Robbar

বং জুন হো-র সাম্প্রতিক সিনেমা ‘মিকি সেভেন্টিন’ এমন কোন প্রশ্ন তুলল, যার জন্য প্রচারে এল না সিনেমাটি?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:April 4, 2025 7:17 pm
  • Updated:April 4, 2025 7:17 pm  

ইলন মাস্কের সংস্থা ‘নিউরো লিঙ্ক’ নামের এক মাইক্রো-চিপ বানিয়েছে– যা মাথার খুলি অপারেশন করে বসিয়ে দিলে মানুষের মাথার সঙ্গে কম্পিউটারের লিঙ্ক করা যাবে। এই গবেষণার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বাছা হয়েছিল হাজার হাজার বাঁদরদের। তারা বেশিরভাগই বাঁচতে পারেনি। এখন এই ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করা হচ্ছে মানুষদের নিয়ে। এরকম কাজে ভলেন্টিয়ার হলে প্রচুর টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু এখন ইলন মাস্ক তা প্রকাশ্যে এনে ফেলেছেন। 

সুমন মজুমদার

মিকি মাউসকে মনে আছে নিশ্চয়ই? চিরনবীন এই ডিজনি-র চরিত্র প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জনপ্রিয়। এখনও রাস্তায় দেখা যায়, শিশুর দল স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে মিকি মাউসের ছবি আঁকা ব্যাগ কাঁধে।

কিন্তু আজ অন্য এক মিকি মাউস নিয়ে কথা বলব। যে-মিকি ‘বিজ্ঞানের ইঁদুর’ হয়ে উঠেছে। ‘বিজ্ঞানের ইঁদুর’ ব্যাপারটা নতুন শোনালেও ঘটনা নতুন নয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণাগারের খাঁচায়  ধরে রাখা থাকে ইঁদুরদের। গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয় তাদের। এ-পর্যন্ত বললে ব্যাপারটা যতটা স্বাভাবিক মনে হয়, আসলে ততটা স্বাভাবিক নয়।

প্রায়শই দেখি, কোনও পুজো বা কুরবানি উপলক্ষে পশুবলি দেওয়া হচ্ছে, আমাদের মানবিক আধুনিক মন এ ঘটনার বিরোধিতায় সরব হয়ে ওঠে। অনেকেই প্রশ্ন তুলি, নিরীহ পশুদের ওপর এই নির্মম অত্যাচার নিয়ে। কিন্তু যদি নিরীহ পশুটিকে খুন করার আগে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, পশুটিকে ‘বিজ্ঞানের স্বার্থে’ বলি দেওয়া হল, তাহলে? আধুনিক মানবিক মনটি তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, আর কোনও প্রশ্ন করে না, প্রতিবাদ করে না।

ঠিক যেমনটা ঘটেছিল লাইকার সঙ্গে। লাইকা পৃথিবীর প্রথম প্রাণী, যে, মহাকাশে গিয়েছিল রাশিয়া থেকে, কিন্তু আর কোনও দিন ফিরে আসেনি। অথবা তাকে ফিরিয়ে আনার সেরকম কোনও ব্যবস্থাও করেননি মহাকাশ বিজ্ঞানিরা। একটা কুকুরের প্রাণ নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল মাত্র যে, মহাকাশে কোনও প্রাণী আদৌ বেঁচে থাকে কি না। সেই একই রীতি মেনে এখনও বিজ্ঞানের গবেষণাগারে গবেষণার অংশ হিসেবে মৃত্যু অথবা যন্ত্রণার অপেক্ষায় লক্ষ লক্ষ প্রাণী, তাদের চোখে কখনও ঢেলে দেওয়া হয় তরল রাসায়নিক শ্যাম্পু, যাতে বোঝা যায়, এই শ্যাম্পু মানুষের ত্বকে কতটা প্রভাব ফেলবে। পশুপ্রেমীদের নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও রমরমিয়ে চলছে বিজ্ঞানভিত্তিক ‘স্লটার হাউস’ ওরফে গবেষণাকেন্দ্র। এই লেখার কারণ সাম্প্রতিক কালের একটি সিনেমা, যার নাম ‘মিকি সেভেন্টিন’ নির্মাতা বং জুন হো। সকলেই জানেন, বং জুন হো-র সিনেমা অস্কারে সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল ২০১৯ সালে। সেই সিনেমার নাম: ‘প্যারাসাইট’।

