চাকরি ছেড়েছিলাম একদিনের এক মুহূর্তের সিদ্ধান্তে। কিন্তু অনবরত ‘ছাড়ব কি ছাড়ব না’-র পেন্ডুলামে দুলছিলাম। যেখানে আসার জন্য চাকরি ছেড়েছিলাম আমি, আজ সেই শহরের একটা প্রান্তে বসে আছি, ছেলের ড্রয়িংরুমে। আমাকে এখন লিখতে হবে, লিখতে লিখতে ভাবছিলাম আমার ছেলে তার বাবা সম্বন্ধে কী লিখে যাবে?
বাবার কাছে হেরেছি পাঞ্জায়, ভাই সন্টাইয়ের কাছেও, কিন্তু ছেলের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া হয়নি কখনও।
বসে আছি, ব্রেকফাস্ট হয়ে গিয়েছে। বাইরের দিকে তাকালে দেখতে পাচ্ছি সবুজ, আর বহুদূরে ফিতের মতো সমুদ্র দেখা যাচ্ছে একচিলতে। পাশে দাঁড়িয়ে ধী ইলেকট্রিক গিটার বাজাচ্ছে। ওর আস্তানায় এসেছি গত রাতে, ওর মায়ের সঙ্গে। মাড আইল্যান্ডের একটা ন’তলা ফ্ল্যাটে বসে আমি লিখছি। কতদিন বাদে বহু প্ল্যান করে এসেছি ছেলের কাছে, ওর সঙ্গে সময় কাটাব বলে, এখন আমাকে লিখতে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ওর ওভারড্রাইভ গিটার বাজানোর সঙ্গে জয়েন করি, কিন্তু পারছি না। আজ শনিবার। ওর ছুটি। আর আমাকে এখন লিখতে হবে, লিখতে লিখতে ভাবছিলাম আমার ছেলে তার বাবা সম্বন্ধে কী লিখে যাবে?
সে ভাবনা ওর থাক। আমি কোনও দিনই ওকে নিয়ে খুব বেশি ভাবিনি, ওর মা-ই যথেষ্ট এ বিষয়ে। সমস্ত মায়েদের মতোই ওরও ছেলে নিয়ে ভাবনাচিন্তা এমনিতেই উপচে পড়ছে। তার ওপর আমার ভাবনা পড়লে, সেটা বেচারার পক্ষে বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। আমি ভাবছি আমার কথা।
আমি যেন ফিরে গিয়েছি আমার অফিসের জীবনে। একটা নিয়ম তৈরি হয়ে গেছে আমার জীবনে। প্রতি শনিবার আমাকে লিখতে হবে।
যে নিয়ম মানতে না পেরে, ভীষণ বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়েছিলাম। আবার যেন আমার জীবনে সপ্তাহে একদিনের একটা বাধ্যতামূলক পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে। ‘রোববার.ইন’-এর জন্য আমাকে লিখতে হবে। চাটুজ্জে, তুমি বড় বিপদে ফেলেছ ভাইটি!
চাকরি ছেড়েছিলাম একদিনের এক মুহূর্তের সিদ্ধান্তে। কিন্তু অনবরত ‘ছাড়ব কি ছাড়ব না’-র পেন্ডুলামে দুলছিলাম। যেখানে আসার জন্য চাকরি ছেড়েছিলাম আমি, আজ সেই শহরের একটা প্রান্তে বসে আছি, ছেলের ড্রয়িংরুমে। যখন চাকরি ছেড়েছিলাম, তখন ওর জন্ম হয়নি। আমার কাছে আমন্ত্রণ আসে চেম্বুর দুর্গোৎসব কমিটির পক্ষ থেকে। শর্ত ছিল পুজোর সময় সেই অনুষ্ঠানে আমি গান গাইলে, মুম্বইয়ের অন্য কোনও পুজোতে আমার গান গাওয়া চলবে না। এক্সক্লুসিভ শো করতে হবে, আমিও সেই শর্ত মানতে রাজিই ছিলাম উপযুক্ত পাওনা পেলে। হয়তো বিশ্বাস হবে না অনেকেরই, আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল, ‘আমাকে যদি আপনারা এক্সক্লুসিভ রেট দেন তাহলে আমার কোনও অসুবিধা নেই।’ টেলিফোনের উল্টোদিক থেকে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বলুন কত টাকা আপনি চান।’ আমি বলে ফেলেছিলাম, ‘এক লাখ টাকা অ্যাট লিস্ট’।
১৯৯৫ সাল, এক লাখ টাকা, আমার সারা বছরের মাইনের দু’গুণেরও একটু বেশি। অর্গানাইজাররা রাজি হয়ে গিয়েছিল, প্রথমদিন ওঁদের আর্টিস্ট ছিলেন হেমা মালিনী এবং তাঁর নাচের দল। দ্বিতীয় দিন আমার, তৃতীয়দিন অভিজিৎবাবু। কিন্তু ওইদিন পারফর্ম করতে গেলে আমার একটা দিনের ছুটির প্রয়োজন ছিল। অ্যাপ্লাই করেছিলাম। আমার যে বস ছিলেন, তিনি একটু বেশিই গম্ভীর গম্ভীর হাবভাব করতেন। আর আমার একটু নাম হয়ে যাওয়ায়, আর সবার সামনে অরূপবাবু আমার ভীষণ প্রশংসা করায় অনেকের মতো উনিও ক্ষুব্ধ ছিলেন। আমার অ্যাপ্লিকেশনটা নিয়ে উনি তারও বস-এর সঙ্গে দেখা করে মিনিট পনেরোর মধ্যে নাকচ হওয়া অ্যাপ্লিকেশনটা আমার ডেস্কের ওপর রেখে দিয়ে গিয়েছিলেন।
বাড়িতে ফোন ছিল না। ইলিনার সঙ্গেও কথা বলতে পারিনি। একটা দিনের ছুটি পুজোর আগে দিতে যখন উনি চাইলেন না, আমার গেল বাঁধ ভেঙে। আমার কলিগ এবং বন্ধু সঞ্জয় চ্যাটার্জিকে বললাম, ‘হ্যাঁ রে, রেজিগনেশন লেটারের কী বয়ান হয় রে?’ ও বলল ‘কেন?’, আমি বললাম, ‘বল না, জেনে রাখি।’ ওর বলা অনুযায়ী ‘আনন্দবাজার’ অফিসের বাইরে যে টাইপিস্ট বসতেন, তাকে দিয়ে চিঠি টাইপ করিয়ে, আমার বসের ডেস্কে আমিও খানিকক্ষণের মধ্যে ফেলে রেখে এসেছিলাম আমার সিদ্ধান্ত। রেজিগনেশন লেটার। দিনটা ছিল ১সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫। সেই শো-টার কী হয়েছিল, সেটা পরে বলছি, কিন্তু ১৯৯৬-এর ১ সেপ্টেম্বর আমার ব্যাটা ল্যান্ড করেছিল এই পৃথিবীতে। দিনটা ছিল রোববার। আর ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ সালে আমার প্রথম অ্যালবাম ‘ভূমিকা’ লঞ্চ করেছিল।
এক লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক পেয়ে বোম্বাই গিয়েছিলাম শো করতে, পড়েছিলাম সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে। কিন্তু চাকরি ছাড়ার পরদিন দেরি করে ঘুম থেকে উঠেই আমি চিৎকার করেছিলাম– ‘আমি আর টাই পরব না।’
সেই চিৎকার শুনে ইলিনা ছুটে এসেছিল পাশের ঘর থেকে। ভেবেছিল গেল বোধহয় মালটার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি হাসছিলাম, জীবনটা বদলে গিয়েছিল। আরও বদলে গিয়েছিল যেদিন আমি বোম্বাই থেকে ফিরে এলাম কলকাতায়, সে গল্প অন্যদিন।
আগে আমি ধী-এর সঙ্গে আড্ডা মারব, ওকে চটকাব, ওর করা কাজ দেখব, বিকেলে ওর এক বন্ধুর কনসার্ট দেখতে যাব, রাতের মুম্বইয়ের আঁচ নেব, আজ মুম্বইয়ের ফুর্তির দিন। পরেরবার বোম্বাইয়ের দুরবস্থার কথা বলব।