বাঙাল কখনও বেড়াতে গিয়ে একজায়গায় চুপ করে বসে থাকতে পারে না। যেখানে যা দ্রষ্টব্য, ‘বারবার কি আর আসা হবে’– এই যুক্তিতে সবটা চষে ফেলবে। আম-বাঙালের ভ্রমণপিপাসু মন-মানসিকতা নিয়েই সুনন্দন চক্রবর্তীর ‘বাঙাল চক্কর’। তবে লেখকের সরল স্বীকারোক্তি এবং অবশ্যই রসবোধ উপভোগ্য– তিনি বলছেন, ‘দেশে বিদেশে’ জাতীয় উত্তম মানের বইয়ের সঙ্গে তাঁর বইয়ের যেন তুলনা না হয়।
শুধু বাঙালি নয়, বিশেষ করে বাঙালের পায়ের তলায় সরষে। পৃথিবীর সর্বত্র বাঙালের বিচরণ। মানুষ এমনিতে দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাসের সূত্রে মাতৃভাষা ‘প্রায়’ ভুলে ইংরেজিতেই সড়োগড়ো হয়ে পড়ে। কিন্তু বাঙালদের গুণ হল, মূলত বাংলাদেশের যারা, প্রয়োজন ছাড়া দিব্য়ি বাঙাল ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ। বাঙালরা প্রাণখোলা স্বভাবের এবং বন্ধুভাবাপন্ন। এটা বাঙালের বিশেষত্ব। যে-কারণে যেখানেই সে পা বাড়াক, সহজে সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। হাতে টাকাপয়সা থাকলে তো কথা নেই, দেদার খরচ করে। ওই বেড়াতে গিয়ে পাইপয়সার হিসেব করে চলার পাবলিক বাঙাল নয়। তা সে ঘটিরা যতই রে রে করে উঠুক না কেন! বাঙাল কখনও বেড়াতে গিয়ে একজায়গায় চুপ করে বসে থাকতে পারে না। যেখানে যা দ্রষ্টব্য, ‘বারবার কি আর আসা হবে’– এই যুক্তিতে সবটা চষে ফেলবে। আম-বাঙালের ভ্রমণপিপাসু মন-মানসিকতা নিয়েই সুনন্দন চক্রবর্তীর ‘বাঙাল চক্কর’। তবে লেখকের সরল স্বীকারোক্তি এবং অবশ্যই রসবোধ উপভোগ্য– তিনি বলছেন, ‘দেশে বিদেশে’ জাতীয় উত্তম মানের বইয়ের সঙ্গে তাঁর বইয়ের যেন তুলনা না হয়। কারণ ‘..ইয়ারদোস্তের মজলিশে দু’পাত্তর বাড়তি পাওয়ার লোভে এইসব গল্প ফেঁদে রীতিমতো সাফল্য পেয়েছি। আপনারা যাঁরা সেই মহৎ কাজে লিপ্ত হতে চান তাঁদের হয়তো গল্পগুলো কাজে লেগে যাবে।’ এবং সত্যিই রসিকতার চালেই ভ্রমণ-বৃত্তান্তগুলো। এই বই পড়ে অন্তত মানস-ভ্রমণ হয়ে যাবে। কারণ প্রকৃত বেড়াতে ভালবাসে যারা, ‘তারা কেবল জায়গা দেখেন না, জীবন দেখেন।’ এই যে দেখার চোখ, “দেখার ক্ষমতা এর মধ্যে মিশে থাকে বিশাল কলোনিয়ালিজমের ইতিহাসে তেমন পাত্তা না পাওয়া ‘আমাগো কলোনি’-র মন-মজ্জার গল্প; হেয়ারা পররে আপন করে, আপনারে পর। বায়রার বাঁশির সুরে ছাইড়া যায় গর। দেশ না হারালে বোধ হয় দুনিয়াকে ঘর ভাবা যায় না।”
বইটির সূচিপত্র বেশ আকর্ষক। নাম ‘চক্করের ফর্দ’। তাতে ‘দুই খান কতা’। মোট দশটি লেখা। তাতে বাঙালের প্রথম বিদেশ সফর থেকে কেনিয়া দর্শন, মিশর, কাঞ্চনজঙ্ঘা তানজানিয়া, মাসাইমারা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ‘বাঙালের বাইকবাজি’, ‘বাইক নিয়ে বিপত্তি’ এবং ‘বাঙালের নতুন বাতিক’। লেখক প্রথমবার বিদেশ যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন কাম্বোডিয়া আর থাইল্যান্ডে। কিন্তু বাংলাদেশ চলবে না। বাঙালদের স্বদেশ। বাঙালদের প্রেস্টিজ খুব টনটনে। তাই এত কাছে যাওয়ার জন্য ট্রাভেল এজেন্সি নয়। টিকিট, হোটেল বুকিং নিজেরাই করেছেন। আবার বলছেন বাঙালরা নাকি আনপ্রেডিক্টেব্ল। কখনও বলছেন বাঙাল মাত্রই বাতিকগ্রস্ত। রসিকতা করে লিখেছেন, “বাঙাল এবার ফিরে সুবলের চায়ের দোকানে যেখানে তার রকের লোকেরা বলবে: ‘দুইডা বাঘ সিংহ দ্যাখনের জন্যে কঙ্গো যাবার কি হইসিল, আলিপুর গ্যালেই তো হইত। বনে জঙ্গলে না খাইয়া তো শুকাইয়া গ্যাসস। চাখা।…”
এভাবেই বাঙাল হলে কী কী হতে পারে, তাই নিয়েই নানান গল্পকথার মধ্য দিয়ে ভ্রমণ কাহিনিগুলো লিখেছেন। মজার লেখা এবং বিস্তারিত তথ্য –দুইয়ের দুর্দান্ত কম্বিনেশন। প্রচ্ছদ করেছেন দেবাশিস বর্ধন। ফোটোগ্রাফি স্বয়ং লেখকের।
বাঙাল চক্কর
সুনন্দন চক্রবর্তী
প্রকাশক ‘পরবাস’
মূল্য ২৫০্