সৌম্যেন্দু রায় জানতেন, প্রযোজকের টাকা শিল্পের প্রকাশের কাজে ব্যবহার করতে হবে, নিজের বিলাসিতার জন্য নয়। এই কারণে জীবনের শুরুতেই জীবনের জন্য কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা বিলাসিতা, তা নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছিলেন রায় সাহেব। এর প্রাপ্তি, তিনি অমর হয়ে গেলেন তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে।
সৌম্যেন্দু রায় ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ আকাশের নক্ষত্রমালায় মিলিয়ে গেলেন। তিনি কোনও দিন আমাদের কাছে একজন নক্ষত্র-মানব হতে চাননি। স্বভাবের অনুচ্চকিত সুর চিরকাল তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি দৃশ্যপটে প্রকাশ পেয়েছে সাদা-কালোয় রঙিন-আলোয়। কিছু না পেয়ে বা সামান্য কিছু উপকরণে আমাদের মায়েরা যেমন খাবার থালায় নিত্যদিন ম্যাজিক করতে পারেন, ঠিক তেমন ম্যাজিকই দেখাতে পারতেন সৌম্যেন্দু রায়, তাঁর প্রতিটি সেলুলয়েড-ফ্রেমে ।
ওঁদের সময় মানুষের জীবন খুবই সহজ ও স্বচ্ছন্দ ছিল। যন্ত্রের ভীষণ দাপট তখন আজকের মতো এমন মহামারীর আকার ধারণ করেনি।
সিনেমা যন্ত্রনির্ভর একটা মাধ্যম। যা এদেশের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মাধ্যম নয়। সেই রকম একটা মাধ্যমকে এদেশের মাটিতে ওঁর গুরু সুব্রত মিত্রই প্রথম সফলভাবে ব্যবহার করলেন ক্যামেরার যান্ত্রিক চরিত্রকে আমাদের সহজিয়া মনের সঙ্গে, ভাবনার সঙ্গে এক করে দিয়ে। পর্দায় প্রচলিত সিনেমা দেখার অভ্যাসকে ধাক্কা দিল এক নতুন চিত্ররচনা! সহজভাবে দেখা, সহজ চোখে দেখা, জীবনটা যেমন ঠিক তেমনটাই তিনি তুলে ধরলেন এই গণমাধ্যমটাতে। আর তারপরে যা হয়েছিল, তা বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা! সুব্রত মিত্র সৃষ্ট ‘ডিফিউজ লাইটিং’! চলচ্চিত্র মাধ্যমে জীবনকে দেখার এক নতুন পাঠ, যা তখনও বিশ্বচলচ্চিত্রের আঙিনায় অজানা অদেখা এক দৃশ্যভাষ।
সুব্রত মিত্রর এই গুণমুগ্ধছাত্র সৌম্যেন্দু সেই দেখার দর্শন-মন্ত্রটি গুরুর থেকে শিখে নিলেন একটু একটু করে। আর সারাজীবন ধরে যত কাজ করলেন গুরুকে প্রতি মুহূর্ত স্মরণ করে। এবং তাঁর যে বিশ্বাসের জগৎ, ‘স্কুল রিয়ালিজম’, তাকে মেনে চললেন নিজের শিল্পীসত্তাকে বজায় রেখেই। সৌম্যেন্দু রায় জানতেন, প্রযোজকের টাকা শিল্পের প্রকাশের কাজে ব্যবহার করতে হবে, নিজের বিলাসিতার জন্য নয়। এই কারণে জীবনের শুরুতেই জীবনের জন্য কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা বিলাসিতা, তা নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছিলেন রায় সাহেব। এর প্রাপ্তি, তিনি অমর হয়ে গেলেন তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে তাঁর কাজগুলোকে দেখলেই সবটা বোঝা যাবে সহজ ভাবে। তিনিও তাই চাইতেন। তাঁর কাজ দেখুক সকলে এবং আপন বিচার বোধ দিয়েই সেই কাজের সমালোচনা করুক। তিনি কোনও দিন চাননি গুরুর আসনে বসতে। চেয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে চুটিয়ে সিনেমা নিয়ে আড্ডা দিতে। তাঁদের সঙ্গে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে ডানা মেলে উড়তে।
সৌম্যেন্দু রায় বলতেন, ‘শিল্পে চমক থাকবে মাংসে চিনি দেওয়ার মতো।’
‘আলোকচিত্রশিল্পী কখনওই বেআক্কেলে তবলিয়ার মতো গায়কের কণ্ঠ ছাপিয়ে তাঁর তবলার চাটির শব্দকে উপরে তুলে ধরবেন না। যদি এমনটা হয়, তাহলে তিনি কখনওই সেই কাজকে ভালোবাসতে কিংবা সেই কাজের আত্মাকে স্পর্শ করতে পারেননি। তিনি কেবল নিজের কাল্পনিক গরিমা প্রদর্শনে উৎসাহী। এখানেই প্রয়োজন একটা ইউনিটকে একটা পরিবার হয়ে ওঠা। কেউ কাউকে প্রমাণ করতে চাইবেন না আলাদা করে। সবার একটাই লক্ষ্য, সেটা হল ভালো সিনেমা নির্মাণ করা।’
‘গল্প’ কিংবা ‘না-গল্পের’ মেজাজই বলে দেবে তার চেহারা দেখতে কেমন হবে। আলো দিয়ে ছবি আঁকা হয় সেলুলয়েডের ওপর। আলোর স্থান নির্বাচন আলোর পরিমাণকে শিল্পীর আয়ত্তের মধ্যে আনতে সাহায্য করে । সিনেমার বাজেট কমে। এই বোধ তৈরি হয় আমাদের প্রকৃতিকে দেখার নিয়মিত অভ্যাসের মধ্য দিয়ে। তিনি প্রকৃতির পাঠশালায় পাঠ নিতে বলতেন প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে।
এই রকম কত কথা হয়েছে গত বাইশ-তেইশ বছর ধরে। সৌম্যেন্দু রায়, মানে আমার স্যর, আমার অভিভাবক, না— আমার এই বন্ধু মানুষটির সঙ্গে।
সিঙ্গুর আন্দোলন নিয়ে আমার একটি তথ্যচিত্র ‘সিঙ্গুর দর্পণ’দেখে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন এই মানুষটি । ২০০৭-এ তাঁকে নিয়ে ৭২ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করি এবং ওঁর সঙ্গে জুড়ে যাই আজীবনের জন্য! রূপকলা কেন্দ্রে তাঁর ক্যামেরার ক্লাস দেখার সুযোগ করে দেন তিনি। বিনে পয়সায়। এরপর সুব্রত মিত্র, বংশী চন্দ্রগুপ্তকে নিয়ে ছবি করতে আমাকে সাহস দেওয়া থেকে ওঁর সময়ের বহু টেকনিশিয়ান-আর্টিস্টদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া যাতে আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলে উৎসাহ পাই, শিখতে পারি এবং তাঁদের কথাও ক্যামেরায় ধরে রাখি। হ্যাঁ, এই কথা ধরে রাখা থেকেই আমার আর্কাইভ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখার শুরু।
এই বছর মে মাসের ৮ তারিখ জীবনস্মৃতি আর্কাইভের জন্মদিবস উপলক্ষে আলোকচিত্রশিল্পী সৌম্যেন্দু রায়ের জীবন ও সিনেমা-যাপন এবং বাংলা ও বাঙালির চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে ‘সৌম্যেন্দু-সিন্দুক’ শিরোনামে একটি সংগ্রহশালার শুভসূচনা করা হয়েছে আর্কাইভের একটি ঘর জুড়ে । এই সংগ্রহে আছে সৌম্যেন্দু রায়ের আলোকচিত্রে সমৃদ্ধ সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী প্রমুখ চিত্র পরিচালকের নির্মিত চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের কপি, শুটিংয়ের স্থিরচিত্র (ডিজিটাল কপি), শুটিং সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিষয়ের নোটবুক, পোস্টার, বুকলেট, সংবাদপত্র-কর্তিকা এবং চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বই ও পত্র-পত্রিকা। এছাড়া সৌম্যেন্দু রায়ের করা কাহিনিচিত্র, তথ্যচিত্র এবং টেলিভিশন চিত্রের ডিজিটাল কপিও থাকছে এই সংগ্রহে । ২০০৭ থেকে ২০১৩ মধ্যে আমার নেওয়া সৌম্যেন্দু রায়ের অডিও-ভিডিও সাক্ষাৎকার এবং তাঁর আলোকচিত্র প্রশিক্ষণেরও অডিও-ভিডিও সংগ্রহে সমৃদ্ধ এই সিন্দুক।
এছাড়া থাকছে বহু বাংলা সিনেমার চিত্রনাট্য, মূল পোস্টার, বুকলেট, শুটিংয়ের ছবি, লবিকার্ড, বিজ্ঞাপন, সিনেমা সংক্রান্তপত্র-পত্রিকা (দীপালী, রূপমঞ্চ, উল্টোরথ, সিনেমা জগৎ, আনন্দলোক, টেলিভিশন, চিত্রবীক্ষণ, চিত্রভাষ, চিত্রপট, চিত্রভাবনা, এক্ষণ ইত্যাদি), দেশ বিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রকাশিত বই, চিত্রনাট্য, ক্যাটালগ, ফোল্ডার, পোস্টার এবং সিনেমার ডিজিটাল কপি । চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, আলোকচিত্রশিল্পী, শিল্পনির্দেশক, শব্দগ্রাহক, সম্পাদক, সংগীত পরিচালক, কণ্ঠসংগীত শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে বই, পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা এবং বিভিন্নপত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাক্ষাৎকারের মূল এবং ডিজিটাল কপি । আর চলচ্চিত্রের নেপথ্য শিল্পীদের অডিও-ভিডিও সাক্ষাৎকারও থাকছে এই সিন্দুকে । সৌম্যেন্দু রায় (২০০৭), সুব্রত মিত্র (২০১০) এবং বংশী চন্দ্রগুপ্তকে (২০১২) নিয়ে আমার নির্মিত তথ্যচিত্র এবং সেই সংক্রান্ত গবেষণার নানা ছবি এবং তথ্য।
স্যর চাইতেন নতুন প্রজন্ম আমাদের অতীত ইতিহাসকে জানুক, চিনুক, বুঝুক এবং তারপর তাঁরা প্রশ্ন করুক বর্তমানকে। উৎসাহী সেই নতুনেরা যাতে এই কাজটা সহজে করতে পারে, সে কথা ভেবেই স্যর চেয়েছিলেন তাঁর এই কম-সিনেমা-বোঝা বন্ধুটি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসের নুড়ি-কাঁকড় সংগ্রহ করে রাখুক, যাতে ইতিহাসের পুনর্বোধন করতে চাওয়া সেইসব ঋত্বিকের চলার পথ সহজও সুন্দর হয় আগামীতে। আর তাঁরা যেন সহজে চিনে নিতে পারে এই গণমাধ্যমের বন্ধু, শত্রু এবং কোপন স্বার্থ গৃধ্নুদের।