লেখালিখির বাইরে সমরেশদার প্রতিবাদী, প্রতিরোধী, মিছিলে হাঁটা টাইপ কোনও চরিত্র তেমন ছিল না, ঘিরে থাকা ভক্তকুল ছিল না, তিনি শনি-রবিবার বাড়িতে সাহিত্য-শিল্প চর্চার আসর বসাতেন না, তিনি কোনও অ্যাকাদেমির সঙ্গে তেমনভাবে যুক্ত ছিলেন বলেও শুনিনি। সেভাবে তিনি ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ তকমাও পাননি।
গুণীজনকে মনে করতে হলে, তাঁর জীবন, তাঁর কাজ দিয়ে লেখা শুরু করাই রীতি। পাঠক, মার্জনা করবেন, আমি একটু উল্টোদিক থেকে শুরু করছি। আমি শুরু করছি, প্রয়াণের পর থেকে। একজন প্রকৃত গুণী মানুষের জীবন শুরু হয় মৃত্যুর পর থেকে।
সমরেশ মজুমদার প্রয়াত হওয়ার কিছুদিন পর কলকাতার নামকরা হল-এ স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। সমরেশদার কন্যা শুধু হোয়াটসঅ্যাপে নামকায়াস্তে রুটিন মেসেজ পাঠালেন না, নিজে ফোনও করলেন। যথার্থ শিষ্টাচারে তিনি অনেকের সঙ্গেই ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছেন বলে শুনেছি। জি ডি বিড়লা সভাঘরে যেতে হবে। হলটি ভাল এবং বড়। অনেক আসন। আমি যে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছেছি, এমন নয়, তারপরেও গিয়ে দেখি অধিকাংশ আসন ফাঁকা। মন খারাপ হল। সমরেশদার স্মরণ অনুষ্ঠান এরকম একটা ফাঁকা হল-এ হবে? যদি এরপরও আমন্ত্রিতরা আসতে শুরু করেন, তাহলেই বা কতটা ভরবে? খুব বেশি হলে অর্ধেক, বা তার থেকে একটু বেশি। সেটাও তো এমন কিছু হবে না। এত বড় হল নেওয়া উচিত হয়নি। ছোট কোনও জায়গায় সভার আয়োজন করলে ঠিক হত। সব আসন ভর্তি হত। যাঁরা আয়োজক তাঁদের কারও কারও কপালে ভাঁজ দেখলাম। ভাঁজ হওয়ারই কথা।
পিছনের দিকে গিয়ে বসি। সময় যত যেতে লাগল, মন খারাপ বাড়তে লাগল। শ্রোতা কোথায়? হল ভর্তি তো পরের কথা, মোটামুটি লোক না হলে সেটা শুধু সমরেশ মজুমদারের জন্য বিশ্রী হবে না, বাংলা সাহিত্যের জন্যও বিশ্রী হবে। চোখে আঙুল দিয়ে যেন বাংলা সাহিত্যের দৈন্য দেখিয়ে দেওয়া হবে। নাচ, গান, সিনেমা, টিভির পুরস্কার অনুষ্ঠানে চড়া দামের টিকিটেও হল ছাপিয়ে যায়। আর বাংলা সাহিত্যের জন্য আধখানাও ভরে না?
নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। বোঝালাম, কেন লোক হবে? বাংলা ভাষায় লেখালিখি করা একজন সাহিত্যিককে স্মরণ করতে কতজন আসতে পারে? বাংলা গল্প-উপন্যাস আজকাল পড়ে ক’জন? সবসময়ই তো শুনি, পাঠক নাকি রোজ কমছে। তাও সমরেশদা যদি তরুণ পাঠকদের লেখক হতেন, একটা কথা ছিল। কম বয়সের ভক্তরা হই হই করে চলে আসত। সেই বয়সে উন্মাদনা থাকে। তরুণ পাঠকদের তিনি একটা সময়ে মন কেড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরে তা ছিল না। ধাপে ধাপে বয়স্কদের লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে ছোটাছুটি আশা করা যায় না। আর একটা কথা না বলে পারছি না। লেখালিখির বাইরে সমরেশদার প্রতিবাদী, প্রতিরোধী, মিছিলে হাঁটা টাইপ কোনও চরিত্র তেমন ছিল না, ঘিরে থাকা ভক্তকুল ছিল না, তিনি শনি-রবিবার বাড়িতে সাহিত্য-শিল্প চর্চার আসর বসাতেন না, তিনি কোনও অ্যাকাদেমির সঙ্গে তেমনভাবে যুক্ত ছিলেন বলেও শুনিনি। সেভাবে তিনি ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ তকমাও পাননি। বরং তথাকথিত ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ লেখককুল, পাঠককুল, সমালোচককুল তাঁকে কিছুটা এড়িয়েই চলেছে। ‘ভিড়’ কম হওয়ার পিছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে বলে সেদিন মনে হয়েছিল। ‘সমরেশ গোষ্ঠী’ বলে কিছু থাকলে চিন্তা ছিল না।
এছাড়াও ভেবে দেখলাম, বিড়লা সভাঘর, শহরের একদিকে। এটা রবীন্দ্র সদন, নন্দন, অ্যাকাডেমিতে হলে অবশ্যই লোক বেশি আসত। অনেকে না জেনে ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়তেন। ওদিকটায় রোজই অনেক তরুণ কবি সাহিত্যিক, সৃজনে যুক্ত মানুষ যান। কোথাও ঢুকে পড়ে আলোচনা শোনেন। এক্ষেত্রেও তাই হত।
তবে এই ফাঁকে বলে রাখি, কেউ কেউ বলেন, লেখকের প্রয়াণে নাকি লেখকদের বেশি উদ্বেলিত হওয়া দরকার। হাসপাতালে, শেষকৃত্যে, স্মরণ অনুষ্ঠানে তাঁদেরই ভিড় করা উচিত। না যাওয়া অপরাধ। এই কথার কোনও মানে নেই। লেখক লেখকদের জন্য লেখেন না। বরং এক লেখক খ্যাতিলাভ করলে অনেক সময়েই অন্য লেখকের ঈর্ষার কারণ হন। ফলে বেশি উদ্বেগ দেখলে ‘কুমিরের কান্না’ মনে হয়। কথাটা অপ্রিয়, কিন্তু সত্যি। এই যে সেদিন স্মরণ অনুষ্ঠানে বহু লেখককে আমি দেখতে পাইনি, তাতে কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে? যাঁরা সেদিন গিয়েছিলেন, তাঁরা ছাড়া কোনও লেখক সমরেশদার লেখা পড়েননি বা পছন্দ করেন না? একেবারেই নয়। দেখা যাবে, অনুপস্থিত অনেক লেখকই হয়তো সমরেশদাকে গভীরভাবে পড়েছেন, ভাল-মন্দ অনুভব করেছেন। একজন লেখকের কাছে যেমন লেখক যেতে পারেন, পছন্দের গায়কের কাছেও যেতে পারেন।
একথা যে এখানে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ নয়, তা একটু পরেই বোঝা যাবে।
শঙ্খ ঘোষকে শ্রীজাত-র অক্ষর-তর্পণ: কবিতার জগৎ যে অন্ধকার নয়, শঙ্খ ঘোষ বুঝিয়েছিলেন এক মিইয়ে পড়া বিকেলে
যাই হোক, সেদিন বাংলা সাহিত্য, বাংলার সাহিত্যিক নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হল। আমি ৪০ মিনিটের মতো ছিলাম। বেরিয়ে আসার সময়ে মুখ ফিরিয়ে হলের দিকে তাকালাম। দেখি, শেষ পর্যন্ত কী অবস্থা হল। অতি ছোট একজন লেখক হিসেবে, সমরেশদার অনুরাগী হিসেবে, সাহিত্য পাগল হিসেবে কতটা হতাশা নিয়ে ফিরতে হবে? অনেকটা? নাকি একটু কম?
