ঘর থেকে পালিয়ে আরও একটা ঘর। যেন একটা এসকেপ রুম। ডেডলাইন, ইমেল, বসের খিস্তিমুক্ত একটা পরিসর। ক্লান্তি থেকে প্রাণবন্ত পথের এই চটকদার উড়ান– সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং! এক ইনফ্লুয়েন্সার বলছেন, জীবন যখনই অতিচঞ্চল হয়ে ওঠে! মনে হয় পালিয়ে যাই। অফিস থেকে। হাউসপার্টি থেকে। নোটিফিকেশন থেকে। বাথরুমে খানিক সময় কাটিয়ে আসি তৎক্ষণাৎ। শান্ত হই। মগ্ন হই জীবনবোধে।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ অথবা তার আশপাশেই, দুপুরবেলা, খুব পুরনো কোনও অশ্বত্থ গাছের তলায় জিরোচ্ছিল একটা ট্যাক্সি। ট্যাক্সির জানলায়, একটু বড় আকারের রুমাল মেলে রাখা। লাল রঙের ওপর একপোঁচ ময়লা। রুমালের ওপার থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা হাত। নড়াচড়া নেই। গভীর ঘুম। কী অপূর্ব একখানি আড়াল তৈরি করেছিলেন ট্যাক্সিচালক! হোক সাময়িক, তবু যেন স্বপ্ন দেখার আড়াল! সেই আড়ালেই একার কান্না। একার উল্লাস। একের সঙ্গে একের মোলাকাত।
কেওটিক পৃথিবীকে থেকে পালিয়ে, ধুচ্ছাই করে, ফিওদর দস্তইয়েভস্কির একটি চরিত্র ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ করে রেখেছিল নিজেকেই। প্রায় ৪০ বছর। স্বেচ্ছাচারী হয়ে আড়ালে। ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসের সেই চরিত্র, নিজেকে কখনও বলেছে ঈর্ষাকাতর, কখনও কামুক, কখনও-বা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভালোমানুষ। এই যে অনর্গল একটা বোঝাপড়া, আত্ম এবং আত্মার, শঙ্খ ঘোষ যেমন লিখছেন: ‘আমি কি নিত্য আমারও সমান/সদরে, বাজারে, আড়ালে?’ সেসবের জন্যই আত্মগোপন। ‘জেন জি’ অবশ্য আত্মগোপনে না-পসন্দ। বলছে, স্ট্রেস-রিলিফ! পর্দা অথবা কোনও মানুষে নয়, আড়াল খুঁজে পেয়েছে বাথরুমে।
শুরুতেই নাক সিটকোবেন না প্লিজ! বাজারে নতুন একটি লবজ এন্ট্রি নিয়েছে। ‘বাথরুম ক্যাম্পিং’। যে-ক্যাম্পিং টেন্টবিহীন। বনফায়ার উধাও। নক্ষত্রের রাতের কোনও বালাই নেই। বরং কমোডের ওপরে ব্যবহার করা যেতে পারে সিট কভার। পছন্দসই ঝিলমিল আলো। ছোট গালিচা। আবার কোনও সাপ্তাহিক পত্রিকাও চলতে পারে। নান্দনিকতার খাতিরে। বাথরুমের যাবতীয় অত্যাবশ্যক কম্ম ছাড়াই দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেওয়ার দিলখুশ বন্দোবস্ত!
