সাতের দশকে বিশ্বপট পাল্টে গেল। দেশের মতোই হই-হুল্লোড় করে দুর্গাপুজো হচ্ছে ক্যাম্প্ডেন টাউন হল-এর দোতলায়। বিশাল পুজো। গেটে ‘শারদীয়া সংখ্যা’-র দোকান। চারিদিকে ধুতি-পাঞ্জাবি-শাড়ি, আলো-গান, ঝলমল করছে। সঙ্গে ভোগের জন্য চাঁদা তোলা চলছে। যতদূর মনে পড়ে– শুরু হয়েছিল শোলার প্রতিমা দিয়ে, তারপর এলেন মাটির প্রতিমা। ১৮ অক্টোবর, ২০১৫ সালের ‘রোববার’-এর ‘প্রবাস পুজো’ থেকে পুনর্মুদ্রিত।
কলকাতায় যখন শিউলি ফোটে, তখন যদি তুমি সাতসমুদ্দুর তেরো নদীর পারে থাকো, তোমার মনে-মনে সেখানেই খেলবে শরৎকালের রোদ্দুর। বাইরে থাক-না যতই কুয়াশা। তখন ছ’য়ের দশক। আমি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ-এ। পুজো এসে গেলেই মন-আনচান, মহাষ্টমীর দিন যেমন করে হোক ট্রেনে চেপে উপস্থিত হতুম লন্ডনের রামকৃষ্ণ মিশনে। সে-মন্দির তখন ছোট, ঘটপুজো হত, ‘অঞ্জলি’ দিয়ে ‘ভোগ’ খেয়ে কেমব্রিজে ফিরে আসতুম। অনেক বঙ্গসন্তানের মুখ দেখতে পেতুম, কিন্তু এমন কিছু ভিড় হত না। আবহের মধ্যে এমন কিছু ‘ম্যাজিক’ ছিল যে বুকটা ভরে যেত।
সাতের দশকে বিশ্বপট পাল্টে গেল। দেশের মতোই হই-হুল্লোড় করে দুর্গাপুজো হচ্ছে ক্যাম্প্ডেন টাউন হল-এর দোতলায়। বিশাল পুজো। গেটে ‘শারদীয়া সংখ্যা’-র দোকান। চারিদিকে ধুতি-পাঞ্জাবি-শাড়ি, আলো-গান, ঝলমল করছে। সঙ্গে ভোগের জন্য চাঁদা তোলা চলছে। যতদূর মনে পড়ে– শুরু হয়েছিল শোলার প্রতিমা দিয়ে, তারপর এলেন মাটির প্রতিমা। ভক্তিভরে সব নিয়ম মেনে ‘শ্রীশ্রী দুর্গা ঔঁ নমঃ’। পুরুত ঠাকুর হয়তো কোনও উচ্চপদস্থ ডাক্তার কিংবা অ্যাকাউনটেন্ট, কিন্তু এ-ক’দিনের জন্য নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পুরোহিত। তাঁর নিষ্ঠার চোটে জোগাড়েদের প্রাণান্ত! পুজো উপলক্ষে নানা বিচিত্রানুষ্ঠান হয়। বিশ শতকে ছিল লোকাল আর্টিস্ট, এখন আমদানি হয় কলকাতা থেকে। আমার তো বাবা সেই ছয়ের দশকের রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোর জন্যই মনকেমন করে।
এবার আটলান্টিক পেরনো যাক। ম্যাসাচুসেট্স কেমব্রিজে এসেছি আমার কলেজ হার্ভার্ড-এ। এখনও এখানে হস্টেলে থেকে পড়ছে আমার ছোট মেয়ে নন্দনা। কেমব্রিজের বাইরে ওয়াটার টাউনের ‘উনিটেরিয়ান চার্চ’-এ পুজো হচ্ছে আমাদের। দারুণ উত্তেজনা। নাচ-গান, বিচিত্রানুষ্ঠান তো আছেই, আছে অঞ্জলি, ভোগ, খাওয়াদাওয়া। আমরা পৌঁছে দেখি– এক জায়গায় আলপনা দেওয়া হচ্ছে ঠাকুর সাজানো হচ্ছে আর একটা ঘরে গানের রিহার্সাল চলছে। তিনটি কিশোরী-সমেত আমাকে দেখেই ওঁরা বললেন, দিদি নীচে রান্নাঘরে চলে যান। প্রসাদ কাটা, কুটনো কোটা চলছে। লোক নেই মোটে। আমরা চারমূর্তি আবির্ভূত হলাম। সেখানে যে-গিন্নিরা ছিলেন, তাঁরা মহা উল্লাসে আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে ছুরি গুঁজে দিলেন। এবং তাঁদের নির্দেশ অনুযায়ী, আমরা মুহূর্তে কুটনো-কর্মী বনে গেলাম।
