মনে পড়ছে, ভরা বর্ষায় অমলদার করা একটা কার্টুনের কথা। যেখানে ইলিশের মা বাকি ইলিশদের বলছে, ‘বড় খোকা সেই যে উৎসবে গেল, এখনও তো ফিরল না!’ এবং এখানেই অমলদা শেষ করেননি। পক্ষ নেওয়া যে শিল্পীর কাজ, তাও অমলদা করে দেখিয়েছিলেন। মাছকে একদিন জিতিয়েও দিয়েছিলেন তিনি। স্মৃতি থেকে বলছি সেই কার্টুনের কথা। জলের তলায় নেমেছে বঁড়শি। দুটো মাছ, বা হয়তো একটাই। কিন্তু সে মাছের মুখে মাস্ক। ফলে বঁড়শির ফাঁদে সেই মাছ পড়ছে না, বেঁচে যাচ্ছে।
অমলদা, অমল চক্রবর্তী চিরব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁকে আর পাওয়া যাবে না কোনওভাবেই। কোনওমতেই। ৯০ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর, তবু, বিরাট শিশু একমনে এঁকে চলেছিল ‘অমল আলোয়’। প্রত্যেক দিন– শেষ কয়েক দিনের তীব্র অসুস্থতা ছাড়া সে আলো একবারের জন্যও নিষ্প্রভ হয়নি। বাংলা রাজনৈতিক কার্টুনে এতকাল যে লোডশেডিং হয়নি, সে কৃতিত্ব অমল চক্রবর্তীর। শুধু ‘অমল আলোয়’ পর্বটুকু বাদ দিলেও, তাঁর কাজ পরিব্যপ্ত হয়ে আছে নানাবিধ সংবাদপত্রে, এমনকী, বই-পত্রিকার অলংকরণেও। যে অলংকরণের কথা তেমন করে চর্চিত হয় না বললেই চলে। এক্ষুনি মনে পড়ছে, হিমানীশ গোস্বামীর ‘দার্জিলিং-সঙ্গী’-এর সঙ্গে আঁকা তাঁর ছবিগুলি, ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় আঁকা তাঁর দুরন্ত টেলপিসও। ‘সন্দেশ’-এর টেলপিসে এক সৈনিকের ঢাল থেকে উঁকি মারছিল এক মজাদার কচ্ছপ।
কার্টুনিস্ট হিসেবে অমল চক্রবর্তী ছিলেন কার্টুনিষ্ঠ। টুকরো-টাকরা অন্ধকারই ছিল তাঁর আঁকার উপাদান। সে অন্ধকার সমাজের, রাজনীতির, মানুষের একান্ত অন্ধকারও। মনে পড়ছে, অনেক দিন আগে, অমলদা লিখেছিলেন, ‘পকেটে একটা টর্চ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অন্ধকারে আলো ফেলছি, পাচ্ছি উপাদান।’ সেই উপাদানকে শাণিত বুদ্ধির তরজমায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব ঘরানার কার্টুনদল। অমলদার কার্টুন কিন্তু স্রেফ ব্যঙ্গ করেনি, শুধুই হাসায়নি– অনেক সময় দুঃখিত করেছে, হতভম্বও। সহানুভূতির সঙ্গে চারপাশ দেখতে শিখিয়েছে অমলদার কার্টুন। একজন প্রকৃত শিল্পীর কাজ বোধহয় এই– জগতের যা কিছু, সব কিছুকেই অমলিন মৌলিক ভালোবাসা দিয়ে দেখা।
একথা বলছি, কারণ মনে পড়ছে, ভরা বর্ষায় অমলদার করা একটা কার্টুনের কথা। যেখানে ইলিশের মা বাকি ইলিশদের বলছে, ‘বড় খোকা সেই যে উৎসবে গেল, এখনও তো ফিরল না!’ এবং এখানেই অমলদা শেষ করেননি। পক্ষ নেওয়া যে শিল্পীর কাজ, তাও অমলদা করে দেখিয়েছিলেন। মাছকে একদিন জিতিয়েও দিয়েছিলেন তিনি। স্মৃতি থেকে বলছি সেই কার্টুনের কথা। জলের তলায় নেমেছে বঁড়শি। দুটো মাছ, বা হয়তো একটাই। কিন্তু সে মাছের মুখে মাস্ক। ফলে বঁড়শির ফাঁদে সেই মাছ পড়ছে না, বেঁচে যাচ্ছে। তাই বলে ভাববেন না যে, অমলদা ‘ভেগান’। মাছ তো স্রেফ ‘মাছ’ নয়।
গাছের তলায় দু’জন শ্রমিক বসে আছে। উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক পাখি। এইটুকুই এঁকেছিলেন অমলদা। সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘পরেরবার যেন পরিযায়ী পাখি হয়ে জন্মাই… ফিরে আসতে, চলে যেতে কোনও বাধাই নেই!’ অমলদার কার্টুনে বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল টুকরো উক্তিগুলো। এবং সেই লেখায়, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই অমলদা ব্যবহার করতেন ‘ত্রিবিন্দু’ (…) এবং ‘বিস্ময় চিহ্ন’ (!)। একটু ভাবার সময়, ও অবশেষে বিস্মিত হওয়ার যে প্রক্রিয়া– সে পথে অমলদা বারবার নিয়ে যেতে চেয়েছেন পাঠককে।