ঘাড় ঘুরিয়ে আমি চমকে উঠলাম– এ কী কাণ্ড!
যাবতীয় আশঙ্কা, বাংলা সাহিত্য এবং সাহিত্যের পাঠক নিয়ে যাবতীয় ভুল ধারণা, ভুল হিসেব, তথাকথিত সাহিত্য পণ্ডিতদের যাবতীয় অভিশাপ, জনপ্রিয়তায় হেয় করার যাবতীয় ঈর্ষা, লোক দেখানো ভেজাল ‘ইন্টেলেকচুয়াল’পনাকে তুচ্ছ করে, ধুলোর মতো ঝেড়ে ফেলে মানুষ এসেছে। হল শুধু উপচে পড়েনি, মানুষ বসে রয়েছে অডিটোরিয়ামের সিঁড়িতে, দাঁড়িয়ে রয়েছে। এত মানুষ কখন এল? কোথা থেকেই বা এল? বাংলা সাহিত্যে আজও এত পাঠক! এই স্মরণ অনুষ্ঠান বিজ্ঞাপিত নয়, কার্যত পিছনে তেমন বড় কোনও প্রতিষ্ঠান নেই, ভাড়া করা বাসে নয়, শ্রোতাদের সকলকেই আসতে হয়েছে নিজের উদ্যোগে, বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে। তারপরেও দলে দলে এসেছেন। যে আমি অতি নগণ্য লেখক এতক্ষণ কুঁকড়ে ছিলাম, সেই আমার বুক ফুলে উঠল গর্বে।
সমরেশদার লেখা নিয়ে কত সমালোচনাই তো শুনেছি। ফেসবুকে ফেসবুকে কতই না ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেই নিন্দা বার্তা। লেখায় অস্বস্তিতের সংকট, গভীর জীবনবোধ, একাকিত্বের দুর্লঙ্ঘ বাধা, শিল্পের আত্মবীক্ষা কোথায়? সেইসব মিথ্যে আত্মগরিমায় ভোগা অসুখকে ফুৎকাকে উড়িয়ে দিয়ে মানুষ এসে ভিড় করেছে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে।
এতক্ষণ সমরেশদার স্মৃতিতে চোখে জল আনিনি, কিন্তু এবার নিজেকে সামলাতে পারলাম না। সমরেশদাকে আজও এত মানুষ ভালোবাসে! এ কী কম কথা? যারা নানাভাবে এই লেখকের সাহিত্য প্রতিভাকে কটাক্ষ করেছে, ইচ্ছে করছিল, তাদের চিৎকার করে ডাকি। বলি, ‘এসে একবার দেখে যাও!’
সেদিন কারা এসেছিলেন? সমাজের সর্বস্তরের মান্যিগন্যিরা। ওই যে বলছিলাম, লেখকের স্মরণে লেখকের যাওয়া উচিত বলে কিছু হয় না, লেখা সবার। যতক্ষণ না ‘সবার’, ততক্ষণ অর্থহীন। এই ‘সবার’ মানে পরিমাণের কথা বলছি না, বলছি সব ধরনের পেশা ও নেশার। কিন্তু মনটা হতে হবে সাহিত্য পাঠে আগ্রহী। যে পাঠে সুখ, দুঃখ, সমাজ, জীবন, বেঁচে থাকা, অস্তিত্ব, একাকিত্ব, বিষণ্ণতা, বোধকে স্পর্শ করা যায়। যে যেমনভাবে স্পর্শ করতে চায় করুক। যদি ভাল না লাগে বাতিল করুক। পাঠকের সে অধিকার তো রয়েছেই। সমরেশ মজুমদার মহান সাহিত্যিক কি না, সময় বলবে। কিন্তু আমার সাহিত্য পাঠের সময়ে আমি তাঁকে এড়াতে পারি না।
সেদিন ভিড় ঠেলে হলের বাইরে এসে দেখি তখনও ভিতরে ঢোকার লাইন। রাস্তায় গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ! ট্রাফিক পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে।