একজন গিন্নি জিগ্যেস করলেন, তোমাদের নাম কী গো? নন্দনা বলল, ‘নন্দনা’। কামাক্ষী। ইলোরা। নন্দনা কী? দেবসেন। কামাক্ষী কী? রাও। ইলোরা কী? ইলোরা আমার দিকে তাকাল। সে প্রসাদের জন্য আপেল কুচচ্ছে। আমি বললাম, বলো, তোমার নাম। ইলোরা সাহাবুদ্দিন। ও তাই! তুমি বুঝি বাংলাদেশের মেয়ে? আর কামাক্ষী তামিলনাড়ুর, নন্দনা বলল। কুটনো কোটা চলতে থাকল যথাপূর্বম। বুকের মধ্যে টের পেলুম সাজিয়ে দেওয়ার আগেই জগজ্জননী ভোগ গ্রহণ করেছেন। জয় বাংলা!
’৯৫ সাল। শরৎকাল। আমি গিয়েছি সিডনিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কবিতা উৎসব’-এ কবিতা পড়তে। সেদিন শরীরটা ভাল নেই। সকালে ব্লু মাউন্টেন ঘুরে এসে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছি। বন্ধু সৌমেন বলল, এখানে দুর্গাপুজো হচ্ছে, যাবে না? আমি বললাম, দেখি, আজ না-হলে কাল যাব। এমন সময় দু’টি ছেলে এসে হাজির। একটি বাঙালি, একটি ইতালীয়। বাঙালি ছেলেটি বলল, সে সদ্য ‘বামাবোধিনী’ পড়ে পাগল হয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে। আর, এই তার জুড়ি। এর আগে সে ‘সমপ্রেম’ নিয়ে কোনও বাংলা বই পড়েনি। ছেলেটি বলল, আপনাকে তো যেতেই হবে পুজোমণ্ডপে, আমার নাচ আছে না? তুমি আবার কী নাচবে? কেন? দেখবেন, কী নাচব? বলে গান ধরল, সঙ্গে নাচ। ‘ভাল করিয়া বান্ধো রে দোতারা সুন্দরী কমলা নাচে।’
নাচ দেখে আমি তো অবাক! যেমন সুন্দর গাইল, তেমন সুন্দর নাচল। পুজোমণ্ডপের বিচিত্রানুষ্ঠানের একটি অঙ্গ এই নাচ। বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবাংলার মানুষরা একসঙ্গে এই পুজোটা করেন। তখনও করতেন। এখনকার কথা বলতে পারি না। আমি তাদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম মণ্ডপে। রাত বাড়তে, মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে, ওরা বলল, চলো, তোমাকে আমাদের ‘গে-বার’-এ নিয়ে যাই, সিডনির গে-লাইফ কেমন হয় চোখে দেখে যাও। সেখানে এক পেশিবহুল পুরুষ অসামান্য কোমল নারীর নাচ নাচলেন। এখানে টিকিট কিনতে হয় না, একটা ড্রিঙ্ক নিলেই হয়। সে শরবত হলেও চলবে। প্রচুর ভিড়। দারুণ জমজমাট। মধ্যরাত্রি অনেকক্ষণ পেরিয়ে গিয়েছে, কারও বাড়ি যাওয়ার নাম নেই। বেচারি সৌমেন জেগে বসে থাকবে, তাই আমাকে বাড়ি যেতেই হল। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে পুজোটা খারাপ কাটল না।
