হামাস জঙ্গিরা শুধু প্যারাগ্লাইডিং করে বেড়া টপকালই না, বুলডোজার দিয়ে জায়গায় জায়গায় সেই বেড়া উপড়ে ফেলল, সীমান্তের এপারে ইজরায়েলি ট্যাঙ্কের দখল নিল, ‘কিববুজ’ এবং গানের জলসায় গ্রেনেড ও অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে হামলা চালাল, অথচ ইজরায়েলি সেনা কোনও খবরই পেল না। নজরদারির ক্ষেত্রে প্রযুক্তির উপর অতি-নির্ভরশীলতা যে কখনও কখনও বিপর্যয় ঘটায়, তা দেখা গিয়েছিল আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে লাদেনের বাহিনীর হামলার ঘটনায়। তার পুনরাবৃত্তি ঘটল এবার ইজরায়েলে।
হামাস জঙ্গিদের আচমকা হামলায় ইজরায়েলে বিধ্বস্ত একটি ‘কিববুজ’ও। খবরে পড়লাম, ইজরায়েলি সেনা একাধিক দেহ উদ্ধার করেছে এই ‘কিববুজ’ থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে একদা যে ‘কমিউন’ প্রথা ছিল তার ধাঁচেই ইজরায়েলে এখনও রয়েছে কিছু ‘কিববুজ’। বিরল প্রজাতির জীবদের মতোই এই ‘কিববুজ’ ইজরায়েল থেকেও বিলুপ্তির পথে। সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সূত্রেই ২০০৮ সালে ইজরায়েল সফরে গিয়ে ‘কিববুজ’ দেখার স্মৃতি উস্কে উঠছিল।
কয়েকশো একরের উপর গড়ে ওঠা একেকটি ‘কিববুজ’-এ কয়েক হাজার লোকের বাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব-ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা হিটলারের হলোকাস্টের আতঙ্ক ঘাড়ে নিয়ে মরুভূমির বুকে আরব বেদুইনদের জমিতে জীবনযুদ্ধে নেমে অভিনব এই যূথবদ্ধ জীবন বেছে নিয়েছিল। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে কিববুজে প্রতিটি পরিবারের জন্য আলাদা আলাদা কটেজের মতো বাড়ি থাকলেও এখানে রান্না-খাওয়া একসঙ্গে। প্রতিটি ‘কিববুজ’য়ের রয়েছে নিজস্ব চাষবাসের খেত, ছোটখাটো কল-কারখানা এবং নানাবিধ ব্যবসা। সদস্যরাই সেখানে চাকরি পান। সবার আয়ও জমা হয় কিববুজের নিজস্ব তহবিলে। গাজা সীমান্তের কাছে এইরকমই একটি ‘কিববুজ’-এ ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে হামাস জঙ্গিরা। যেমন জঙ্গিরা কিববুজটির পাশে একটি উন্মুক্ত জায়গায় সুক্কত উৎসবে মত্ত ইহুদিদের গানের জলসায় হামলা চালিয়ে ২৬০ জনকে হত্যা করেছে। পণবন্দি করে নিয়ে গিয়েছে আরও জনা পঞ্চাশকে। সাম্যবাদী সমাজের প্রতীক হিসেবে টিকে থাকা কিববুজের মতো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজও জঙ্গিদের নিশানায় চলে আসা যন্ত্রণার।
২০০৮ সালে ভারতীয় সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে যখন ইজরায়েলে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল তখন এই গাজা সীমান্ত ছিল এক পরিপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। ২০০৫ সালে প্যালেস্তাইন অথরিটির নির্বাচনে গাজা ভূখণ্ড হামাসের দখলে আসার পর থেকেই ইজরায়েলের এই দক্ষিণ প্রান্ত স্থায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে পর্যবসিত হয়। গাজা সীমান্তের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে সেরড শহরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখনও রোজই সেরডের উপর আছড়ে পড়ত গাজা ভূখণ্ড থেকে ছোড়া হামাসের রকেট। সেরড সফরের সময় আমাদের প্রতি মুহূর্তে সতর্ক করা হচ্ছিল এই বলে যে, সাইরেনের আওয়াজ পেলেই ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে বাঙ্কারের ভিতরে। সেরডের প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে একটি করে বাঙ্কার। এবারের এই সংঘর্ষের সময় সোশাল মিডিয়ার ছবিতে বারবার সেরড শহরকে দেখতে পাচ্ছি। জঙ্গি হামলায় ক্ষতবিক্ষত। ৭ অক্টোবর ভোরে হামাস জঙ্গিরা ২০ মিনিটের মধ্যে যে পাঁচ হাজার রকেট ইজরায়েলের দিকে ছুড়েছে তার সিংহভাগ এই ৩০ হাজার বাসিন্দার সেরডেই আছড়ে পড়েছে। হাজারো সেন্সর লাগানো কাঁটাতারের বিশাল বেড়া ভেঙে হামাস জঙ্গিরা এই সেরডে ঢুকে থানার দখল পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছিল। ২০০৮-এ সেরডের এই থানায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হামাস জঙ্গিদের ছোড়া হাজার হাজার রকেট ও মর্টারের খোল দেখাতে। যেগুলি থানার একটি বিরাট সেলফে তারিখ ও সময় দিয়ে দাগিয়ে রাখা ছিল। বারুদের গন্ধওয়ালা হামাসের ছোড়া সেই ভারী রকেটের খোল হাতে নিয়ে দেখার সুযোগও ঘটেছিল। গত দেড় দশক ধরে হামাস ও ইজরায়েলি সেনার সংঘর্ষে এই রকেট একটা প্রতীক হয়ে উঠেছে। হামাসের রকেট হানার জবাবে ইজরায়েলের যুদ্ধবিমান নিয়মিত গুঁড়িয়ে দেয় ঘনবসতিপূর্ণ গাজার একেকটি অঞ্চল। যা এখন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
ইজরায়েলি সেনার কড়া নজরদারির মধ্যে একাধিক বেড়া ও ব্যারিকেড ডিঙিয়ে সেরডে যেতে হয়েছিল। দেখেছিলাম, সেরডের প্রায় প্রতিটি পরিবারই হামাসের রকেটে আক্রান্ত। আমাদের সেরড পৌঁছনোর কয়েক ঘণ্টা আগেই রকেট আছড়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল। সেরডের প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম সেই কাঁটাতারের বেড়া, যা আলাদা করে রেখেছে গাজা ভূখণ্ডকে। ইজরায়েল সরকারের প্রতিনিধিরা আমাদের বারবার বলেছিলেন, এইসব বেড়া দুর্ভেদ্য। সেন্সর লাগানো বেড়া ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে সন্ত্রাসবাদকে দমন করা হচ্ছে, তার নিদর্শন তুলে ধরেছিলেন ইজরায়েল সরকারের কর্তারা। ২০০৮-এর পর গত দেড় দশকে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি আরও এগিয়েছে। পেগাসাস স্পাইওয়্যার তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। শুনে থাকি, ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের কাছে নাকি অসম্ভব বলে কোনও কাজ নেই। দূর নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তিতে তারা পকেটে থাকা মোবাইল ফোনেও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিতে পারে। মোসাদের এই প্রযুক্তি নির্ভর নজরদারির চোখে ধুলো দিয়ে কীভাবে হামাস জঙ্গিরা হাজার হাজার সেন্সর লাগানো বেড়া ভেঙে হুড়মুড় করে সেরড-সহ ইজরায়েলের বেশ কিছু শহরে ঢুকে পড়ল, তা নিয়ে তোলপাড় পৃথিবী! হামাস জঙ্গিরা শুধু প্যারাগ্লাইডিং করে বেড়া টপকালই না, বুলডোজার দিয়ে জায়গায় জায়গায় সেই বেড়া উপড়ে ফেলল, সীমান্তের এপারে ইজরায়েলি ট্যাঙ্কের দখল নিল, ‘কিববুজ’ এবং গানের জলসায় গ্রেনেড ও অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে হামলা চালাল, অথচ ইজরায়েলি সেনা কোনও খবরই পেল না। নজরদারির ক্ষেত্রে প্রযুক্তির উপর অতি-নির্ভরশীলতা যে কখনও কখনও বিপর্যয় ঘটায়, তা দেখা গিয়েছিল আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে লাদেনের বাহিনীর হামলার ঘটনায়। তার পুনরাবৃত্তি ঘটল এবার ইজরায়েলে।
এতদিনকার অভিজ্ঞতা বলছে, একেকটা বড় সংঘাতের পর ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার গভীরতাই শুধু বাড়ে, সমাধান সূত্র আরও অধরা হয়ে যায়। ইহুদি ও আরবদের এই দ্বন্দ্বের রেশ শুধুমাত্র ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ছোট এই অঞ্চলটিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বিশ্ব রাজনীতিতেও এর গভীর প্রভাব পড়ে। ভারত-সহ বহু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও মধ্যপ্রাচ্যের এই দ্বন্দ্বে আন্দোলিত হয়। তাকে কাজে লাগায় বিভিন্ন শক্তি। সময় যত যাচ্ছে তত দুই রাষ্ট্রের তত্ত্বে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্যালেস্তাইন অথরিটির নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে গাজা ভূখণ্ড এখন এই সংঘাতের নতুন একটি ক্ষেত্র। যাকে দুই রাষ্ট্রের তত্ত্বে মেলানো সম্ভব নয়। হামাসের রকেটহানা, পাল্টা ইজরায়েলের বিমানহানা– দু’পক্ষের শ’য়ে শ’য়ে মৃত্যু এবং কিছুদিন ধরে বিশ্ব রাজনীতি আন্দোলিত হওয়া, এই সংকটের এটাই যেন ভবিতব্য।