অতএব, ঘর থেকে পালিয়ে আরও একটা ঘর। যেন একটা এসকেপ রুম। ডেডলাইন, ইমেল, বসের খিস্তিমুক্ত একটা পরিসর। ক্লান্তি থেকে প্রাণবন্ত পথের এই চটকদার উড়ান– সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং! এক ইনফ্লুয়েন্সার বলছেন, জীবন যখনই অতিচঞ্চল হয়ে ওঠে! মনে হয় পালিয়ে যাই। অফিস থেকে। হাউসপার্টি থেকে। নোটিফিকেশান থেকে। বাথরুমে খানিক সময় কাটিয়ে আসি তৎক্ষণাৎ। শান্ত হই। মগ্ন হই জীবনবোধে।
একজন মনোবিদের একটি পর্যবেক্ষণের কথা বলি। বলছেন, মানুষ বেসিক্যালি ক্লান্ত। গ্যাদগেদে সংসার-সন্তান-সুখটানের প্রসঙ্গ ছেড়ে, তিনি জানিয়েছেন, জনসমক্ষে, প্রতি পলেই নিখুঁত নিশ্ছিদ্র ব্যক্তিত্ব বহন করতে করতে মানুষ ক্লান্ত। হা একুশ শতক! রিলসের এমনই জাদু দেখিয়েছে যে, মানুষ কুকুরের ল্যাজের মতো গোল্লাপাক মারে– কীভাবে সর্বক্ষণ সুন্দর হয়ে বাঁচা যায়! কীভাবে রোজগার করা যায় আরও টাকা! কীভাবে ঠকানো সম্ভব আরও! কাজেই, বাথরুমে গেলে নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হয়। যে আমির কোনও আবরণ নেই। যে আমি ক্ষতবিক্ষত। যে আমি ভুল করেছে বারবার।
……………………………………………………………………………………………….
একটা ঘর ছিল, বোধহয় আছে এখনও, যে ঘরে পা রাখামাত্র মনে হয়েছিল, মায়ের গন্ধমাখা কোল। ওই ঘরই আবার স্ট্রেসের মাথায় বিলি কেটে দেওয়ার মতো পেলব। ওই ঘরই আমার অ্যাবসোলিউট আড়াল। কী আশ্চর্য! যে আড়াল বেছে নিয়েছিলাম স্রেফ নির্ঝঞ্ঝাট সময় কাটানোর অভিলাষে, সেই আড়াল ট্রেন্ডের চাপে চেপ্টে হয়েছে পালিয়ে বাঁচার আস্তানা। যেন ব্লিংকইট থেকে দিব্যি কিনে নেওয়া যাবে। দশ মিনিটে ডেলিভারি! আসলে প্রেম থেকে, বিদ্রোহ থেকে, রাষ্ট্রের থেকে, মানুষের থেকে পালাতে পালাতে, ওই ঘর থেকেও অনায়াসেই পালিয়ে যেতে শিখলাম। পৌঁছলাম আরও ছোট একটা ঘরে।
……………………………………………………………………………………………….
‘এসকেপ ফ্রম রেসপন্সিবিলিটিস’ কিন্তু পুরনো। দুমদাম ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়েছেন। শনি-রবিবারে মনে হয়নি, যাই! একটু সমুদ্রস্নান করে আসি? তৎক্ষণাৎ বাসে কিংবা ট্রেনে চেপে দিঘা। আড়ালের সন্ধান আসলে থামেনি। ঠিক তেমনই, একজন ষাটোর্ধ্ব বললেন, এ আর নতুন কী! সেই কোন বয়স থেকেই, কালে-অকালে আমি বাথরুমে এসে বসি। হাতে থাকে সংবাদপত্র। দিব্যি লাগে। হালফিলে এত গালভরা নাম হয়েছে! ভাইরাল হয়েছে। নতুন প্রজন্মের অবসেশানে পরিণত হয়েছে।
