‘তিন কন্যা’-য় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে প্রথম স্বাধীন চিত্রগ্রাহক হিসাবে কাজ করলেন তরতাজা, দারুণ সুন্দর দেখতে ছেলেটি। ‘তিন কন্যা’-র তিনটি ছবির দৃশ্যকল্প তিনরকম। ‘পোস্টমাস্টার’-এর প্রেক্ষাপট গাছপালা, ঝুপড়ি জঙ্গলে ভরা। একে সাদা-কালো ছবি, তায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ঘোর সবুজ। সবুজ এমনিতে আলো শুষে নেয়, কালচে করে দেয় দৃশ্যপট, এই ছবিতে আবার এর ওপরে মেঘের ঘনঘটা, বৃষ্টি। এই কাজ করা মুখের কথা না। অবাক হয়ে দেখতে হয়, একবারের জন্যও আলোর সোর্স ধরা পড়ে না ছবিতে।
একটা গল্প শুনেছিলাম বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র কাছে। বার্লিন ফেস্টিভ্যালে সেইবার নিমন্ত্রিত ‘ইন্ডিয়ান নিউ ওয়েভ’-এর বেশ কিছু তরুণ পরিচালক, যাঁরা ক্রমে যথাযথ ভাবে ‘মাস্টার্স অফ ওয়ার্ল্ড সিনেমা’ হয়ে উঠবেন পরবর্তী সময়ে। উৎসবে সেই বছর মারকাটারি কাণ্ড, এসেছেন প্রবাদপ্রতিম সুইডিশ চিত্রগ্রাহক সেভন নিকভিস্ট। বার্গম্যান এবং তারকভস্কির বেশিরভাগ ছবির ক্যামেরাম্যান– একজন জলজ্যান্ত জিনিয়াস। বিশ্বের সব বড় পরিচালকের স্বপ্ন নিকভিস্ট-এর সঙ্গে কাজ করার। আমাদের তরুণ পরিচালকরাও কোনও এক সান্ধ্য আড্ডায় ঘিরে ধরলেন তাঁকে, কিছু বছর আগে তিনি শুট করেছেন অন্দ্রেই তারকভস্কির শেষ ছবি ‘স্যাক্রিফাইস’– যে ছবি আজও উজ্জ্বল এনিগমার মতো আমাদের কাছে। মালায়লি চিত্রপরিচালক এবং অসামান্য চিত্রগ্রাহক বা সিনেমাটোগ্রাফার সাজি করুণ, ‘পিরাভি’-র ডিরেক্টর, বললেন, ‘আমাদের দেশে যদি একজন নিকভিস্ট থাকতেন!’ নিকভিস্ট মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, ‘কেন তোমাদের তো মিট্রা আছে, রায় আছে…’
এই মিট্রা সুব্রত মিত্র, এই রায় সৌম্যেন্দু রায়। সুব্রত মিত্র ভারতীয় চলচ্চিত্র দুনিয়ায় একটি মিথ-এর মতো। সেই সুব্রত মিত্রর প্রধান সহযোগী সৌম্যেন্দু রায়। সিনেমা চিত্রায়নের মহীরুহ হয়ে উঠেছিলেন সৌম্যেন্দু রায় তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্লাসিকাল যুগের শেষ বটগাছটি মুড়োল আজ। চলে গেলেন সৌম্যেন্দু রায়। বয়স হয়েছিল বটে কিন্তু এই বছর দশ-বারো আগেও তাঁকে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যেত শর্টস আর স্নিকার্স পরে পাক দিচ্ছেন লেকে। বছর পনেরো আগে এই ছবি ছিল বাঁধাধরা। সিনেমার কারিগরদের ফিট থাকতেই হয় আর সৌম্যেন্দু রায়-এর ফিটনেস ছিল রীতিমতো ভড়কে দেওয়ার মতো। আশি বছর বয়সে অনায়াসে টক করে উঠে বসতেন ষাট ফিট ক্রেনে, শট নিতেন। দীর্ঘ ক্যামেরার ওয়ার্কশপে খুব কমই বসতে দেখা যেত তাঁকে। প্রখর স্মৃতিশক্তি ছিল তাঁর, যাকে বলা যায় ফোটোগ্রাফিক মেমোরি। একবার কারও নাম শুনলে ভুলতেন না। তাঁর চলে যাওয়া, সে যে বয়সেই হোক না কেন, মন খারাপের। এই মানুষগুলি বিশ্বের দরবারে গর্বিত করেছে আমাদের। এই মানুষগুলি আমাদের বড় হওয়া, আমাদের মাথা তুলে তাকিয়ে দেখা আর কুর্নিশ জানানোর মানুষ। ক’জনই বা আছেন এমন আর। আজ হঠাৎ বিকেলের এক্সপোজার কমে গেলে, বুঝতে হবে কারণ রয়েছে।