কোভিডের সময়। ফোনে অমলদা। বলছিলেন, ‘কী একটা অদ্ভুত ভাইরাস পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। তেতাল্লিশের মন্বন্তর দেখেছি আমি। দুর্ভিক্ষ, কলেরা, রাস্তায় মানুষ মৃতদেহ!’ আমি নীরব, শ্রোতার ভূমিকায়। অমলদা বলতে থাকেন, ‘আমার তখন ৯-১০ বছর বয়স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষটাও দেখেছি। কলকাতায় দেখেছি এরোপ্লেনের মহড়া। আমার মেসোমশাই থাকতেন হাতিবাগানে। সেই হাতিবাগানে একদিন বোমা পড়ল। জোড়াবাগানেও বোমা পড়ল, মনে আছে। সবথেকে ডেঞ্জারাস জিনিস, যা দেখেছি, তা হল ’৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং। সুরাবর্দী তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী, তখন তো প্রধানমন্ত্রীই বলা হত। রাস্তায় রাস্তায় লোক মরে পড়ে আছে। হিন্দু-মুসলমানের রায়ট। উফ! ভাবা যায় না!’ এসবই অমলদার মারকাটারি স্মৃতির দু’-এক ঝলক। অমলদা যে চলে গেলেন, এক আশ্চর্য কলকাতাও ওঁর সঙ্গে সঙ্গে একেবারে হারিয়ে গেল। ওঁর সামাজিক-রাজনৈতিক কার্টুন পরপর দেখলে ইতিহাসকে ছোঁয়া যাবে বটে, কিন্তু কলকাতার ওই স্মৃতির কোনও ডকুমেন্টেশন রইল না, যা এলোমেলোভাবে নানা সময় আড্ডাচ্ছলে বলতেন অমলদা।
বেশ কয়েক বছর, হয়তো অবিশ্বাস্যই মনে হবে আপনাদের, আমারও হত– অমলদা চোখে প্রায় দেখতে পেতেন না। তাও বেশ ক’টা লেন্স লাগিয়ে, টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কাজ করতেন। অথচ কার্টুন দেখে নেপথ্যের এই শারীরিক পরিশ্রম করে ছবি আঁকার ব্যাপারে আন্দাজ পাওয়া অসম্ভব ছিল। তার কারণ বোধহয় এতকালের কাজের অভিজ্ঞতা। আর তুখোড় মাথাটাকে কোনও সময়ের জন্যই ছবি আঁকা থেকে বিরতি না দেওয়া।
‘সংবাদ প্রতিদিন’, মাত্র ক’দিন আগেই, ১৯ সেপ্টেম্বর, ওঁর ৯০তম জন্মদিনে, একটা পাতা জুড়ে অমলদাকে ট্রিবিউট জানিয়েছিল। সে কাগজের কপি হাতে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর জনা চারেক ওঁর বাড়িতেও পৌঁছেছিলাম সেদিন। অসুস্থ ছিলেন জানতাম, কিন্তু সেদিন দিব্যি উঠে বসেছিলেন। এবং সেই পুরনো হাসি ছড়িয়ে ছিল তাঁর মুখ জুড়ে। বললেন, দেখতে পাচ্ছেন না কাউকে, কিন্তু এই যে এসেছি আমরা, এজন্য খুব আনন্দ হচ্ছে তাঁর।
–আপনি যে দেখতে পান না অমলদা, কী করে ‘খবর’ পেয়ে যান সমস্ত কিছুর?
–এই যে টিভি, ওটা চলে, আর আমার বউমা খবরের কাগজ পড়ে শোনায়।
–আর, আঁকেনটা কখন?
–ওই রাত তিনটে-চারটেয়।
আমরা চারজনই ‘থ’। ৯০ বছর বয়স। চোখে দেখতে পান না। রাত তিনটেয় উঠে ছবি আঁকেন! লোকটা বলে কী!
–কেন, অত রাত কেন অমলদা?
–হা হা, চারিদিক নিস্তব্ধ, কেউ কোনও কথা বলে না, আঁকতে সুবিধে হয় ভাই। প্রতিদিন এত দুর্বল লাগে নিজেকে, কিন্তু কাজের ব্যাপারে কোনও কথা হবে না। আঁকব, যদ্দিন আছি, রোজ আঁকব।
সেদিন আমরা চারজন, অমলদার বাগবাজারের ফ্ল্যাটের তলায় নেমে, ঘোরতর নিশ্চিত ছিলাম অমলদা অন্তত গোটা পাঁচ বছর নিশ্চিতভাবে আছেন। তবে, একটাই শর্তে। যদি ছবি আঁকাটা চালিয়ে যেতে পারেন। অমলদা, শেষ ছবি এঁকেছেন ৮ অক্টোবর। ৯ তারিখের ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল সেই কার্টুন। ছবি না এঁকে দিন দশেকও জীবিত রইলেন না তিনি।
অমলদা, কলকাতায় এখন উৎসব। আপনি ভালোমতোই জানেন, এত আলোর সাজ কলকাতার নানা রাজপথে ছড়িয়ে, এই একটা সময়ই। এত আলোর মধ্যে একটা আলো, টুক করে নিভে গেলে, ভেবেছিলেন কেউ খেয়াল করবে না?
ভুল ভেবেছিলেন অমলদা।