Q&A with Parasite director Bong Joon Ho | Coolidge Corner Theater
বং জুন হো

‘মিকি সেভেন্টিন’ সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছে এক ভবিষ্যতের পৃথিবী। ‘মিকি সেভেন্টিন’ সিনেমায় প্রধান চরিত্র মিকি (অভিনয়ে রবার্ট প্যাটিনসন), সে এক সাধারণ ছেলে, যার মাথার ওপর অনেক টাকার ধারদেনা। যারা সেই ধার দিয়েছে তারা টাকা না পেলে মানুষ খুন করতেও দ্বিধান্বিত নয়। ঠিক যেভাবে আমি-আপনি ফেঁসে আছি ‘ইএমআই’-এর ঘোলাটে চক্করে, মনে ভয় নিয়ে, যদি কোনও মাসে টাকা না-ফেরত দিতে পারি তাহলে কোম্পানির লোক এসে অপদস্ত করবে নির্ঘাত!

Robert Pattinson Movie 'Mickey 17' Opening Easter Weekend 2025
‘মিকি সেভেন্টিন’ ছবির একটি দৃশ্য

এই পরিস্থিতিতে আপনার-আমার মনের ভিতরে যে ইচ্ছা উঁকি দেয়– এইসব ছেড়ে এমন এক জায়গায় পালিয়ে যাওয়া, যেখানে এই লোনওয়ালারা পৌঁছতে পারবে না। এমন সময় মিকি উপস্থিত হয় এক গ্রহান্তরী প্রোজেক্টে। কারণ তার ধারণা, পৃথিবী ছেড়ে পালিয়ে গেলে হয়তো সে এই যাত্রায় লোনওয়ালাদের হাত থেকে বেঁচে যাবে। অজান্তেই সে নাম লিখিয়ে ফেলে এমন এক প্রোজেক্টে, যেখানে তার কাজ বিজ্ঞানের গিনিপিগ হয়ে বেঁচে থাকা। ততদিনে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন এক নতুন প্রিন্টার, যার মাধ্যমে অনায়াসেই অবিকল ক্লোন বানিয়ে নেওয়া যায় যে কোনও মানুষের। অর্থাৎ, যদি মিকি কোনওভাবে মারা যায়, তাহলে আবার বানিয়ে ফেলা যাবে নতুন মিকি!

মিকি জানত না, সে আসলে বিজ্ঞানের নতুন গিনিপিগ হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছে। যেখানে বিজ্ঞানীদের কাছে সে আর মানুষ নয় এক এমন গিনিপিগ, যাকে বারবার ক্লোন করে ফেলা যায়। তাই মিকিকে ঠেলে দেওয়া হয় নতুন অজানা মৃত্যু এবং বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টের সামনে। প্রতিবার সে যখন মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করে, তাকে বলা হয়– ‘চিন্তা করো না তোমার ক্লোন আবার বানিয়ে নেব।’ মিকি পরিণত হয় এমন এক ক্রীতদাসে, যাকে বিজ্ঞানের নাম করে বারবার মেরে ফেলাই দস্তুর। কখনও রেডিয়েশন দিয়ে, কখনও অজানা ভাইরাসের টেস্ট মেটিরিয়াল হিসেবে। বারবার মরতে মরতে সে ক্লান্ত হয়ে গেলেও ‘বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট’ থামে না। বরং তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয় এই বলে যে, তুমি বিজ্ঞানের এক মহান কাজ করছ। তাকে বাঁচানোর চেষ্টাও করা হয় না, কারণ তাকে বাঁচানোর ঝামেলা থেকে ভালো নতুন এক মিকি প্রিন্ট করে নেওয়া।

Mickey 17' Review: Robert Pattinson in Bong Joon Ho's Sci-Fi Comedy
মিকির দুই ক্লোন

বারবার মারা যেতে যেতে তার কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণা কম হয় না, উল্টে সে ক্রমাগত এই প্রশ্নের সামনে এসে পড়ে যে, ‘মরতে কেমন অনুভূতি হয়’? এইভাবে মরতে মরতে সে মিকি ১ থেকে  ১৭ নম্বর-এ পৌঁছয়। দর্শকরা জানতে পারি যে, বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্টকে ‘মহান’ হিসেবে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে, তা আসলে এক হেরে-যাওয়া রাজনীতিবিদের এক নতুন গ্রহ খুঁজে উপনিবেশ স্থাপনের চক্রান্ত। সে নিজে রাজা হতে চায় বলে পৃথিবীর বাইরে লোক এনে এক্সপেরিমেন্ট করছে এবং তাকে সাহায্য করছে একদল বৈজ্ঞানিক। তাদের কাছে মিকি আর মানুষ নয় এক ইঁদুর অথবা গিনিপিগ।