সেদিন ছিলেন না, তাও বুঝতে পারছিলাম, সমরেশদা ভীষণভাবে রয়েছেন। এতক্ষণ মৃত্যুর পরের কথা বললাম, এবার একটু তার আগের কথা বলি? কথাটা একটু ব্যক্তিগত হয়ে যাবে, পাঠককে মার্জনা করতে হবে। আত্মগরিমা নয়, একজন অগ্রজ লেখক একজন অনুজকে কতটা প্রশ্রয় দিতে পারেন, এটা তার একটা উদাহরণ। সেদিন খুব সংকুচিত হয়েছিলাম, কিন্তু পরে বুঝেছি, এই ‘প্রশ্রয়’, ‘কর্তব্য’-ও বটে। যতক্ষণ না বড়জন ছোটর হাতে মশাল এগিয়ে দিতে পারছেন, ততক্ষণ কোনও সৃষ্টিই বাঁচে না। শুধু সাহিত্য-শিল্পকলাই নয় বিজ্ঞানও তাই। সফল বিজ্ঞানী ছাত্র গবেষকদের নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পড়ে না থাকলে বিজ্ঞানও থমকে যেত।
হ্যারি বেলাফন্টে-কে উপল সেনগপ্ত-র অক্ষর-তর্পণ: এই নীল রঙের গ্রহকে গান দিয়ে বদলে দিতে চাইতেন হ্যারি বেলাফন্টে
সেটাও এক অডিটোরিয়ামের গল্প। রোটারি সদন। একটি অনুষ্ঠানে আরও গুণীজনের সঙ্গে সমরেশদাও উপস্থিত। কোনও গুণ না থাকা সত্ত্বেও এই অধমকেও মঞ্চে ঠেলে তোলা হয়েছে। মনে হয়, একজন নবীন না থাকলে মঞ্চসজ্জা মানাছিল না। সে হোক, সমরেশদা জোর করে আমাকে পাশের চেয়ারে বসালেন। এ পর্যন্ত ঠিক রয়েছে, কিন্তু ভাষণের সময় এক বিপদের কাণ্ড করলেন। হল ভর্তি শ্রোতার সামনে আমার লেখা নিয়ে বলতে শুরু করলেন। একটা-দুটো কথা নয়, টানা প্রশংসা। অবস্থা এমন হল, আমি সমরেশদার হাঁটু ছুঁয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘সমরেশদা, প্লিজ আর নয়।’ বর্ষীয়ান, সেই সময়ের জনপ্রিয়তমদের একজন সাহিত্যিক এই অনুরোধ শুনলেন না। হাত সরিয়ে দিয়ে বলতেই থাকলেন।
আমার প্রশংসায় আমি কি আপ্লুত? না, বুঝেছিলাম, উনি চেষ্টা করছেন। আমার লেখার কথা বলে আসলে বাংলা সাহিত্য পাঠে শ্রোতাদের আগ্রহী করার চেষ্টা করছেন। এই কাজ তিনি অন্য অনুষ্ঠানে, অন্য কারও সম্পর্কেও বলেছেন, পরেও বলবেন। আজ মনে হয়, আমি কি এভাবে পারব? আমার পরের প্রজন্মের একঝাঁক নতুন ছেলেমেয়ে এই মুহূর্তে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ঝলমল করে উঠেছে। কলম নামের তরবারি হাতে তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কলরব করছে। সাহিত্যের পুরনো ধ্যানধারণা ভেঙে নতুন বিশ্বাস, নতুন বিস্ময় গড়ছে। ওরা জয় করবে। আমি কি সমরেশ মজুমদারের দেখানো পথে দু’হাত তুলে তাদের স্বাগত জানাতে পারব? তাদের কথা বলে বেড়াব?
আমি চেষ্টা করব সমরেশদা। আমি চেষ্টা করব।