সম্ভোগসুখ কেবল স্পর্শসুখী নয়। দৃশ্যমুখীও। তোমায় আমি কখনো পাব না। ছোঁয়া তো দূর পাবলিকলি তোমার দিকে চোখ তুলে তাকানোরও ক্ষমতা নেই আমার। তাই তোমায় আমি গোপনে দেখব। উঁকি দিয়ে দেখব, আড়াল থেকে দেখব, লুক্কায়িত ক্যামেরার চোখ দিয়ে নিংড়ে দেখব তোমায়। ইচ্ছেমতো জুম করে, পজ করে, বারবার রিপ্লে করে দেখব তোমায়। হোস্টেলের ঘর থেকে বাথরুম, শোয়ার ঘর থেকে পাঁচতলা মলের চেঞ্জিং রুম, এমনকী তোমার প্রেমিকের সাথে বুক করা এয়ার বিএনবি-র বিলাসঘরের প্রতিটি মুভমেন্টেও নজর রাখব আমি।
প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমোশ্রী দাস
লেফোরিক স্ত্রী-কে বললেন,
–শুনো হে নারী, এই গরীবগুর্বো প্রজাকুলের অন্নবিপর্যয়ের কারণে তোমার কিয়ন্মাত্র ভ্রূক্ষেপের কারণ বুঝি না।এ-ব্যাটারা সর্বদাই অভাবগ্রস্ত, শততই রাজকর মুকুবের কাঁদুনি গাইতে তৎপর। ইহাদের দাবি মানিলে অচিরেই রাজকার্য লাটে উঠিবে, রাজকোষ শূন্য হইবে। তদ্যপি, তুমি ইহাদের রাজকর লাঘবের দাবি লইয়া মরণপণ করিয়াছ দেখিয়া আমি যৎপরোনাস্তি হতাশ বোধ করিতেছি।
অ্যাদ্দূর বলে লেফোরিক থামলেন। পোষ্য সারমেয়দের প্রতি কয়েক টুকরো মাংস ছুড়ে দিয়ে তাদের ভক্ষণপদ্ধতি অবলোকনের অছিলায় খানিক সময় ক্রয় করে বুঝলেন প্রত্যুত্তরের আশা বৃথা। অতএব কালবিলম্ব না করে এক সুগভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–হে আমার নয় সন্তানের জননী গোডিভা, রাজকর এত সহজে মুকুব হইবার নয়। তদ্যপি তোমার কথা রাখিতে একটি উপায় করিতে পারি। তোমায় একটি পরীক্ষা দিতে হইবে। আমি মারসিয়া প্রদেশের আর্ল লেফোরিক এক্ষণে কথা দিচ্ছি যে, সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে প্রজাবাৎসল্যের পুরস্কারস্বরূপ তাহাদের রাজকরভার আমি লঘু করিব।
প্রজাস্বার্থে গোডিভা প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত ছিলেন; পরীক্ষা কোন ছার!
লেফোরিক বললেন,
–তুমি সম্পূর্ণ নগ্নদেহে অশ্বারোহে পূর্ণ শহর প্রদক্ষিণ করিয়া আইস।
লেফোরিক ভেবেছিলেন স্ত্রী জান দেবে তবু মান দেবে-না। ভুল ভেবেছিলেন। গোভিডা চ্যালেঞ্জ অ্যাক্সেপ্ট করলেন।
শরীরী লজ্জার কোরবানি দিয়ে তিনি নগ্ন হলেন।
প্রজাস্বার্থে উচ্চবংশীয় রাজরমণীর এমন ক্ষিপ্র, আবরণহীন পথজ দ্রোহর গৌরব গাঁথা, একাদশ শতকের গোড়ার সেইদিন থেকেই ক্ষিপ্রতর বেগে ছড়িয়ে পড়ল ইতিহাসের পাতা থেকে ডোমসডে পুস্তকে; লর্ড টেনিসনের কবিতা থেকে ইংল্যান্ডের বহুল মিউজয়াম ভাস্কর্যে, মুদ্রায়, পথস্মরণীতে।
আর সেদিনের সেই গৌরব মুহূর্তেই, উদযাপনের বিপরীতে শোকের ন্যায়, আহ্লাদের বিপরীতে হাহাকারের ন্যায় শব্দজন্ম নিল আরও একটি মানবপ্রবৃত্তি, ‘পিপিং টম’। ভবিষ্যতে যা পরিচিতি পাবে ‘ভয়্যারিজম’ নামে।