The Implications of Neuralink. TL;DR — Google will be fine, Apple, not… | by Max Rehkopf | Hardbound Daily | Medium
ইলন মাস্ক ও নিউরোলিঙ্কের চিপ

গল্পটা চেনা লাগছে? ভবিষ্যতে যেতে হবে না, ইদানীং শুরু হয়েছে মানুষের ওপরেও এক ‘বৈজ্ঞানিক’ এক্সপেরিমেন্ট। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ইলন মাস্কের সংস্থা ‘নিউরো লিঙ্ক’ নামের এক মাইক্রো-চিপ বানিয়েছে– যা মাথার খুলি অপারেশন করে বসিয়ে দিলে মানুষের মাথার সঙ্গে কম্পিউটারের লিঙ্ক করা যাবে। এই গবেষণার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বাছা হয়েছিল হাজার হাজার বাঁদরদের। তারা বেশিরভাগই বাঁচতে পারেনি। এখন এই ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করা হচ্ছে মানুষদের নিয়ে। ঘটনা নতুন নয় এর আগেও সাধারণ মানুষকে ভলেন্টিয়ার নিয়ে বিজ্ঞান তার ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করেছে। এরকম কাজে ভলেন্টিয়ার হলে প্রচুর টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু এখন ইলন মাস্ক তা প্রকাশ্যে এনে ফেলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কারা এই মানুষ, যাঁরা জেনে অথবা না-জেনে নিজেকে শামিল করেন এই মরণ ফাঁদে? তাঁরা অবশ্যই অর্থিকভাবে সমাজে পিছিয়ে থাকা মানুষ অথবা সোজা বাংলায় ‘গরিব মানুষ’।

আরেকটা খটকা মনে থেকে গেল, যা দিয়ে এই লেখা শেষ করব। সাধারণত কোনও পরিচালকের সিনেমা অস্কার পেলে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তাঁর পরের সিনেমা দেখার জন্য। এবং প্রোডাকশন কোম্পানি সেই মতো প্রচার চালায়, যাতে আরও বেশি মানুষ সিনেমা দেখেন এবং কোম্পানির মুনাফা হয়। বং জুন হো ভারতে ফিল্ম  বাফদের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় একজন ফিল্ম মেকার, কিন্তু কী আশ্চর্য– এই সিনেমাটি কোথাও সেভাবে প্রচার করা হল না বিশ্বজুড়ে। আমাদের ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল না ছবিটি নিয়ে কোনও আলোচনা বা ট্রেলার। এই লেখাটি পড়ার সময় হয়তো অনেকে জানতে পারবেন যে, বং জুন হো-র সিনেমা ‘মিকি সেভেন্টিন’  রিলিজ করেছিল কলকাতায়। কোনও অনলাইন টিজার প্রোমোশন চোখে পড়ল না। সারা ইন্টারনেট দুনিয়া কেমন যেন চুপ মেরে গেল এই সিনেমাটি নিয়ে। কিন্তু কেন? প্রশ্ন জাগে, সিনেমাটি পরোক্ষভাবে এমন কিছু মানুষের বিরুদ্ধে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা হয়তো উচিত নয়। হয়তো সিনেমাটি বেশি মানুষ দেখলে তাঁরা বুঝতে পারবেন এই মুহূর্তের দুনিয়ায় এই ধরনের ব্যক্তিগত লাভের আশায় বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট কারা করছে আর কোন নেতা তার মদতদাতা। কত মিকি নিউরোলিঙ্ক এক্সপেরিমেন্টে মারা যাচ্ছেন সেটাও আমরা জানি না। ইলন মাস্ক, ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নামগুলোর পাশে এই ভয়ানক এক্সপেরিমেন্টগুলোর কথা জুড়ে যাবে, তাই কি সিনেমাটিকে সযত্নে প্রচারের আড়ালে রাখা হল এবং রাতারাতি ইন্টারনেট থেকে সব উধাও করে দেওয়া হল?