এশিয়ার বহু দেশের মতো এদেশেও সম্প্রতি চালু হয়েছে ‘ফেক ম্যারেজ পার্টি’। অর্থাৎ, কি না ‘মিছিমিছি বিয়ের অনুষ্ঠান’। তা মিছিমিছি কেন? কারণ এখানে আসলে কোন বর-বউ নেই। মানে কি না, কোনও বিয়ে-টিয়ে এখানে হচ্ছে না। কিন্তু কোনও বিয়েবাড়িতে যে ধরনের বা যত ধরনের আনন্দ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকে, তার প্রায় সবই এখানে পাবেন। নৃত্যরত বরযাত্রী, তত্ত্ব হাতে কনেযাত্রী, এলাহি খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে এথেনিক সাজগোজ, ডেকরেশন, সানাই, ব্যান্ড পার্টি– সব পাবেন এখানে। পাবেন গায়ে হলুদের কাউন্টার কিংবা মেহেন্দির স্টল। ইচ্ছে হলেই গায়ে হলুদ-চন্দন হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে নিতে পারেন।
আজকে একটা ধাঁধার খেলা। দেখুন তো, উত্তর দিতে পারেন কি না।
“দেশের সবচে’ বড় ইয়ে,
তাকে দেখতে হয় যে গিয়ে;
আর গেলেই আপ্যায়ন,
তার এমনই নিমন্ত্রণ।
সবাই এত সেজে আসে,
চেনা যায় না বসে পাশে;
থাকে রকমারি আহার,
বড়ই এলাহি তার বাহার।
আরে ফ্রি-তে থোরাই খেলাম?
আমি এই তো দিয়ে এলাম,
ছ-টা মোটা কাঁচের গ্লাস,
আমার আছে না একটা ক্লাস।
কিন্তু খাওয়ার পরেই ধন্দ,
অ্যাটলিস্ট একটা-আধটা মন্দ;
আরে বলতেই হবে ভাই,
নইলে আজ রাতে ঘুম নাই।”
বলুন দেখি জিনিসটা কী?
পারলেন না তো? আরে মশাই, অত বুদ্ধি থাকলে কি আর আমরা নিজেকে বাদ দিয়ে অন্যকে বোকা বলতাম! ভেবে দেখুন, যে কনসেপ্টটার নেপথ্যে আপনি আপনার জীবনের প্রায় সব স্বপ্ন, সব ফ্যান্টাসি, সব সঞ্চয়, আর সবচেয়ে বেশি স্যাক্রিফাইস বিনিয়োগ করলেন, এত ‘হিন্টস’ দেওয়ার পরেও তাকে আপনি ধরতে পারলেন না!
আরে বাবা, বিয়ে, মশাই বিয়ে। যদিও আমার মতে, ‘বিয়ে’ নয়, ব্যাপারটার নাম আসলে হওয়া উচিত– ‘ইয়ে’। অর্থাৎ, আনডিফাইন্ড কিছু একটা। কারণ সত্যি বলতে কী, ‘ইয়ে’ আর ‘বিয়ে’ এই দুটো শব্দ দিয়েই সংসারের বহু প্রশ্নের উত্তর না দিয়েও উত্তর দিয়ে দেওয়া যায়!
এই তো যেমন সেদিন। অফিসের জুনিয়রকে বললাম,
– ওহে অমুক, এতবার বলার পরেও ফাইনাল রিপোর্টটা কাল জমা না দিয়ে চলে গেলে?