বস্তুত, অশ্বারোহে পথে নামার আগে গণ ইস্তাহার জারি করেছিলেন গোভিডা। রাজ্যবাসীকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর পথপ্রদক্ষিণের সময়টুকু খিড়কি দুয়ারে আগল দিয়ে ঘরে থাকতে। কিন্তু জান্তব পুরুষ-প্রবৃত্তি কবেই বা নারী শরীরের নিষেধাজ্ঞাকে সমীহ করেছে! লুব্ধ পুরুষের নগ্ন নারীশরীরভাবনায় তাই ফুৎকারে উড়ে যায় রাষ্ট্রানুশাসনের ঢক্কানিনাদ থেকে প্রজা কল্যাণকর আয়োজনের বহুমুখী বৃহত্তর আত্মত্যাগও। বিশ্বাস করে, শরীরী ভাবনায় শরীর সম্ভোগ বই কিছুমাত্র নয়।
তাই গোভিডার আর্জি ওড়াতে দ্বিধা করেন না ‘ট্ম’। পেশায় তিনি দর্জি। বসনই তার রুটিরুজি। তবু উন্মুক্তবসনার শরীরীবিভঙ্গে উঁকি দিয়ে যাওয়ার বাসনায় লাগামহীন টম, লোকচক্ষুর আবডাল থেকে দেখে নেন গোভিডার নগ্ন শরীর।আর সেদিন থেকেই তার নাম হয় ‘পিপিং টম’। পরবর্তীতে যা নগ্নতা বা অপরের যৌনকলাপকে লুকিয়ে দেখা জনারের নামভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
সম্ভোগসুখ কেবল স্পর্শসুখী নয়। দৃশ্যমুখীও। তোমায় আমি কখনও পাব না। ছোঁয়া তো দূর পাবলিকলি তোমার দিকে চোখ তুলে তাকানোরও ক্ষমতা নেই আমার। তাই তোমায় আমি গোপনে দেখব। উঁকি দিয়ে দেখব, আড়াল থেকে দেখব, লুক্কায়িত ক্যামেরার চোখ দিয়ে নিংড়ে দেখব তোমায়। ইচ্ছেমতো জুম করে, পজ করে, বারবার রিপ্লে করে দেখব তোমায়। হোস্টেলের ঘর থেকে বাথরুম, শোয়ার ঘর থেকে পাঁচতলা মলের চেঞ্জিং রুম, এমনকী, তোমার প্রেমিকের সঙ্গে বুক করা এয়ার বিএনবি-র বিলাসঘরের প্রতিটি মুভমেন্টেও নজর রাখব আমি। একেই বলে ‘পাওয়ার’। আমার গোপন দৃষ্টিসুখউল্লাসের এই খেলায় তুমি নিত্য বোড়ে। রাজা আমি, উজির আমি, মন্ত্রী, সান্ত্রী, পেয়াদা সকলই আমি। আপুন-ইচ ভগওয়ান হ্যায়।
মনে পড়ে, ২০১৫ সালের ঘটনা। স্মৃতি ইরানি তখন কেন্দ্রের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী। গোয়ার এক পোশাক বিপণন সংস্থার মহিলা চেঞ্জিং রুমে ঢুকে তিনি সন্ধান পান গোপন এক ক্যামেরার। দিনের পর দিন ধরে দোকানে আসা মহিলা পর্যটকদের পোশাক পরিবর্তনের ভিডিও গোপনে রেকর্ড করত ক্যামেরাটি।
এমন ঘটনার উদাহরণ ভুরি ভুরি। গতমাসেই বেঙ্গালুরুর এক কফিশপের শৌচাগার থেকে গোপন ক্যামেরা উদ্ধার হয়। ধরপাকড় করে দেখা যায়, কফিশপেরই এক কর্মী তার স্মার্টফোনের সঙ্গে ক্যামেরাটি সংযুক্ত করে বসিয়েছিলেন শৌচাগারে। যার মাধ্যমে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কফিশপের ওয়াশরুমে আসা সকল ব্যক্তির ব্যক্তিগত শৌচ মুহূর্ত গোপনে রেকর্ড করত সে। তারপর একাকী নিভৃত দৃষ্টিসুখ উপভোগ করত। এই ছিল তার নেশা।
এরই মাস তিন আগে, গেল মে মাসে গাজিয়াবাদের এক মন্দির সংলগ্ন ঘর থেকে উদ্ধার হয় একটি গোপন ক্যামেরা। ঘরটি মহিলাদের পোশাক পরিবর্তনের কাজেই মূলত ব্যবহৃত হত। থানা পুলিশ ইত্যাদি করার পর জানা যায় যে ক্যামেরাটির ডিসপ্লে মন্দিরের পুরোহিতের মোবাইলের সঙ্গে লিঙ্ক করা আছে!