‘তিন কন্যা’-য় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে প্রথম স্বাধীন চিত্রগ্রাহক হিসাবে কাজ করলেন তরতাজা, দারুণ সুন্দর দেখতে ছেলেটি। ‘তিন কন্যা’র কাজ ছিল বেশ কঠিন, প্রথম কাজ হিসাবে যে কোনও সিনেমাচিত্রীর কাছেই ভয়ানক চ্যালেঞ্জ। ‘তিন কন্যা’-র তিনটি ছবির দৃশ্যকল্প তিনরকম। ‘পোস্টমাস্টার’-এর প্রেক্ষাপট গাছপালা, ঝুপড়ি জঙ্গলে ভরা। একে সাদা-কালো ছবি, তায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ঘোর সবুজ। সবুজ এমনিতে আলো শুষে নেয়, কালচে করে দেয় দৃশ্যপট, এই ছবিতে আবার এর ওপরে মেঘের ঘনঘটা, বৃষ্টি। এই কাজ করা মুখের কথা না। অবাক হয়ে দেখতে হয়, একবারের জন্যও আলোর সোর্স ধরা পড়ে না ছবিতে, স্বাভাবিক আলোর ক্ষেত্রে এমন পাকা এক্সপোজার যে, প্রত্যেকটি এলিমেন্ট-এর সেপারেশন সুস্পষ্ট, ওই মেঘ আর বনবাদাড়েও টানটান ডেপ্থ অফ ফিল্ড। ‘মণিহারা’ আবার ক্লাসিক নয়ের ফিল্ম। কাট লাইট, কড়া কনট্রাস্ট, আলো-ছায়ার খেলা– পুরনো রাজকীয় অট্টালিকা, কোনও মিলই নেই আগের ছবির সঙ্গে। বড় পর্দায় প্রিন্ট প্রোজেকশনে যাঁরা এ ছবি দেখেছেন, তাঁরা জানেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নয়ের ছবির একটি হতে পারে এই ক্যামেরার কাজ। আর ‘সমাপ্তি’– সমাপ্তির চিত্রায়ন কারিগরি দক্ষতার বিচার ছাড়িয়ে মায়াময় এক দৃশ্যভাষার জন্য সবচেয়ে প্রিয় আমার। লো এঙ্গেল, ক্লোজ শটস আর পূর্ণিমার রাতে মৃন্ময়ীর (অপর্ণা সেন) সেই পালিয়ে যাওয়া, নদীর পাড়ে সারা বছর পড়ে থাকা দোতলা রথ ঘিরে ছুটে বেড়ান, গাছের ডালে বাঁধা দোলনায় দোল খাওয়া এমন দামাল আর অপার্থিব এক কবিতার সৃষ্টি করে, যা একবার দেখলে আরও একহাজার বার দেখা যায় শুধুমাত্র চোখ বন্ধ করলেই।
প্রথম ছবিতেই মাত করে দিলেন সৌম্যেন্দু। নিঃসন্দেহে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বচলচ্চিত্রের আঙিনায়, গুরুর নামের সঙ্গেই উচ্চারিত হল সৌম্যেন্দুর নাম খোদ নিকভিস্ট-এর মুখে। যদিও স্বাধীন চিত্রগ্রাহক হিসাবে সুব্রত মিত্র এবং সৌম্যেন্দু রায় নাকি ছিলেন বিপরীত মেরুর। সুব্রত নাকি তাঁর শটের ব্যাপারে ছিলেন খুবই স্বাধীনচেতা, তাঁর নিজের মতামত অনুযায়ী শট নিতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি, যে কারণে মাঝে মাঝে পরিচালকের সঙ্গে সামান্য খিটিমিটি লেগে যাওয়া অস্বাভিক না, আর সৌম্যেন্দু ছিলেন ‘ডিরেক্টর-এর ক্যামেরাম্যান’। সৌম্যেন্দু পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝে নিতেন পরিচালক কাছে– কী শট পরিচালক চাইছেন, কীভাবে চাইছেন, কী লেন্স এবং কীরকম ক্যামেরা ম্যুভমেন্ট চাইছেন– তারপর একটি অনবদ্য ঝকঝকে ব্লু প্রিন্ট বানাতেন সেই কনসেপ্টটির। নিছক একটি আলোর ডিজাইন তৈরি করতেন। নির্ভুল প্রয়োগ করতেন সেই ব্লু-প্রিন্টের। অতএব তেমন ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করলে, সেই ছবি যে একটি কালজয়ী ছবি হয়ে উঠবে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে। নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর একটি ফাটাফাটি যুগলবন্দি ছিল। দু’জনের কাজের ধরন এক, দু’জনের কাজই নিয়মানুবর্তিতায় বাঁধা। শুনেছি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার শুটিং হত প্রায় নিঃশব্দে, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ইউনিটে, মানে আমাদের কাজও তেমন। কোনও চিৎকার, চেঁচামেচি, মুখ খারাপ করার বালাই নেই, দরকারই হত না এসবের। এটা তখনই সম্ভব, যখন পরিচালক আর চিত্রগ্রাহকের তালমিল খাপে খাপ বসে যায়, যে যাঁর নিজের টিমকে ইন্সট্রাকশন দিয়ে দেন, কাজ এগোতে থাকে তরতর করে, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়া। বুদ্ধদেবের ‘চরাচর’ আর তপন সিন্হার ‘হুইল চেয়ার’ সৌম্যেন্দু রায়ের শেষক’টি ছবির মধ্যে দু’টি। এর মধ্যে বলা বাহুল্য, বহু কাল্ট ছবির ক্যামেরা করেছেন তিনি, সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর সমবেত কাজ তো প্রায় সবক’টিই প্রবাদসম, তাছাড়াও আছে অনবদ্য সাদা-কালো চিত্রায়ন তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’-তে, হালেই সে ছবির ডিজিটাল কারেকশন করা একটি প্রিন্ট বেরিয়েছে, আছে একদম অন্যরকম দৃশ্যকল্পে তপন সিন্হার ‘এক ডক্টর কি মউত’– এ ছবির আলোর বিন্যাস প্রায় সিন বই সিন স্টাডি করার মতো।
গল্প শুনেছি, ‘চরাচর’-এর শুটিংয়ে নাকি একটা খেলা চলত পরিচালক আর চিত্রীর মধ্যে– খালি চোখে এক্সপোজার বলার খেলা। মনে করা যাক, দু’টি চরিত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একটু এগিয়ে পিছিয়ে, গোধূলির আলো, খালি চোখে কার মুখে কত এক্সপোজার বলতেন ওরা, সামান্য পয়েন্টের তারতম্য সমেত। তারপরেই মিটার দিয়ে মাপা হত আলো আর বলা বাহুল্য প্রায় সবসময়েই একশো শতাংশ মিলে যেত তা। কে এই খেলায় জিততেন, তা অবশ্য খোলসা করে বলেননি পরিচালকবাবু। তবে এটা সবসময় বলতেন, ভোরে ওঠা নিয়ে খুব গর্ব ছিল আমার, রায় সাহেব সে গর্বে জল ঢেলে দিতেন। যত ভোরই হোক না কেন, লবিতে এসে দেখতাম টিপটপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যেমন স্মার্ট তেমন ডিগনিফাইড অথচ মাটির মানুষ।
রায়, রায়সাহেব, দাদা, আমার বাবার কালুমামা। মাথায় হাত রেখে প্রচ্ছন্ন গর্ব নিয়ে বলতেন ‘আমার নাতনি’! আজ মনখারাপের দিন বটে। বেশ কথা চলত কালুমামার বিয়ে নিয়ে। কেন যে বিয়ে করলেন না, কার প্রেমে, কোন ভালবাসায়– তা নিয়ে চর্চার শেষ নেই; একা একা থাকা যায় নাকি! আরে, যাঁরা একবার সিনেমাকে ভালোবেসে ফেলেন, তাঁরা তো আজন্ম একা, আবার কখনওই একা নয়, তাই নয় কি? এক আলোকবর্তিকা থেকে আরেক আলোকবর্তিকায় চললেন রায় সাহেব, যেখানে হয়তো আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি। যাত্রা পূর্ণতা পাক। হ্যাঁ যাত্রাই, মিথ-দের কি মৃত্যু হয়!