মহম্মদ আখলাখ থেকে দানিশ আলি পর্যন্ত– সমস্ত ঘটনাই, যা আমাদের প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়, সেগুলোকে ক্রমশ আমরা তথ্য কিংবা বাসি খবরে বদলে নিতে পেরেছি। যদি প্রশ্ন করা হয়, দক্ষিণপন্থীরা তাদের কাজ করেছে, আমরা প্রত্যেকে তার বিপ্রতীপে দাঁড়াতে গিয়ে ঠিক কী করে উঠতে পেরেছি? তখনই সংকট বাড়ে।
বিবেক দংশন! যেন মেঘাচ্ছন্ন ঘন আঁধার দিনের একফালি আলোর মতোই ভারতবাসীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা কথাটার। তাও শীর্ষ আদালতের দৌলতে। ঘটনা আমাদের অজানা নয়। উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরে জনৈক শিক্ষিকার নির্দেশেই সংখ্যালঘু সহপাঠীকে হেনস্তা করে এক পড়ুয়া। এই ছিল শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতি। ঘটনা জানাজানি হতেই ঢি ঢি পড়ে। সেই সংক্রান্ত মামলাতেই যোগীর রাজ্য যেভাবে ঘটনাটিকে উপস্থাপিত করেছে, বিশেষত যেভাবে তদন্ত এগিয়েছে, তাতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ আদালত। নিগৃহীত পড়ুয়ার বাবা স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, তাঁর ছেলে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বলেই তাকে হেনস্তা করা হয়েছে। পুলিশের এফআইআর-এ অবশ্য সে কথাটির উল্লেখ ছিল না। ঘটনাটিতে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার রং লাগানো হয়েছে, তা খানিক বাড়াবাড়ি বলেই দেখানোর চেষ্টা করেছিল যোগীরাজ্য। তাতে অবশ্য চিড়ে ভেজেনি। বিচারপতি অভয় এস ওকা ও বিচারপতি পঙ্কজ মিঠালের বেঞ্চ সাফ জানিয়েছে, ঘটনার ভিডিয়ো-র ট্রান্সস্ক্রিপ্টেই তো এর উল্লেখ রয়েছে। যদি এ অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে তো রাজ্য সরকারের বিবেক দংশন হওয়া উচিত।
শীর্ষ আদালত তুলোধোনা করেছে যোগীরাজ্যকেই। বিজেপি বা আরএসএস-এর রাজনৈতিক দর্শনের বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁদের এতে উল্লসিত হওয়ারই কথা। তবে সেই উল্লাসের ভিতর অনেকখানি ভাবের ঘরে চুরিও আছে বটে। কথাটা হল, এই যে বিবেক দংশন, সে কি কোনও একটি রাজ্যের সরকারের প্রাপ্য! ঘটনার নিরিখে তা যোগীরাজ্যের কপালেই জুটেছে বটে; তবে সংখ্যালঘুকে নিগ্রহের মানসিকতা যে গভীর অসুখ হয়েই এখন এই দেশটার শোণিতপ্রবাহে মিশে গিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের এই দেশটায় একজন সংখ্যালঘু গত এক দশকে ঠিক কীভাবে বেঁচে আছেন? কেউ কেউ বাদে প্রায় সকলেই, বলা যায় গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষই আর এ-প্রশ্নের ছায়া মাড়াতে রাজি নন। ঠিক যেভাবে যোগীরাজ্যের সরকারি আইনজীবী ঘটনার সাম্প্রদায়িক দিকটি মুছে দিতে চাইছিলেন, তাঁরাও তাঁদের নিয়ত ব্যবহারেও ক্রমশ এই প্রশ্নটিকেই মুছে দিতে চাইছেন। বলা ভালো, এই প্রশ্ন থেকে প্রাণপণে পালাচ্ছেন সকলেই। কেননা আজ যদি এই প্রশ্নের তীক্ষ্ণতা সকলের অন্তরকে বিদ্ধ করে, তবে সেই নিরিখে একটা উত্তর দেওয়ার দায়ও এসে বর্তায়। এই যাদের থেকে থেকেই ‘সংখ্যালঘু’ বলে সম্বোধন করে, তাঁরা আসলে কারা? তাঁরা কি এই দেশেরই একজন নাগরিক নন! সম্প্রদায়গত ভিন্নতা ছাড়া একজন সাধারণ নাগরিক ঠিক যা যা করে থাকেন দেশের জন্য, দশের জন্য, তাঁরা কি তা করেন না! প্রশ্নগুলো তেমন কঠিন নয়, আর উত্তরও আমাদের জানা। তবে সেই সব কিছুর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বিপন্নতার এক পুরু চাদর। অর্থনৈতিক অসাম্যের থেকেও সাংস্কৃতিক বিপন্নতা ভয় ধরিয়েছে বেশি। এই বুঝি সব গেল গেল ভাব! অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন যে প্রবণতাকে চিহ্নিত করছেন ‘manufactured sense of Hindu Victimhood’ বলে, তাই-ই আসলে ‘religious/cultural majoritarianism’ -এর জ্বালানি জোগাচ্ছে দক্ষিণপন্থী দলগুলিকে। সন্দেহ নেই, এই আদর্শে দীক্ষিত দল তার পূর্ণ সদ্বব্যবহার করছে। তাই আমরা সাক্ষী থাকি এমন দৃশ্যের, যেখানে খোদ সংসদে দাঁড়িয়ে সাংসদ রমেশ বিধুরি তাঁর সহকর্মী কুঁয়র দানিশ আলিকে ধর্ম তুলে কটূক্তি করতে পারেন। বিজেপি অবশ্য তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ধরিয়েছে। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি আলাদা করে সাংসদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। তবে ঘটনা এই যে, সংসদে এরকম ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক মন্তব্য পর্যন্ত আমরা পৌঁছেই গিয়েছি। গুরগাঁও থেকে যে দলে দলে অভিবাসী সংখ্যালঘু শ্রমিককে হুমকির মুখে পড়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে, তা হয় বহুজনের অগোচরে থেকেছে, নয় নেহাত একটা খবর হয়ে উঠেছে।
বলতে গেলে সেই মহম্মদ আখলাখ থেকে দানিশ আলি পর্যন্ত– সমস্ত ঘটনাই, যা আমাদের প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়, সেগুলোকে ক্রমশ আমরা তথ্য কিংবা বাসি খবরে বদলে নিতে পেরেছি। যদি প্রশ্ন করা হয়, দক্ষিণপন্থীরা তাদের কাজ করেছে, আমরা প্রত্যেকে তার বিপ্রতীপে দাঁড়াতে গিয়ে ঠিক কী করে উঠতে পেরেছি? তখনই সংকট বাড়ে। নিগ্রহের ধারাবাহিকতা যে ক্রমে একটা সাধারণ মানসিকতায় রূপান্তরিত হয়েছে, তা আমাদের চোখের সামনেই, এমনকী উদাসীনতাতেও, তা স্বীকার করতে দ্বিধা হলেও সত্যি। এরকম সিদ্ধান্ত টানায় হয়তো আপত্তি উঠতে পারে। বলা যেতে পারে, বহুসংখ্যক মানুষ তো সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। প্রতিদিন প্রতিটি বিষয়েই তাঁদের সমর্থন বা বিরুদ্ধতা জানান দিচ্ছেন। তবে সেটুকু যে যথেষ্ট নয়, তা-ও তো আজ বেশ স্পষ্ট। ফলে গল্পটা বস্তুত অনেকখানি হয়ে উঠছে উটপাখি এবং বালির। যা ঘটছে তা আমরা দেখেও দেখছি না কিংবা দেখতে চাইছিও না। বিরুদ্ধতার আন্দোলনের চলতি ফর্মের বাইরে আর কোন পথে তা সদর্থক কোনও পরিবর্তন-প্রয়াসী হয়ে উঠতে পারে, তা নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। ফলে ঘটনা শুধু ঘটছেই না, তা একটা সাধারণ মাত্রা পাচ্ছে। যোগীরাজ্যের সরকারি আইনজীবী যে সাম্প্রদায়িক দিকটি আড়াল করতে চাইছিলেন, এই প্রেক্ষিতে তার একটা অন্য অর্থও বেরিয়ে আসে। আসলে বোধহয় সংখ্যালঘু নিগ্রহকে আর সাম্প্রদায়িক হিসাবে দেখতেই রাজি নয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। ফলে কেবলই খবরের জন্ম হয়। ঘটনা খবর হয়ে আসে, হারিয়েও যায়। ভারতবাসীর অর্জনে এমন কোনও বিশল্যকরণী আসে না, যা হতদেহে করতে পারে প্রাণের সঞ্চার।
ঠিক এই অন্ধকারের ভিতর থেকেই শীর্ষ আদালত ভাসিয়ে দিল ‘বিবেক দংশন’ কথাখানা। যদিও একটি নির্দিষ্ট ঘটনা এবং একটি রাজ্যের প্রেক্ষিতে, তবু কথাটা সামগ্রিক ভাবে দেশবাসীকেই যেন আয়নার সামনে দাঁড় করাল। আইন-আদালত কি আর বিবেক জাগ্রত করতে পারে? যদি পারত, তাহলে হয়তো এতদিনে অপরাধের চিহ্নটুকুও থাকত না। তা হয় না। যা হয়, তা হল মানুষ হিসাবে আমাদের নিজেদের বিবেকটুকু জাগিয়ে রাখা। নিজেদের কাছে দাঁড়ানোর অভ্যাসটুকু বজায় রাখা। অন্যে কী করছে কিংবা করছে না, অমুক দল কত খারাপ– সে সমালোচনা আমরা করছি বিস্তর। যা করছি না, তা হচ্ছে এই আত্মসমালোচনাটুকুই। কেননা বিবেকের কাছে আমাদের আজ আর কোনও জবাবদিহির দায় নেই। ফলে দংশনও নেই। শুধু বহুযুগের ওপার থেকে কখনও কথাটা ভেসে এলে আমরা অনুভবে জানতে পারি, আমাদের সমস্ত নিরুচ্চার মেনে নেওয়ার ভিতর দিয়েই ‘বিবেক দংশন’ আজ আক্ষরিকই মেঘে ঢাকা তারা।