তাহলে কি ন্যানোশিপ বা ঘোষিত শর্ট-টার্ম রিলেশনশিপের মধ্যে ভালোবাসা থাকে না? শরীর বা মনের সম্পর্ক সেখানে কি যান্ত্রিক? চুম্বন কি সেখানে যন্ত্রবৎ? এই প্রসঙ্গে রণজিৎ দাশের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে– ‘অভিনয়কালে চুম্বনও যে প্রকৃত চুম্বন হয়, এ তথ্য অজানা থেকে যাবে সবার’। হয়তো ন্যানোশিপে প্রেম থাকে, কিছুটা হলেও। সঙ্গীর চোখে চোখ পড়লে রোমাঞ্চও তৈরি হয়, হয়তো বা। কিন্তু তাকে অতিক্রম করে যায় ‘কমিটমেন্ট ফোবিয়া’।
গ্রাফিক্স: সোমোশ্রী দাস
‘সেই পৃথিবীতে বিকেলের রঙ হেমন্তে হলুদ’। সেই পৃথিবী ডেটিং অ্যাপের পৃথিবী। ন্যানোশিপের পৃথিবী। রিলেশনশিপ আর ন্যানোশিপের মধ্যে ফারাক কোথায়? সেই অর্থে কোনও ফারাক নেই। দুটোই আসলে সম্পর্কের দুটো রূপ। ‘রিলেশনশিপ’ কথাটার মধ্যে কমিটমেন্ট, মনোগ্যামি, লয়ালটি এসব না-বলা শব্দ থেকে যায়। ‘ন্যানোশিপ’ এসবের তোয়াক্কা করে না। সে অনেক বেশি ঝকঝকে, মেদহীন, নির্ভার। এখানে জনপ্রিয় অ্যালগোরিদম হল ওএনএস (ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড), এফডব্লিউবি (ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট), ইএনএম (এথিকাল নন মনোগ্যামি), এসডব্লিউটি (সেক্স উইদাউট ট্রাবল)। সবকিছুর মধ্যেই একটা নন-কমিটেড, গা-ঝেড়ে-ফেলা, ফুরফুরে ব্যাপার থাকে। এখানে ‘কমিটমেন্ট’ শব্দটা সরাসরি রেড ফ্ল্যাগ। দু’ তরফের যেদিক থেকে এই শব্দটা আসে, তখন উল্টোদিকের মানুষের ধাঁ হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
তাহলে কি ন্যানোশিপ বা ঘোষিত শর্ট-টার্ম রিলেশনশিপের মধ্যে ভালোবাসা থাকে না? শরীর বা মনের সম্পর্ক সেখানে কি যান্ত্রিক? চুম্বন কি সেখানে যন্ত্রবৎ? এই প্রসঙ্গে রণজিৎ দাশের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে– ‘অভিনয়কালে চুম্বনও যে প্রকৃত চুম্বন হয়, এ তথ্য অজানা থেকে যাবে সবার’। হয়তো ন্যানোশিপে প্রেম থাকে, কিছুটা হলেও। সঙ্গীর চোখে চোখ পড়লে রোমাঞ্চও তৈরি হয়, হয়তো বা। কিন্তু তাকে অতিক্রম করে যায় ‘কমিটমেন্ট ফোবিয়া’।
এই সময়ের আধুনিক নগরজীবনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্কের ঘেরাটোপে কেউ আর জড়াতে চাইছে না। সেরকম সম্পর্কে অনেক দায়িত্ব থাকে। একে অপরকে সময় দিতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় একে অপরের ভালোমন্দের। এই ব্যস্ত জীবনে সেসব বড় টাইম-কনজিউমিং। কমিটেড রিলেশনশিপে স্পেস থাকে না। ‘তুমি শুধু আমার’ এই পজিসিভনেসটায় প্রথমদিকে মিঠে রোদের আঁচ পোহানো গেলেও, পরের দিকে সেটাকে দখলদারির নাক-গলানো মনে হয়। তাছাড়া প্রতিশ্রুতিরও কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমি তোমার প্রতি কমিটেড হয়ে, প্রথমত, দ্বিতীয়ত, এবং শেষপর্যন্ত ‘তোমাকেই চাই’ বলে তোমার এক হাত শক্ত করে ধরে থাকলেও, তুমি যে ফাঁকতাল বুঝে অন্য হাতে অন্য কারও হাত ধরার বেটার অপশন ট্রাই করছ না, তাই-বা কে বলতে পারে! কে বলতে পারে লং-টার্ম মনোগ্যামি প্র্যাকটিস করে আমি শেষ অবধি ‘মুরগি’ হব কি না? যে পরিমাণে ডিভোর্সের হার বাড়ছে, সেটা কমিটেড রিলেশনশিপের রিস্ক ফ্যাক্টরকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। তার চেয়ে এই বেশ ভালো। ন্যানোশিপ। নন-কমিটেডলি কমিটেড। মানে সবই হচ্ছে, অথচ দায় থাকছে না। ‘ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা / খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’।
