দিঘা-মন্দারমণিতে একর-একর খেতের ওপর তৈরি হয়েছে শয়ে শয়ে কংক্রিটের হোটেল রিসর্ট। উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভুগতে থাকা মৎস্যশিল্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষরাও এখন লোভনীয় পর্যটন ক্ষেত্রেই উপার্জনের উৎস খুঁজে নিতে চাইছে। দিঘা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি নিয়ে তাদের একটি রিপোর্টে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বলেছে, সমুদ্রতটে ‘হিউম্যান অ্যাক্টিভিটিস’ বেড়ে যাওয়ার ফলে উপকূলরেখা ক্ষয়করণের প্রক্রিয়ার গতিবৃদ্ধি হয়েছে।
আঠেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার নবাব মির কাশেমের থেকে উপহার হিসাবে পাওয়া মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত উপকূলবর্তী গ্রাম বিরকুলের রূপে বিস্মিত হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এই গ্রামটিকে ‘ব্রাইটন অফ দ্য ইস্ট’ বলে ব্যাখ্যা করেন। হেস্টিংস চেয়েছিলেন ওই গ্রামটির রূপান্তর ঘটিয়ে ওখানে অভিজাত সাহেবদের ফূর্তি করার জন্য একটি পর্যটন কেন্দ্র বানাবেন। কিন্তু পর্যাপ্ত যানবাহন এবং পরিকাঠামোর অভাবে হেস্টিংসয়ের জীবনকালে সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি।
তারপর একটা গোটা শতাব্দী পেরিয়ে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আর এক ব্রিটিশ সাহেব ওই অঞ্চলের প্রেমে পড়লেন। ততদিনে বিরকুল সমেত পার্শ্ববর্তী কিছু গ্রাম মিলিয়ে ওই জায়গার নাম হয়েছে ‘দিঘা’। সেই সময়ে কলকাতার বিখ্যাত জহুরি ‘হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানি অফ ক্যালকাটা’র মালিক জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেথ চকিত নয়নে দিঘার নীলচে সমুদ্র এবং সোনালি বেলাভূমি দেখে ঠিক করেছিলেন ওখানেই স্থায়ীভাবে থাকবেন। সরকারের থেকে জমি কিনে শুধু নিজের থাকার ব্যবস্থাই করেননি, বরং একপ্রকার শপথ নিয়েছিলেন যে, এই মানুষবিহীন এলাকাকে দর্শনীয় করে তুলবেন।
দিঘার মায়ায় স্নেথ এতটাই মত্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, হ্যামিলটন সংস্থার সমস্ত দায়িত্ব ত্যাগ করতেও পিছুপা হননি। তাঁর অবিচল সংকল্প এবং অবিরত প্রচারের ফলে বাংলার বিভিন্ন রাজা-জমিদাররা দিঘায় এসেছিল বা অর্থ বিনিয়োগ করে স্কুল এবং বাগানের মতো সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে তুলেছিল। স্নেথের নিজের লেখাগুলিও দিঘা নিয়ে প্রাথমিক স্তরের পর্যটন সাহিত্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসাবে কাজ করেছে। স্বাধীন ভারত ছাড়ার আগে উনি বিধানচন্দ্র রায়কে দিঘার উন্নয়নের দায়িত্ব দিয়ে যান এবং ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেন দিঘাকে একটি যথাযথ পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে।
আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে দিঘার পর্যটন নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। দিঘা এখন বাঙালির ‘অল ওয়েদার ফ্রেন্ড’। দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুর যেতে বাঙালির আর প্ল্যান লাগে না। একটা লং উইকেন্ডই যথেষ্ট। তবে দিঘা ভাল নেই অনেক দিন। বিশ্বব্যাপী দ্বীপপুঞ্জ এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলি সর্বদা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রথম আঘাতে আক্রান্ত হয়েছে।
উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলরেখা সম্পূর্ণরূপে বদলে গেছে। এর সঙ্গে আছে ওয়েদার প্যাটার্নে পরিবর্তন, অসময়ের বৃষ্টিপাত, উপকূলীয় ক্ষয়, সমুদ্রের ভূতলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং মারণমুখী সাইক্লোন। ভারতে বঙ্গোপসাগরের তীরে ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ উপকূলীয় জেলাগুলিতে বসবাসকারীরাই প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগী। কপাল পুড়ছে দিঘারও। কিন্তু দার্জিলিংয়ের মতোই বাঙালি পর্যটকরা এখনও দিঘায় বাড়তে থাকা বিপত্তি নিয়ে চিন্তিত নয়। চিন্তিত না বললে অবশ্য ভুলই হবে। বলা ভালো, ভ্রমণরসিক বাঙালিরা এখনও ভাবতেই পারে না জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে তাদের প্রিয় জায়গা দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুর এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম।
২০২১ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র ‘স্প্যাটিওটেম্পোরাল অ্যানালিসিস অফ ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ল্যান্ডফল্স ইন নর্দার্ন বে অফ বেঙ্গল, ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ’ অনুযায়ী, ১৮৭৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে উত্তর ভারত মহাসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলির প্রায় ৮০ শতাংশ বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে গিয়েছিল এবং তাদের ৪০ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার উপকূলে আছড়ে পড়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘দ্য ওয়ার্স্ট ইস ইয়েট টু কাম’। জাতিসংঘের ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি)-এর ষষ্ঠ মূল্যায়ন রিপোর্ট জানিয়েছে, ‘উত্তর বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে আগামী দিনে সামগ্রিকভাবে ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের সংখ্যা কমবে, কিন্তু মোস্ট ইন্টেন্স ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকবে।’