শুনে অমুক প্রথমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর কেমন জানি উদাস হয়ে গেল। তারপর মিনিটখানেক অমন উদাসটি হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আমার মাথা, আপিসের জানলা আর সামনের টি. সি. এস. বিল্ডিং-এর ছাদের ওপর দিয়ে নিজের দৃষ্টিটাকে আরও ওপরে, এক্কেরে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা ইয়ে ম্যাডাম, কাল এমন একটা ইয়ে হয়ে গেল না…’। মাথা চুলকে, ভুরু কুঁচকেও যখন আমি সেই ‘ইয়ে’-র তল পেলাম না, তখন আবার আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। তাতে সে কিউবিকলের পার্টিশনের ওপর দুম করে এক ঘুসি মেরে বলল, ‘বিয়ে, ম্যাডাম বিয়ে। বোঝেন না কত… কত…’।
এই অবধি বলে সে থামল এবং আবার উদাস হয়ে গেল। এদিকে কত যে ঠিক কী, তা জানার জন্য অপেক্ষা করা উচিত নাকি আমার উঠে যাওয়া উচিত, বুঝতে পারছি না। তখন আচমকাই সে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর ধপ করে চেয়ারের ওপর বসে পরে বলল, ‘কত রকম যে তাতে ইয়ে ম্যাডাম…’। এতগুলো ইয়ে আর বিয়ের টাং-টুইস্টারে আমার কান-মাথা ততক্ষণে ভোঁ ভোঁ করছে। প্লাস আমি গোটা ব্যাপারটার কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু জুনিয়রের সামনে নিজেকে যাতে বেশিক্ষণ গবেট-গবেট না দেখতে লাগে, তাই তড়িঘড়ি গম্ভীর গলায় বললাম, সে তো বটেই, সে তো বটেই। বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
দাঁড়ান মশাই, এখানেই শেষ নয়। আরেকটা ঘটনা বলি। মাসখানেক আগের কথা। তখন প্রবল গরম। তায় আবার মামাতো বোনের বিয়ে। নিজের ওপর একখান তিন মণী বেনারসী আর কেজিখানেক মেকআপ চাপিয়েছি। তারপর ঘেমে-নেয়ে সেই মেকআপের সেরখানেক তুলে ফেলেছি বলে আবার নতুন করে পাউডার লেপতে বসেছি। ইতিমধ্যে কত্তা এসে হাজির। পাতলা পাতলুনের ওপর সাদা সুতির একটা পাঞ্জাবি পরে নবাবী চালে বলল,
– রেডি?
– (আমি) এই পরে তুমি বিয়েবাড়ি যাবে? এতগুলো বয়েস হয়ে গেল, তবু মিনিমাম একটা ইয়ে হল না তোমার?
কত্তা প্রথমটায় খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কিন্তু তারপরই কোথা থেকে যে হঠাৎ এত কনফিডেন্স পেল জানি না; মিঠুন চক্রবর্তীর স্টাইলে ঘাড় বেঁকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল–
– ইয়ে থাকলে কী আর মানুষ বিয়ে করে গিন্নী…
তারপর সেদিন কী হয়েছিল, তা আমার নিজের মুখে, বিশেষ করে আমার বরের মুখে আর না শোনাই ভালো। আর শুনেই বা কী করবেন? আপনার নিজের জীবনেও তো এমনটাই হয়েছে।
তাই ওসব বাদ দিয়ে আপাতত একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার বলি শুনুন। সেটা হচ্ছে, কলকাতায় আমরা এখনও খবর রাখি না; কিন্তু সংসারে বিয়ে জিনিসটা আজকাল আরও ইয়ে, অর্থাৎ কি না আরও আনডিফাইন্ড হয়ে যাচ্ছে। যদিও সে ভালো না মন্দ– সে বিচার আপনার। আমি আপাতত বিষয়টাই শুধু বলি।
এশিয়ার বহু দেশের মতো এদেশেও সম্প্রতি চালু হয়েছে ‘ফেক ম্যারেজ পার্টি’। অর্থাৎ, কি না ‘মিছিমিছি বিয়ের অনুষ্ঠান’। তা মিছিমিছি কেন? কারণ এখানে আসলে কোনও বর-বউ নেই। মানে কি না, কোনও বিয়ে-টিয়ে এখানে হচ্ছে না। কিন্তু কোনও বিয়েবাড়িতে যে ধরনের বা যত ধরনের আনন্দ-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকে, তার প্রায় সবই এখানে পাবেন। নৃত্যরত বরযাত্রী, তত্ত্ব হাতে কনেযাত্রী, এলাহি খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে এথেনিক সাজগোজ, ডেকরেশন, সানাই, ব্যান্ড পার্টি– সব পাবেন এখানে। পাবেন গায়ে হলুদের কাউন্টার কিংবা মেহেন্দির স্টল। ইচ্ছে হলেই গায়ে হলুদ-চন্দন হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে নিতে পারেন।
আর হ্যাঁ, এখানে আপনি আরামসে পরে নিতে পারেন সাধের ব্যাকলেস ব্লাউজ কিংবা সি-থ্রু পাঞ্জাবিটি। কেউ ‘জাজ’ করতে আসবে না। কোন গা-জ্বালানো পিসি গরমকালে আপনার পিঠকাটা ব্লাউজের ওপর আঁচল টেনে বলবে না, ‘হ্যাঁ রে, তোর শীত করে না?’ কোনও সবজান্তা জ্যাঠা স্যান্ডোবিহীন ফিনফিনে পাঞ্জাবি পড়া আপনার পাশে দাঁড়িয়ে বিড়বিড়বে না, ‘ইডা পরনের থাইক্যা উদোম থাইকলাই তো পারস’। কোনও খ্যানখ্যানে মামি খোঁটা দেবে না ‘আরেকটা মিষ্টি খা, আর কত ডায়েট করবি?’ কিংবা সেই অপদার্থ সব সম্বন্ধ সাপ্লায়ার কাকি এসে বলবে না, ‘৩০ তো হল, আর কবে বিয়ে করবি!’
সেই জন্যই ডেস্টিনেশন ম্যারেজের পর, নতুন প্রজন্মের পছন্দের পার্টি ডেস্টিনেশন হল এই ফেক ম্যারেজ পার্টি। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাগুলো আজকাল দেশের নানা প্রান্তে এই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এই তো ১২ জুলাই; নয়ডায় এক এলাহি বিয়েবাড়ির আয়োজন করেছিল ‘ট্রিপি টেকিলা’ নামক এক সংস্থা। তাতে দিল্লি বা গুরুগ্রাম তো বটেই, মুম্বই, হায়দরাবাদ, চণ্ডীগড় বা পঞ্জাব থেকেও লোকজন উড়ে এসেছিল ফ্লাইটের টিকিট কেটে। এমন নতুন ধরনের ব্যাপারটা একবারটি চোখে এবং চেখে দেখবেন বলে।
আপনিও চাইলেই দেখতে পারেন। তবে দুটো কথা। ১০০-২০০ টাকার হাফডজন কাচের গ্লাস, রঙচঙে কাগজে মুড়ে এসব বিয়েবাড়িতে আপনি ঢুকতে পারবেন না। যাওয়ার জন্য টিকিট কাটতে হবে অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে। দাম কমবেশি ৯০০ থেকে ১,৫০০ টাকা।
দুই. নেহাত কপাল খারাপ থাকলে পরিচিত কোনও আনম্যারেড বন্ধুর সঙ্গে সেখানে আপনার দেখা হয়ে যেতে পারে। তারা আপনার পিছন থেকে “ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়?” বলে পোঁ করে বাঁশি বাজিয়ে চোঁ করে কেটে পড়তে পারে।
তবে কি না আপনি-আমি তো নন্দলাল নই। এমন মন্দ কপাল আমাদের কেনই বা হবে। তাই না?
………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………
আশ্রমজীবনকে বিদেশিরা সহজেই আপন করে নিতেন। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ নজর ছিল তাঁদের প্রতি। রানী চন্দকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কত বিদেশি আসে এখানে নিজের ঘর ছেড়ে। দেখিস তারা যেন সেটি অনুভব না করে। আশ্রমে যেন তারা ঘর পায়।’
‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম, আর আট ঘণ্টা অবসর’-এর শেষ অংশটুকু সবথেকে ‘বিপজ্জনক’। সেখানে লুকিয়ে এক অন্য স্বপ্ন– যেখানে শ্রমিক শুধু ঘুমাবে না, ক্লান্তি মেটাবে না, নিজের সময় দিয়ে কী করবে, সেটাও সে নিজে ঠিক করবে। শ্রমিক শুধুই কারখানার এক্সটেশন নয়, মুনাফা তৈরির যন্ত্র নয়, বরং বিপুল সম্ভাবনাময় রক্তমাংসের মানুষ।
‘অপরাধী’ কখনওই একজন কি? প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণ-সহ লিঙ্গ-হিংসাজনিত যে কোনও ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্ধন জোগানো, হিংসার শিকার মানুষদের পাশে দাঁড়ানোয় অনীহা, প্রতিষ্ঠানের মান বাঁচানোর জন্য অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া, চুপ করিয়ে রাখার নরম-গরম হুমকি– এসব কি আমাদের অচেনা? অপরাধীকে আড়াল করাই কি দস্তুর নয়?