ন্যানোশিপ শুরুর ভিত্তি অচেনা মানুষদের সঙ্গে পরিচয়ের সময় থেকে। যেখানে পূর্ব-পরিচয়ের প্রি-কনসেপশন ব্যাগেজ থাকে না। বাম্বল, টিন্ডার, হিঞ্জ এইসব ডেটিং অ্যাপে নিজের প্রোফাইল খুলতে হয়, আর পাঁচটা সোশাল মিডিয়া অ্যাপের মতো। সবাই যে অরিজিনাল ইনফরমেশন দিয়ে প্রোফাইল খোলে এমন নয়। ফেক প্রোফাইল সেভাবে হয়তো বেশি থাকে না, তবে মিস কনস্ট্রাকটেড টুথ ইনফরমেশন অনেক প্রোফাইলে থাকে। যেমন কেউ বিবাহিত হলে, সিঙ্গল লেখে। কারও ভাঁড়ে মা ভবানী হলে, সে নিজেকে কোটিপতি বলে লিখতে পারে। কারণ প্রোফাইলগুলো অফিসিয়ালি ভেরিফায়েড হয় না। মূলত হুক আপ রিলেশনশিপ হলেও, কয়েকটি ক্ষেত্রে ডেটিং অ্যাপের সম্পর্ক বিয়ে অবধিও গড়ায়।
রায়া বলে এক সেলিব্রেটি ডেটিং অ্যাপে নাম নথিভুক্ত করাতে গেলে আগে আবেদন করতে হয়, প্রামাণ্য নথি দিয়ে। যদি তার প্রোফাইল কোয়ালিফাই করে, তাহলে তাকে মেম্বারশিপ দেওয়া হয়। সেখানে সব হাই-প্রোফাইল লোকজন ছাড়াও বলিউড সেলিব্রেটিরাও থাকেন। ডেটিং অ্যাপে একজন বহুজনের সঙ্গেও রিলেশন রাখে, বেঞ্চিং অপশন হিসেবে বাকি জনদের রেখে। প্রতিটি ডেটিং অ্যাপের ইয়ারলি টার্নওভার চোখে পড়ার মতো।
ভারতের মতো তথাকথিত রক্ষণশীল দেশে এখন ডেটিং অ্যাপের রমরমা। প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি, তৃতীয় শ্রেণি নানাবিধ ডেটিং অ্যাপের আধিপত্য চলছে এখন। প্রথমদিকে জেন জেড এদের টার্গেট ক্লায়েন্ট হলেও, এখন সব বয়সের সব রকমের মানুষ এতে অ্যাকাউন্ট খুলছে। সমকামী বা কুইয়ার কমিউনিটির জন্য স্পেশাল কিছু ডেটিং অ্যাপ যেমন জোয়ি, পিংক কিউপিড ইত্যাদি রয়েছে।
নন-কমিটেড রিলেশনে তো চেনা মানুষের সঙ্গেও থাকা যায়। আমাদের জীবনে তো চেনা মানুষের সংখ্যা অনেক। তাদের সঙ্গে ডেটে যাওয়া যায় না? কেন? শুধুই কি চেনা পরিসরে খবর ছড়িয়ে যাওয়ার ভয়? রিসার্চ বলছে ডেটিং অ্যাপে আসলে অচেনা মানুষদের চোখে নিজের মূল্য যাচাই করে মানুষ। তবে কি চেনা মানুষের চোখে রহস্য ফুরিয়ে গেলে, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্যোতনা তৈরি হলে, চেনা মানুষের চোখে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ হলে গেলে– অচেনার কাছে সেলফ এস্টিম খুঁজে পেতে চায় মানুষ? কমিটমেন্ট বিফলে গেলে, হাত ধুয়ে ফেলার সম্পর্কে মনোযোগী হয়? ডেটিং অ্যাপের রিলেশনে যারা থাকেন, তাঁরা কি সত্যি ঝাড়া-হাত-পা সম্পর্কের আকর্ষণে থাকেন? নাকি কোনও পুরনো ক্ষত, দগ্ধ অতীত, মরচে ধরা দরজার গন্ধ, মাছের ঝোলের আধভাজা কাঁচা মাছ, দেওয়ালে মাথা ঠুকে যাওয়ার স্মৃতি তার বিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি, সংকল্প, সাত জন্মের ভাবনার পথ আগলে দাঁড়ায়? রিলেশনশিপে সত্যি কতটা ভালো আছি, তার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে ন্যানোশিপের দেখনদারি ভালো থাকার দৃশ্যগুলি? ভালোবাসার দিন কি ফুরোল তবে? ‘রোমান্স’ শব্দের গায়ে আর কি বকুলগন্ধ নেই? চোখে চোখ পড়লে রোমাঞ্চ জাগলে কি ব্যাকডেটেড হয়ে যেতে হয়?
‘প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তর তো জানা’।
……………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………….
যে দেশ ধীরে ধীরে সামাজিকভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা ভেবেছে, সেই দেশে কেন ওই ২৬ জন মহিলাকে বারংবার ‘পহেলগাঁওয়ের বিধবা’ বলে সম্বোধন করা হবে এবং বোঝানো হবে তাঁদের সিথির সিঁদুর মুছে যাওয়ার জন্য তাঁরাই দায়ী, তাঁরা সরাসরি লড়াই করেননি বলেই আজ এই বিপদ হল?