আইপিসিসি-র রিপোর্টটি আরও বলছে যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বঙ্গোপসাগরের উত্তরে সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছে। এর ফলে সমুদ্রের ভূতলে তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। উপকূলীয় এলাকা এবং মাটির বাঁধ রক্ষার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বারা গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির ২০২১-এ প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, ১৯৮০ সাল থেকে এই রাজ্যের উপকূলে সামুদ্রিক ভূতলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির গড় বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় আটগুণ বেশি। যার প্রভাবে এই অঞ্চলগুলিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও ক্রমবর্ধমান এবং বদলে যাচ্ছে পরিচিত ওয়েদার প্যাটার্ন ও জলজ বাস্ততন্ত্র।
National Assessment of Shoreline Changes along Indian Coast: Status Report for 26 years (১৯৯০-২০১৬)-এর ডেটা অনুযায়ী, উপকূলীয় ক্ষয়সাধনের ফলে জমি হারানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির মধ্যে শীর্ষে অবস্থিত। ১৯৯০ থেকে ২০১৬-র মধ্যে এই রাজ্যের উপকূল থেকে প্রায় ৯৯ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রে তলিয়ে গেছে, যা গোটা ভারতের উপকূলরেখা ক্ষয়ের ৪০%। উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের এই মরণফাঁদে পড়ে আজ পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত উপকূলবর্তী অঞ্চলে মৎস্যশিল্প ও কৃষি নির্ভর লাখো পরিবার এক প্রান্তবর্তী সংকটের সম্মুখীন।
দিঘার এবং লাগোয়া মন্দারমণি, তাজপুর ও উদয়পুরের আবার কপালে উঠেছে বাঙালির অন্যতম প্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার শিরোপা। এরই মধ্যে পর্যটন শিল্পকে আরও উৎসাহিত করতে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুরের উপকূল বরাবর বেশ কয়েকটি উন্নয়নমূলক প্রকল্প ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে অন্যতম এবং সবথেকে আলোচিত দিঘা-মন্দারমণি মেরিন ড্রাইভ। এর ফলে পর্যটন শিল্প এই অঞ্চলগুলিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপকে আরও ঘনীভূত করছে। ২০২০ সালে একটা গবেষণায় জানা গিয়েছে, অন্যান্য উপকূলীয় প্রক্রিয়ার তুলনায় পর্যটনকে মাথায় রেখে নগরায়ণ করলে উপকূলবর্তী অঞ্চলে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়।
একর-একর খেতের ওপর আজ তৈরি হয়েছে শয়ে শয়ে কংক্রিটের হোটেল রিসর্ট। উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভুগতে থাকা মৎস্যশিল্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষরাও এখন লোভনীয় পর্যটন ক্ষেত্রেই নিজেদের উপার্জনের উৎস খুঁজে নিতে চাইছে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক পত্রে, ‘সাসটেইনেব্ল ডেভেলপমেন্ট অফ কোস্টাল ট্যুরিজম ইন দিঘা, ওয়েস্ট বেঙ্গল: অ্যান ইনভেস্টিগেশন অফ লোকাল রেসিডেন্টস অ্যাটিটিউড’ জানিয়েছিল যে, স্থানীয়রা কৃষি ও মৎস্যশিল্পের বদলে পর্যটন সংক্রান্ত হসপিটালিটি সেক্টর, পরিবহণ, খাবারের ছোট ব্যবসা বা দোকান থেকে এখন বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা পায়।
কিন্তু বর্তমান পর্যটন শিল্প পরিবেশগতভাবে কতটা টেকসই, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। দিঘা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি নিয়ে তাদের একটি রিপোর্টে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বলেছে, সমুদ্রতটে ‘হিউম্যান অ্যাক্টিভিটিস’ বেড়ে যাওয়ার ফলে উপকূলরেখা ক্ষয়করণের প্রক্রিয়ার গতিবৃদ্ধি হয়েছে। এই বিষয়ে ২০১৫ সালের পত্রটিতে আরও বলেছে, ‘পর্যটন শিল্প দ্বারা উৎপাদিত পদার্থপূর্ণ বর্জ্য এবং কাঁচা পয়ঃনিষ্কাশনের সমুদ্রে মিশে যাওয়ার ফলে দিঘার উপকূলে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা প্রত্যেক বছরের ট্যুরিজম সিজনের সঙ্গে আরও গুরুতর হয়ে চলেছে।’ পেপারটি আরও জানিয়েছে যে, পর্যটন শিল্পের বৃদ্ধি এবং তার ফলস্বরূপ অপরিশোধিত বর্জ্য জল এবং আবর্জনা ডাম্পিংয়ের কারণে দিঘার সমুদ্র থেকে এমন অনেক নীরজ জীবন হারিয়ে গিয়েছে যাদের আগে সাধারণত দেখা মিলত।
জাতিসংঘের একের পর এক এবং আরও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক স্টাডি ও গবেষণাপত্র যখন বারবার উত্তর বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলি নিয়ে সতর্কীকরণ করে চলেছে, তখন স্থানীয় প্রশাসন এবং কর্তৃপক্ষ যদি পরিবেশগতভাবে সচেতন না হয় আগামী প্রজন্মকে দিঘায় দেওয়ার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। একশো বছর ধরে গড়ে ওঠা ভ্রমণপিপাসু বাঙালির সাধের দিঘাকে বঙ্গোপসাগর একটু একটু করে গিলে নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে এখন আর বন্ধ করা সম্ভব না। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্যটন ব্যবসা চালাতে প্রয়োজন এমন একটি পর্যটন ক্ষেত্র, যা গড়ে উঠবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং হুমকিকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং সমুদ্র ও প্রকৃতিকে আঘাত না করে। তার সঙ্গে প্রয়োজন বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সচেতন এবং পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল পর্যটক।