ফিরে আসি বঙ্গোপসাগরে। এর কাছাকাছি সময় আমি একবার পুজো দেখতে বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। বাবরি মসজিদের পরবর্তী অবস্থা। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গুণ্ডামি হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখলুম মূর্তি নেই। পটপুজো হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারে ভিড় কম। মেলা তেমন বসেনি। কিন্তু মন্দিরের ভিতরে যে-মাজার রয়েছে, সেখানে জ্বলন্ত মোমবাতির অভাব নেই। কিন্তু সিদ্বেশ্বরী মন্দিরের গলিতে পুজো গমগম করছে, মেলা জমজম করছে। আমার বন্ধু বীথি আর গাজি আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন টাঙ্গাইলের পুজো দেখতে নিয়ে যাবেন বলে। আমরা চললাম বীথি-গাজি’র দেশ গাজিপুরের পুজো দেখতে। সেখানে গিয়ে আমি অবাক। কলকাতার সরস্বতী পুজোর মতো অলিতে-গলিতে, মাঠেঘাটে শুধু দুর্গামণ্ডপ বাঁধা হয়েছে। পথেঘাটে নতুন জামাকাপড় পরা মানুষের ভিড়। যেতে-যেতে কানে বিভিন্ন রবীন্দ্রসংগীতের কলি ভেসে আসছিল। ঢাকের বাদ্যি বাজছে, শঙ্খ-ঘণ্টা বাজছে, তালপাতার ভেঁপু বাজছে। মাঠে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে আমরা মণ্ডপে-মণ্ডপে ঘুরতে লাগলুম। অনেকগুলো বাড়ির পুজো দেখলুম। এক-জায়গায় দেখি লক্ষ্মী-গণেশ উল্টো দিকে।
একটি হাসপাতালের পুজো অসাধারণ লাগল। কোথাও কোথাও হাঁড়িকাঠও দেখলাম। বলি হয়? একটি মণ্ডপে দেখি প্রতিমা পড়ে আছে। কোনও লোকজন নেই। আর পুরো প্রতিমায় সবুজ ছিটছিট স্প্রে-পেন্টিং করা। কী বা দুর্গা কী বা অসুর। কিন্তু পিছনে চালচিত্র আছে। দেখে মনে হল, বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত। বীথি-গাজি বলেছিলেন যে, আমরা টাঙ্গাইলের বিসর্জন দেখতে যাচ্ছি, ওটা সবথেকে দ্রষ্টব্য। জোড়া নৌকো করে ঠাকুর আসেন মাঝ-নদীতে, তারপর জোড় খুলে দু’টি নৌকো দু’দিকে সরে যায়। প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হয়। মণ্ডপের সামনে খাটিয়া পেতে বসে কতগুলো ছেলে লুডো খেলছে। আমি জিগ্যেস করলাম, তোমাদের প্রতিমা কখন ভাসান যাবে? ছেলেগুলো বলল, সে তো কইতে পারুম না আপা! হিন্দুদের জিগান গিয়া, আমরা খালি ঠাকুর পাহারা দিতাসি। ঘাবড়ে গিয়ে আমরা চলে যাচ্ছি দেখে বলল, কই যান, কই যান, পুকুরপাড়ে হরিশ্চন্দ্র দেখসেন? রহিতাস্য? চলেন দেখাইতাসি, দারুণ করসে। তারা আমাদের হরিশচন্দ্রের গল্প শোনাল। আমরা বিসর্জনের বদলে মিলনমেলা দেখে গাড়ির দিকে রওনা দিলুম।
অনুলিখন: গার্গী রায়চৌধুরী