তবে একাধিক মনস্ততাত্ত্বিক গবেষণার ভাষ্যে, বাথরুম ক্যাম্পিং একধরনের ‘কোপিং মেকানিজম’। আমার, আপনার, নিশ্চিত কোনও স্বতন্ত্র কোপিং মেকানিজম আছে। থাকতে বাধ্য মশাই! যেমন আপনি এক কাপ চা খেয়ে দুর্বহ চিন্তাগুলো ফেলতে পারেন রিসাইকেল বিনে। কেউ নদীর পাড়ে বসে থাকতে পারে নিশ্চুপ। কেউ যাচ্ছে বাথরুমে। ক্ষতিকারক নয়। বরং মানুষ বিশেষে, বাথরুম কিন্তু ক্রিয়েটিভ চিন্তার আঁতুড়! প্রেম থেকে প্যারাসিটামল, মুরাকামি থেকে মুড়িঘন্ট– এমন একটা নিরালা আড়ালে, যে কোনও দিকেই আমি চলে যেতে পারি! একমাত্র প্রশ্ন উঠতে পারে, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে।
ধরুন হাওয়া বদলের দিনে, প্রকৃতি ও প্রাণের সাহচর্য পেতে, আপনি গিয়েছেন জলদাপাড়া। দেখেছেন একশৃঙ্গ গণ্ডার। বুনো শেয়াল। হাতির পাল রাস্তা কেটে চলে গিয়েছে। বাথরুমে তা না পেলেও, অসংখ্য অদৃশ্য প্রাণের সংস্থান আছেই। তবে সেই সমস্ত ব্যাকটেরিয়া আপনার শরীরকে তিষ্ঠতে দেবে না। তেড়ে আসবে। মনের আরামের ফাঁকে ফাঁকে। কারণ, ফ্লাশ করার মুহূর্তেই, যে একরাশ জৈব-অ্যারোসল নির্গত হয়, তার ভেতরে অসংখ্য ভাইরাসের খেলা। শখ করে যে ইতালিয়ান মার্বেল বসিয়েছিলেন বাথরুমের মেঝেতে, দু’-দণ্ড শান্তি পাবেন বলে, সেখানেই ভাইরাস। অবধারিত অসুখ। মারণ! উত্তর-আধুনিক যুগের বনলতা সেন কি এসকেপ রুমে থাকেন?
একুশ শতকে ঘরের ধারণা বিলকুল পাল্টে গিয়েছে। একটা ঘর ছিল, বোধহয় আছে এখনও, যে ঘরে পা রাখামাত্র মনে হয়েছিল, মায়ের গন্ধমাখা কোল। ওই ঘরই আবার স্ট্রেসের মাথায় বিলি কেটে দেওয়ার মতো পেলব। ওই ঘরই আমার অ্যাবসোলিউট আড়াল। কী আশ্চর্য! যে আড়াল বেছে নিয়েছিলাম স্রেফ নির্ঝঞ্ঝাট সময় কাটানোর অভিলাষে, সেই আড়াল ট্রেন্ডের চাপে চেপ্টে হয়েছে পালিয়ে বাঁচার আস্তানা। যেন ব্লিংকইট থেকে দিব্যি কিনে নেওয়া যাবে। দশ মিনিটে ডেলিভারি। আসলে প্রেম থেকে, বিদ্রোহ থেকে, রাষ্ট্রের থেকে, মানুষের থেকে পালাতে পালাতে, ওই ঘর থেকেও অনায়াসেই পালিয়ে যেতে শিখলাম। পৌঁছলাম আরও ছোট একটা ঘরে। ‘জেন জি’ বুঝেছে, নিবিড়ভাবে স্ক্রলিং হবে। ইন্সটাগ্রামে ছবি আপলোড করলে কুল লাগবে। অথচ স্বপ্ন দেখা যাবে না।
এরপর যে এসকেপ রুমের সন্ধান পাওয়া যাবে, সেটা কি আরও ছোট? সেই আড়ালে আমি আঁটতে পারব তো?
………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………
যাঁরা সবিতার বিরুদ্ধে ছিলেন, আম্বেদকরের মৃত্যুর জন্যেও সবিতাকে দায়ী করেছিলেন তাঁরা। কেউ কেউ অভিযোগ করেছিলেন ডক্টর আম্বেদকরের ভুল চিকিৎসা করেছেন তাঁর স্ত্রী, আবার কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে এটা মৃত্যু না হত্যা সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন।