যের কথাও নাকি জানিয়েছিলেন। যদিও দু’দেশের যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি জায়গা পায়নি। ভারতের অভিযোগ, ট্রুডো কীভাবে প্রমাণ ছাড়া নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতের দিকে আঙুল তুলছেন। কীভাবে তিনি তাঁর দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’। ভারত পাল্টা কানাডার এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। কানাডার নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করেছে। দিল্লির হাই কমিশনে লোক কমাতে বলেছে। বিদেশে বসে যেসব ভারতীয় খলিস্তানের হয়ে প্রচার ও কার্যকলাপ চালাচ্ছে দেশে, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও তাদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে।
চাপে কিছুটা সুর নরম করছে কানাডা। সেদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিল ব্লেয়ার মন্তব্য করেছেন, তাঁদের কাছে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় তাঁদের রণনীতিতেও কোনও বদল ঘটছে না। আসলে চিনের মোকাবিলায় ভারতের সমর্থন জরুরি মার্কিন পক্ষভুক্ত দেশগুলির। দ্বিতীয়ত কানাডার বিদেশি ছাত্রদের ৪০ শতাংশ ভারতীয়। এদের কাছ থেকে কানাডা প্রতিবছর যে টাকা পায়, তা ফেলনা নয়। কূটনৈতিক সংঘাত শুরুর পরেই ভারত কানাডায় থাকা ভারতীয় পড়ুয়াদের জাতিবিদ্বেষ নিয়ে সতর্ক করে অ্যাডভাইসরি দিয়েছে। এতেও ট্রুডোর রক্তচাপ বেড়েছে।
সব মিলিয়ে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে শেষ করার পর এই কানাডা সংকটেও এখনও পর্যন্ত ভারত তার কূটনৈতিক আধিপত্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে।