কলকাতার পাতালঘরে শুরু হয়েছে ইঁদুরের রাজত্ব। শহরের নীচে বাস করছে লক্ষ লক্ষ ইঁদুর এবং উত্তর উত্তর তাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইঁদুরের বংশবৃদ্ধির ফলে মহামারীর সম্ভবনা তো রয়েছেই। এছাড়া শহরের বিভিন্ন সড়ক এবং উড়ালপুলের শিয়রেও রয়েছে বিপদের ছায়া। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের হাতের কাছে এখন প্রচুর খাবার-দাবার। ব্যবহার না হওয়া খাদ্যদ্রব্যের সিংহভাগ অংশ যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকছে কলকাতার রাস্তায়। কলকাতা পুরনিগমের মতে, এর থেকেই বংশবৃদ্ধি ঘটছে ইঁদুরের। ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে কলকাতা।
২০০৬ সালে প্রকাশ পায় নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘লুব্ধক’ উপন্যাস। তার মুখবন্ধে নবারুণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখেন: ‘প্রাণমণ্ডলের অধিকার একা মানুষের নয়, সকলেরই। এই অধিকারের মধ্যেই নিহিত আছে প্রাণ ও মৃত্যুর নিয়ত ভারসাম্যের এক সমীকরণ যাকে বিবস্ত্র করলে মানুষের লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনাই বেশি।’
মানুষ স্বভাবতই সহাবস্থানে বিশ্বাসী নয়। মনুষ্য নিয়ন্ত্রিত সমাজের সে একাই শাহেনশা। বাকি সবাই গৌণ। অথচ এই তথাকথিত ‘গৌণ’ প্রাণীরাই এখন তার বিপদের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুরদপ্তর জানাচ্ছে, কলকাতার পাতালঘরে নাকি শুরু হয়েছে ইঁদুরের রাজত্ব। শহরের নীচে বাস করছে লক্ষ লক্ষ ইঁদুর এবং উত্তর উত্তর তাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বছরখানেক আগে দক্ষিণ কলকাতার ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক অঞ্চলে সড়কবিভাগের তরফে একটি ফুটপাথ সারাই করা হয়। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ইঁদুরের দৌরাত্মে সে ফুটপাথের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। যথারীতি পুরসভার পক্ষ থেকে ইঁদুরের গর্তে বিস্তর জল ঢুকিয়ে তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। এবং তার ঠিক পরেই গালপিটের ঝাঁঝরি দিয়ে খাস কলকাতার রাজপথে প্রকাশিত হয় শয়ে শয়ে ইঁদুর।
ইঁদুরের বংশবৃদ্ধির ফলে মহামারীর সম্ভবনা তো রয়েছেই। এছাড়া শহরের বিভিন্ন সড়ক এবং উড়ালপুলের শিয়রেও রয়েছে বিপদের ছায়া। কলকাতার এ হেন পরিস্থিতিতে হয়তো বিস্মিত হবেন অনেকেই। কিন্তু তার কারণ বিশেষ নেই। বরং এই মূষিকবিজয় পালার নেপথ্য কাহিনি খানিক অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে কলকাতার ভৌগোলিক মানচিত্র। গড়ে উঠেছে ‘গ্রেটার কলকাতা’। একটা সময় কলকাতার আশপাশে ছড়িয়ে থাকা মফসসলগুলির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু তাও এই ‘গ্রেটার কলকাতা’-এর কবলে পড়ে ধুলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, মহানগরের বর্ধিত মানচিত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরি হয়েছে আইটি হাব। আজকের কলকাতা আইটি কোম্পানিগুলির নয়নের মণি। তার কারণ, একবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় সস্তার শ্রমিক আমদানি করা অত্যন্ত সহজ।
যথারীতি, কলকাতার বেবাক আপিস-কাছারিকে কেন্দ্র করে গজিয়ে উঠেছে হাজার হাজার খাবারের দোকান। এদের সবগুলিই যে পাকাপোক্ত রেস্তরাঁ, এমনটা নয়। করোনকালে বেড়েছে বেকারত্বের হার, চাকরি খুইয়েছেন বহু মানুষ। ফলে পাকাপোক্ত রেস্তরাঁর পথে না হেঁটে অনেকেই রোজগারের জন্য ‘ফুড ট্রাক’ জাতীয় অস্থায়ী ব্যবস্থার উপর নির্ভর করেছেন। কাজেই বলা চলে, আইটি হাবপ্লাবিত কলকাতা বর্তমানে খাদ্যশিল্পের উর্বর ভূমি।
এর সঙ্গে আছে গিগ অর্থনীতির নব্য অবদান, ফুড অ্যাপ। এই ফুড অ্যাপের দৌলতে কেবলমাত্র মোবাইলের বোতাম টিপলেই দোরগোড়ায় নিমেষে পৌঁছে যাবে খাদ্যদ্রব্য। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের হাতের কাছে এখন প্রচুর খাবার-দাবার। কিন্তু এর সবটুকুর যে সদ্ব্যবহার হচ্ছে, এমনটা জোর দিয়ে বলা চলে না। এবং ব্যবহার না হওয়া খাদ্যদ্রব্যের সিংহভাগ অংশ যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকছে কলকাতার রাস্তায়। পুরনিগমের মতে, এর থেকেই বংশবৃদ্ধি ঘটছে ইঁদুরের। ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে কলকাতা।
আরও পড়ুন: বলশালী রাষ্ট্র বনাম ভিটেমাটি খোয়ানোদের দল
বছরখানেক আগে শহরের কিছু রেস্তরাঁ মালিক মিলে সম্মিলিতভাবে এই অপচয়ের প্রাবল্য ঘোচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভের লাভ বিশেষ হয়নি। তারপরও কলকাতার বিভিন্ন খাবারের দোকান থেকে প্রত্যেকদিন নির্গত হয়েছে প্রচুর পরিমাণে আবর্জনা, বাসি এবং পচা খাবার। অর্থাৎ ঝাঁ চকচকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উল্টো পিঠে রয়েছে যক্ষপুরীর অন্ধকার। আসল কথা হল, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবেশ নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয়। ফলে তার কাছ থেকে এই আবর্জনা সমস্যার সমাধান আশা করাও বৃথা। অতীতেও এই ঔদাসীন্যের উদাহরণ মেলে।
দ্বিতীয় কৃষিবিপ্লবের কালে ব্রিটেনে কৃত্রিম সারের বাড়বাড়ন্ত দেখা দেয়। ১৮৪২ সালে জন বেনেট লোয়েস নামে এক কৃষি বিজ্ঞানী ‘সুপারফস্ফেট’ নামক এক ধরনের কৃত্রিম সার আবিষ্কার করেন। এই সার ব্যবহার করলে কৃত্রিম উপায়ে বাড়বে জমির ফলন। যথারীতি, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই পুঁজিপতিরা লোয়েসের আবিষ্কারকে ব্যাপকহারে স্বাগত জানান, কারণ জমির ফলন বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ব্যবস্থাও বৃদ্ধি পাবে।
কার্ল মার্কসও সেদিন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে লোয়েসের আবিষ্কারকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই তিনি তার সুদূরপ্রসারী বিপদ বুঝতে পারেন। অতিরিক্ত পরিমাণে কৃত্রিম সার ব্যবহার করলে জমির ফলন বৃদ্ধি পাবে ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভবনা দেখা দেবে। তবে সে ক্ষয়ক্ষতি যে কখনওই পুঁজিবাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না, এও তিনি জানতেন। তাই ক্যাপিটাল-এর প্রথম খণ্ডে তিনি লিখছেন:
‘Capitalist production, disturbs the circulation of matter between man and the soil, i.e., prevents the return to the soil if it’s elements consumed by man in the form of fooding and clothing; it therefore violates the conditions necessary to the lasting fertility of the soil.’
পুঁজিবাদ নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থে পরিবেশকে ব্যবহার করে, অপচয় করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিয়ত সহায়তা পায় সে। ভারতের ক্ষেত্রে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা ইতর পুঁজিবাদ এই দায়িত্বজ্ঞানহীন অপচয়ের সংস্কৃতিই মানুষের মধ্যে প্রচার করে।
দিন কয়েক আগে তিস্তার হড়পা বানে সিকিমের মানুষের জীবনে বিপদ ঘনিয়ে এসেছিল। হিমালয় অঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত খননকার্য এই ধরনের হড়পা বানের অন্যতম কারণ, এমনটাই মনে করেন বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদদের একাংশ। অতএব, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিমালয়ে যথেচ্ছ খননকার্য চালাবে। দেশের খনিজ সম্পদ বিদেশি পুঁজির হাতে তুলে দেবে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে খাদ্য অপচয়ের থেকে চোখ সরিয়ে রাখবে। এবং এর সবটাই আমাদের মেনে নিতে হবে। কিন্তু এর বিপরীতে সেই অমোঘ সাবধান বাণী স্মরণে রাখাও আমাদের আশু কর্তব্য:
‘খাওয়া না খাওয়ার খেলা
যদি চলে সারাবেলা
কখন কী ঘটে যায়
কিচ্ছু বলা যায় না।’