বলা বাহুল্য, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ‘পিপিং টম’ বা ভয়্যারিজমের ঘটনার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজনের মতো বহুলপ্রচলিত অ্যাপে মাত্র চার-পাঁচশ টাকাতেই মাইক্রোস্কোপিক গোপন ক্যামেরার খোঁজ মিলছে পেনের ভাঁজে, ঘড়ি কিংবা ফোন চার্জারের মধ্যে, স্মোক ডিটেক্টরের ফাঁকে, পেন ড্রাইভ কিংবা জামার বোতামের মধ্যে। এই সহজলভ্যতা ভয়্যারিজমের ঘটনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি করে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশগুলিতে তাই ভয়্যারিজমের ঘটনার প্রাদুর্ভাব বেশি।
সম্প্রতি ভয়্যারিজমের এক ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী রইল অন্ধ্রপ্রদেশ! সেখানকার কৃষ্ণা জেলার শেষাদ্রি রাও গুডলাভাল্লেরু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মহিলা হোস্টেলের শৌচাগার থেকে উদ্ধার হল লুক্কায়িত ক্যামেরা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই ক্যামেরায় তোলা ভিডিও রেকর্ডিং প্রথমিকভাবে ছড়িয়ে যেত সেই কলেজেরই ছাত্র আবাসনে। তারপর সেখান থেকে আর কতখানে, কে জানে! ঠিক কবে থেকে, কতদিন কিংবা কতক্ষণ ধরে এই ক্যামেরা চালু ছিল, জানা যায়নি এখনও। তবে এই ক্যামেরার মাধ্যমে আনুমানিক ৩০০-এরও বেশি ছবি ও ভিডিও তোলা হয়েছে গোপনে। এই জঘন্য ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখিয়ে পথে নেমেছেন কলেজ ছাত্রীরা। ‘ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন’ও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টিতে মধ্যস্থতা করেছে। তারা রাজ্যের মুখ্যসচিব ও ডিজি পুলিশের কাছ থেকে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট চেয়েছে। আর এ-সমস্ত কিছুর মধ্যগগনে অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণা জেলার এসপি। বলছেন, ‘কই, গার্লস হোস্টেলের বাথরুমে কোনও ক্যামেরা পাওয়া যায়নি তো।’
………………………………………………………….
আরও পড়ুন প্রহেলী ধর চৌধুরী-র লেখা: অন্তরের এই অসুরকে রুখবে কে, যদি অন্তরাত্মা না-জাগে প্রাণে?
………………………………………………………….
রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিষ্কলঙ্ক করে রাখার এ-এক অব্যয় পদ্ধতি। প্রথমেই সব অভিযোগ ঝেড়ে ফেলো। সব তথ্য ধামাচাপা দিয়ে দাও। সব দায় অস্বীকার করো। পরে ঝড়ঝামেলা হলে বুঝে নেওয়া যাবে ’খন। অন্ধ্রপ্রদেশেও সেই একই বস্তাপচা স্ট্রাটেজির পুনরাবৃত্তি। নিষ্কলুষ প্রশাসনিক মডেলের লক্ষ্যে আড়াল করো, চেপে দাও অপরাধীর আসল বুঁদিগড় !
আচ্ছা অপরাধী তখন কী করে? সে কি আরও শক্তিশালী, আরও ভয়ংকর, আরও দুর্নিবার হয়ে ওঠে? তারপর জর্জ ওরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসের মতো ক্যামেরা লেন্সের অবগুণ্ঠন সরিয়ে সরাসরি চোখ রাখে আপনার আমার ঘরের ভেতরে? রোবোটিক স্বরে বলে যায়, এবার থেকে দেখাশোনা হবে আমনে-সামনে। দেখব কী করতে পারিস!
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………